Thursday, October 30, 2014

শিল্প-কারখানার নিরাপত্তা দেখবে 'সেফটি কমিটি':কালের কন্ঠ

বাংলাদেশে কারখানায় শ্রমিকের প্রাণহানি মানেই আগুনে পুড়ে অঙ্গার কিংবা ধসে যাওয়া ভবনের নিচে পড়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হওয়া। বছরে
র পর বছর ধরে এমন দুর্ঘটনায় কেবল মৃতের সংখ্যাই বেড়েছে, কারখানার পরিবেশ ও শ্রমিকের নিরাপত্তায় নেওয়া হয়নি যথাযথ উদ্যোগ। কিন্তু তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে ১১২ শ্রমিক এবং সাভারের রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৪ শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর বাংলাদেশের কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা ঘাটতির বিষয়টি বিশ্বজুড়ে নিন্দিত হতে থাকে।  এর পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপদ কর্মস্থল এবং কর্মপরিবেশে শ্রমিকের নিরাপত্তার ওপর জোর দিয়ে নতুন শ্রম বিধিমালার খসড়া প্রণয়ন করেছে শ্রম মন্ত্রণালয়। এতে সার্বিক দুর্ঘটনা ঝুঁকি সার্বক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে প্রতি কারখানায় একটি করে ‘সেফটি কমিটি’ গঠনের কথা বলা হয়েছে। কমিটিতে মালিক ও শ্রমিক- উভয় পক্ষের প্রতিনিধি থাকবেন। কমিটির কোনো শ্রমিক প্রতিনিধিকে হয়রানি, নির্যাতন কিংবা তাঁর চাকরির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারবেন না মালিক। আজ বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হবে। খসড়া বিধিমালার ৩৯ নম্বর ধারায় ভবন, যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য কাঠামোর নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, পরিদর্শক ভবন, পথ, যন্ত্রপাতি বা প্লান্টসহ কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো দেয়াল, চিমনি, সেতু, সুড়ঙ্গ, রাস্তা, গ্যালারি, সিঁড়ি, র‌্যাম্প, মেঝে, প্ল্যাটফর্ম, মাচা, রেলপথ কিংবা বৈদ্যুতিক বা যান্ত্রিক পদ্ধতির যানবাহন চালানোর রাস্তা বা অন্য কোনো কাঠামো, তা স্থায়ী বা অস্থায়ী যে ধরনেরই হোক, বিবেচনায় নেবেন, যাতে তা মানুষের জীবন বা নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক না হয়। বিধিমালাটি জারির পর কোনো কারখানা ভবন নির্মাণের জন্য ইমরাত বিধিমালা অনুসরণসহ সরকারের সর্বশেষ নীতিমালা অনুসরণ করে নির্মিত হয়েছে মর্মে সনদ নিতে হবে। বিধিমালা জারির আগে নির্মিত কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে স্বীকৃত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ভবনের স্থায়িত্ব এবং ওজন বহন ক্ষমতা, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য যেকোনো কাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রচলিত অন্যান্য আইন অনুসরণ করা হয়েছে কি না, তা যাচাই করতে পারবেন। অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে সতর্কতা : খসড়ায় ৪০ ধারায় অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, ভবনের প্রতিটি কক্ষে কমপক্ষে দুটি করে বহির্গমন পথ থাকতে হবে। সেগুলো এমনভাবে থাকতে হবে যাতে যে কেউ নিজের কাজের জায়গা থেকে বিনা বাধায় এবং স্বচ্ছন্দে বের হয়ে যেতে পারে। কোনো শ্রমিকের কাজের জায়গা থেকে বহির্গমন পথের দূরত্ব কোনোমতেই ৫০ মিটারের বেশি দূরত্বে হবে না। খসড়া বিধির ৪০(৩) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের নিচতলায় ২০ বা ততোধিক শ্রমিক কাজ করলে অথবা যেখানে দাহ্য পদার্থ বা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় কিংবা জমা রাখা হয় সেসব ক্ষেত্রে জরুরি মুহূর্তে বের হওয়ার জন্য ভবনের ভেতরে বা বাইরে স্থায়ীভাবে নির্মিত কমপক্ষে দুটি মজবুত ও পৃথক সিঁড়ির ব্যবস্থা থাকবে। সেগুলো অগ্নি প্রতিরোধক ও নন-মেটালিক পদার্থ দ্বারা তৈরি হতে হবে। প্রতিষ্ঠানের ভবন বা এর কোনো অংশ আন্ডারগ্রাউন্ডে হলে সেখান থেকে বের হওয়ার জন্যও সিঁড়ির ব্যবস্থা রাখতে হবে।   খসড়া বিধি অনুযায়ী, সিঁড়িতে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ও আলোর ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে সিঁড়িটি ধোঁয়াচ্ছন্ন হতে না পারে। এ ছাড়া প্রতিটি তলায় ন্যূনতম একটি গ্রিলবিহীন বা কবজাযুক্ত জানালা হতে হবে, যাতে জরুরি প্রয়োজনে তা খুলে লেডার বা রশির মইয়ের সাহায্যে নিচে নামা যায়। কোনো মালিক এসব বিধি না মানলে বা পরিদর্শক কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এগুলো কার্যকর না করলে তা চলমান অপরাধ অর্থাৎ প্রতিদিনকৃত অপরাধ বলে গণ্য হবে।  অগ্নিকাণ্ডের সময় তা নেভাতে যাতে তাৎক্ষণিকভাবে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায়, সে জন্য খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রতি তলায় প্রতি ১০০ বর্গমিটার মেঝে এলাকার জন্য ২০০ লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন পানিভর্তি একটি ড্রাম রাখতে হবে। এ ছাড়া ১০ লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন চারটি করে ধাতব পদার্থ দ্বারা নির্মিত লাল রঙের খালি বালতি ঝুলন্ত অবস্থায় রাখতে হবে। যে পদার্থ থেকে অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হলে নেভানোর জন্য পানি ব্যবহার করা যাবে না, সেখানে বালিভর্তি বালতি রাখতে হবে। এ ছাড়া একটি করে ড্রাই কেমিক্যাল পাউডার অগ্নিনির্বাপক বা একই ধরনের বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে ম্যাগনেসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম বা জিংকের গুঁড়া কিংবা চাঁচ বা অন্য দাহ্য ধাতু থেকে আগুন লাগতে পারে, সেখানে ড্রাই কেমিক্যাল পাউডার (ডি টাইপ), পরিষ্কার মিহি শুকনা বালু, পাথরের গুঁড়াসহ অন্য অদাহ্য পদার্থ মজুদ রাখতে হবে। খসড়া বিধিতে বলা হয়েছে, যতদূর সম্ভব প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক শ্রমিককে, অন্তত প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক বিভাগে আলাদা নিযুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে কমপক্ষে ১৮ শতাংশকে অগ্নিনির্বাপণ, জরুরি উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসা এবং বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়ে রাখতে হবে। কমপক্ষে ৫০০ জন শ্রমিক কাজ করে এমন কারখানায় একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাখতে হবে, যিনি অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামাদি সংরক্ষণ করবেন এবং এসব দলকে প্রতি ছয় মাস পরপর পুনঃ প্রশিক্ষণ দেবেন। এ ছাড়া ছয় মাসে অন্তত একবার করে অগ্নিনির্বাপণ ও দুর্ঘটনার সময় জরুরি নির্গমনের মহড়া দিতে হবে।  খসড়া বিধিমালার ৪১(১৪) ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান বা কারখানায় অগ্নিনির্বাপণের প্রয়োজনে অন্তত পাঁচ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি জলাধারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেফটি কমিটি ও তার কর্মপরিধি : শ্রম আইনের ৯০(ক) ধারায় বলা হয়েছে, কমপক্ষে ৫০ জন শ্রমিক রয়েছে- এমন সব কারখানায় একটি করে সেফটি কমিটি থাকবে। এ ধারা কার্যকর করতে খসড়া শ্রম বিধিমালায় বলা হয়েছে, এ বিধি প্রণয়নের সময় বিদ্যমান কারখানাগুলো বিধিটি কার্যকর হওয়ার তিন মাসের মধ্যে সেফটি কমিটি গঠন করবে। আর বিধি কার্যকর হওয়ার পরে স্থাপিত কারখানাগুলো ছয় মাসের মধ্যে এ কমিটি গঠন করবে। শ্রমিকের সংখ্যা অনুযায়ী কমিটির সদস্যসংখ্যা সর্বনিম্ন পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ ১১ জন হবে। পাঁচ সদস্যের কমিটিতে সভাপতি ও একজন সদস্য নেওয়া হবে মালিক মনোনীত প্রশাসনিক কর্মচারীদের মধ্য থেকে। সহসভাপতি ও দুজন সদস্য নেওয়া হবে কারখানার সিবিএ প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে। কোনো কারখানায় সিবিএ না থাকলে সে কারখানার শ্রমিকরা তাঁদের প্রতিনিধি মনোনীত করবেন। কমিটিতে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে। কমিটির মেয়াদ হবে দুই বছর। সেফটি কমিটির শ্রমিক সদস্যরা যাতে নির্ভয়ে ঝুঁকি নিরূপণ করে তা মালিক ও সরকারের শ্রম পরিদর্শকদের জানাতে পারেন, সে জন্য তাঁদের সুরক্ষাও নিশ্চিত করা রয়েছে খসড়া বিধিতে। খসড়া বিধিতে বলা হয়েছে, মহাপরিদর্শক/পরিদর্শকের কাছে সেফটি বিষয়ে কমিটি বা কমিটির কোনো সদস্য কিংবা কোনো শ্রমিক কোনো সুপারিশ পেশ করার কারণে প্রতিষ্ঠানের মালিক কমিটির কোনো সদস্য বা শ্রমিককে হয়রানি বা নির্যাতন কিংবা তাঁর চাকরির বিষয়ে ক্ষতিকর ব্যবস্থা নেবেন না। নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোনো ঝুঁকির কারণে প্রাণনাশের আশঙ্কা চিহ্নিত করতে পারলে কমিটি মালিকপক্ষকে লিখিত বা মৌখিক নোটিশ দিয়ে তাৎক্ষণিক কারখানার কাজ বন্ধ করার পরামর্শ দেবে এবং বিষয়টি পরিদর্শককে জানাবে। সেফটি কমিটির এখতিয়ার সম্পর্কে বলা হয়েছে, কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করবে। কমিটির কোনো সুপারিশ বাস্তবায়নে মালিকপক্ষ সাত দিনের মধ্যে কোনো উদ্যোগ না নিলে শ্রম মহাপরিদর্শক বা পরিদর্শকের কাছে লিখিত অভিযোগ করা যাবে। তখন মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে শ্রম কর্তৃপক্ষ।

No comments:

Post a Comment