কয়েল, ওষুধ স্প্রে, মশারি, ইলেকট্রিক ব্যাট কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। গত দু-তিন মাস ধরে রাজধানীতে মশার উপদ্রব ব্যাপকহারে বেড়েছে। সিটি করপোরেশন নিয়মিত ওষুধ স্প্রে করার দাবি করলেও বাস্তবে মশার উৎপাত থেকে মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর। বর্তমানে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা চলছে। এ মাসের শেষে পিএসসি পরীক্ষা রয়েছে। এ ছাড়া বছরের শেষ সময়ে বর্ষ সমাপনীসহ নানা ধরনের পরীক্ষা চলছে। কিন্তু মশার অত্যাচারের কারণে পরীক্ষার্
থীদের লেখাপড়ায় মারাত্মক বিঘœ ঘটছে। মশার উৎপাতে অনেকে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারছেন না। আগে যেখানে ভবনে উঁচু তলায় মশার অত্যাচার ছিল না এখন সেখানেও উপদ্রব চলছে। শুধু রাতে নয়, দিনেও মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষ। অফিস-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও দিনের বেলা কয়েল বা স্প্রে ব্যবহার করতে হচ্ছে। দেশে প্রতি বছর শীতের সময় মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। তবে ঢাকায় সারা বছরই মশার উপদ্রব চলতে থাকে। ড্রেনের দুর্গন্ধময় পানি, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়সহ নানা কারণে রাজধানীতে মশার উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এ জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশন প্রতি বছর মশা নিধনের জন্য বিপুল পরিমাণ ওষুধ স্প্রে করে থাকে। এ বছরও ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এ খাতে সাড়ে ২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। ঢাকা দণি সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ ১৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং উত্তরের বাজেট ৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া ঢাকা দণি সিটি করপোরেশনে রাজস্ব বাজেট থেকে ৮৬ লাখ টাকা ছাড় দেয়া হয়েছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গত ১৯ অক্টোবর মশা নিধনের জন্য নিয়মিত কর্মসূচি ছাড়াও ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করে। ৫৭টি ওয়ার্ডে কয়েক দিন ধরে এ কর্মসূচি চালানো হয়। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। রাজধানীবাসী মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা পায়নি, বরং দিন দিন মশার উপদ্রব বেড়েই চলেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরো রাজধানীতেই মশার উপদ্রব বেড়েছে। এর মধ্যে মগবাজার, মতিঝিল, মানিকনগর, কমলাপুর, মুগদাপাড়া, কুড়িল, রামপুরা, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, সায়েদাবাদ, মিরপুর, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীর চর, গোড়ান, খিলগাঁও এলাকায় মশার উপদ্রব বেশি। এ ছাড়া নগরীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডিতেও বেড়েছে মশার উপদ্রব। অতিষ্ঠ নগরবাসী এ ব্যাপারে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে বার বার অবহিত করলেও তাতে কোনো ফল মিলছে না। মশক নিধনে সিটি করপোরেশনের তৎপরতা কিছুটা বাড়লেও তাদের ছিটানো ওষুধে কাজ হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। তারা জানিয়েছেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নগরের পাড়া, মহল্লা এবং নালাগুলোতে মশার ওষুধ ছিটাচ্ছে। তবে তাতে মশা মরছে না, কমছে না মশার অত্যাচারও। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ মগবাজারের ডাক্তার গলির বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম গতকাল একটি দোকানে মশার কয়েল কিনতে আসেন। তিনি অভিযোগ করেন, আগে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে মশানিধন কার্যক্রম চোখে পড়ত, এখন তেমনটি দেখা যায় না। মশানিধন অভিযান স্থবির হওয়ার কারণেই মশার উপদ্রব বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি। আগামী ২৩ নভেম্বর থেকে মেয়ের পিএসসি পরীক্ষা শুরু হবে জানিয়ে বলেন, সাততলায় থেকেও মশার অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। মশার উপদ্রবের কারণে মেয়ের লেখাপড়ায় মারাত্মক বিঘœ ঘটছে। মানিকনগর এলাকার বাসিন্দা হুমায়ূন কবির বলেন, মশার কারণে ছেলেমেয়ের পড়ালেখায় খুবই সমস্যা হচ্ছে। তা ছাড়া রাতে মশারি টানালেও মশারির মধ্যে মশা ঢুকে ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। বাড্ডা এলাকার গৃহবধূ শিউলি খাতুন বলেন, সন্ধ্যা হলেই মশার উৎপাত শুরু হয়। কয়েল জ্বালালেও কাজ হয় না। মশা মরতে চায় না। আগে দেখতাম, করপোরেশনের লোকজন আশপাশের নালায় মশার ওষুধ ছিটাত। এখন কাউকে দেখা যায় না। বনানীর বাসিন্দা ফারিয়া তাবাসসুম বলেন, মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। ছোট শিশু নিয়ে আছি মহাবিপদে। সারা দিনই তাকে মশারির মধ্যে রাখতে হয়। মশারির বাইরে বের করলেই মশায় কামড়ায়। দিনেও কয়েল জ্বালিয়ে রাখছি। তবুও মশার কামড় থেকে নিস্তার মিলছে না। সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী নগরীতে পাঁচ শতাধিক জলাশয় রয়েছে। কিন্তু এসব জলাশয় পরিষ্কারের কোনো উদ্যোগ নেই। তাই এসব জলাশয় মশার প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আবার রাজধানীর বেশির ভাগ বাসিন্দা যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে পরিবেশকে নোংরা করে রাখে। তা ছাড়া সিটি করপোরেশন সড়কে কনটেইনারে রাত-দিন সব সময়ই ময়লা-আবর্জনা জমা করে রাখে। অনেক দিন সেখানে ময়লা জমে থাকলে তা পচে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয় এবং জন্ম নেয় নতুন মশা। যে কারণে মশার উৎপাত যেন নগরবাসীর নিয়মিত ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর মহাখালি গাউছুল আজম মসজিদসংলগ্ন গুলশান লেক ও এর আশপাশ এলাকার ডোবা ও ঝিলে কচুরিপানায় ভরে গেছে। এ যেন মশা উৎপাদনের কারখানা। লেক, ডোবা, ঝিল ও বিভিন্ন জলাশয়ের কচুরিপানা নিধন করে পরিষ্কার রাখার জন্য সিটি করপোরেশনের নিয়মিত বাজেট থাকলেও দীর্ঘ দিন ধরে সব জলাশয় পরিষ্কার করা হয় না। জানা গেছে, মশক নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর প্রতিটি মহল্লাভিত্তিক মশক নিধন কর্মী রয়েছে। দুই সিটি করপোরেশনে মশক নিধন কর্মী রয়েছে ৬৩৮ জন। উড়ন্ত মশা মারার যন্ত্র বা ফগার মেশিন রয়েছে প্রায় ৫০০টি। ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ে রয়েছে ১০ স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ প্রায় ১৫ কর্মকর্তা। পর্যাপ্ত বরাদ্দ, জনবল, সরঞ্জামাদি থাকার পরও মশক নিধনে পুরোপুরি ব্যর্থ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মাসুদ হাসান বলেন, মশা মারতে দুই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। লার্ভা নিধনে ব্যবহার করা হয় ‘লার্ভিসাইড’, আর উড়ন্ত মশা নিধনে ‘অ্যাডাল্টিসাইড’ ওষুধ ব্যবহার করা হয়। তবে মশক নিধন কর্মীদের কাছ থেকে ‘অ্যাডাল্টিসাইড’ ওষুধে কোনো কাজ হচ্ছে না বলে অভিযোগ আসছে। ‘লার্ভিসাইডে’ কিছুটা কাজ হচ্ছে। এখন মশক নিধন ওষুধ নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। উচ্চপর্যায়ের কোনো প্রতিষ্ঠানে এসব ওষুধ পরীার ব্যবস্থা করা হবে বলে তিনি জানান। ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো: আনছার আলী খান মশা নিধনে নিয়মিত ওষুধ স্প্রে করা ছাড়াও ক্রাশ প্রোগ্রাম চালানো হয়েছে জানিয়ে বলেন, শুধু সিটি করপোরেশন কার্যক্রম চালালেই মশা নিধন হবে না। মশার বংশ বিস্তার রোধে নিজ নিজ বাড়িঘরের আঙিনাসহ আশপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
No comments:
Post a Comment