তিন সরকারি কর্মকর্তা ঘুষ নিলেন। আর চার ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সেই ঘুষ এনে দিলেন রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকেরই দুই কর্মকর্তা। তবে বিষয়টি জানাজানি হলে দুই দিনের মাথায় ঘুষের ২৪ লাখ ২৮ হাজার টাকা ফেরতও দিতে হলো। এ ক্ষেত্রেও মধ্যস্থতা করলেন ঘুষ এনে দেওয়া সেই দুই ব্যাংকার। ঘুষ নিয়েছেন মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ের অধীন রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের তিন নিরীক্ষক, ঘুষ দিয়েছেন তৈরি পোশাকে
র নিট খাতের চার ব্যবসায়ী এবং মধ্যস্থতা করেন অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক পর্যায়ের দুই ব্যাংকার। আর ঘুষ নিয়ে ফেরত দেওয়ার এই পুরো চিত্র উঠে এসেছে রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের এক তদন্ত প্রতিবেদনে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০-১২ সময়ে রপ্তানিতে সরকারের নগদ সহায়তা নিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ কোর্ট রোড শাখার ওপর নিরীক্ষা করা হয় চলতি বছরের ২৪-২৮ ফেব্রুয়ারি। স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার (এঅ্যান্ডএও) মাহবুবুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন নিরীক্ষা দলের অপর দুই সদস্য ছিলেন আরেক এঅ্যান্ডএও বেলায়েত হোসেন খান এবং নিরীক্ষক সৈয়দ শরীফুল ইসলাম। নিরীক্ষায় দেখা যায়, যথাযথ নিয়ম অনুসরণ না করেই সরকারের কাছ থেকে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা নগদ সহায়তা নিয়েছে নিট পোশাক রপ্তানি–কারক প্রতিষ্ঠান মার্ক নিটওয়্যার ও নেকস ডিজাইন (একই মালিকানাধীন), নিট গার্ডেন, অলরাউন্ড নিটওয়্যার ও আরিয়ান নিটওয়্যার। এর পরই নিরীক্ষা দল অগ্রণী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক (বৈদেশিক বাণিজ্য) এম এ কাদির খানকে জানায়, রপ্তানিকারকেরা নিয়ম না মেনে নগদ সহায়তা নেওয়ায় সরকারকে অর্থ ফেরত দিতে হবে। তবে নিরীক্ষা দলকে ৫০ লাখ টাকা দিলে অর্থ যাতে ফেরত না দিতে হয়, সেটা তারা দেখবে। এরপর ২৭ ফেব্রুয়ারি এম এ কাদির খান মুঠোফোনে রপ্তানিকারকদের এ তথ্য জানান। ওই দিন বিকেলেই ব্যাংক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক গোপন বৈঠকে ঘুষের পরিমাণ নির্ধারিত হয় ৪২ লাখ টাকা। বৈঠকে নিরীক্ষা দলের তিন সদস্য, রপ্তানিকারক আরিয়ান নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হায়দার আলী ও এম এ কাদির খান উপস্থিত ছিলেন। ঘুষ দেওয়া: তদন্ত প্রতিবেদন মতে, রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে ঘুষ এনে দেওয়ার দায়িত্ব নেন কাদির খান। ৬-৮ মার্চ সময়ে নিরীক্ষা দলকে দেওয়ার জন্য তাঁর হাতে মার্কস নিটওয়্যার আট লাখ, নিট গার্ডেন সাত লাখ ২৮ হাজার, অলরাউন্ড নিট পাঁচ লাখ ৫০ হাজার এবং নেকস ডিজাইন তিন লাখ ৫০ হাজার অর্থাৎ ২৪ লাখ ২৮ হাজার টাকা তুলে দেয়। ৯ মার্চ ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) রুহুল আমীনের কক্ষে নিরীক্ষা দলের সদস্য বেলায়েত হোসেন খান ও সৈয়দ শরীফুল ইসলামের হাতে ঘুষের অর্থ দেন কাদির খান। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা এনে নিরীক্ষা দলকে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে গেলেন কেন—জানতে চাইলে প্রথমে না জানার কথা বলে এড়িয়ে যান কাদির খান। আবারও জানতে চাইলে গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রধান কার্যালয়ে চলে এসেছি। ঘটনার কিছুই মনে নেই। এ বিষয়ে ব্যবসায়ীরা ভালো বলতে পারবেন।’ তবে চাকরি বিধিমালা লঙ্ঘন করে ঘুষ লেনদেনে সহায়তা করার দায়ে গত ১২ মার্চ কাদির খানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিল অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এর পাঁচ মাস পরে তিনি প্রধান কার্যালয়ে যোগ দেন। জানতে চাইলে বেলায়েত হোসেন খান ও সৈয়দ শরীফুল—উভয়েই ঘুষ নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। দুজনেই প্রথম আলোকে বলেন, ঘুষ নেওয়ারই কোনো ঘটনা নেই, ফেরত দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। ঘুষ ফেরত: তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘুষ দেওয়ার পরদিন ১০ মার্চ চার ঘুষদাতার অন্যতম নিট গার্ডেনের চেয়ারম্যান এমরান ফারুক মঈন বিষয়টি বাংলাদেশ নিট পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেমকে জানান। মোহাম্মদ হাতেম ওই দিনই ব্যাংকে গিয়ে রুহুল আমীন ও কাদির খানকে চাপ দেন টাকা ফেরত আনার জন্য। এরপর কাদির খানকে সঙ্গে নিয়ে মোহাম্মদ হাতেম ওই দিন বিকেল সাড়ে চারটায় সৈয়দ শরীফুলের সঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের মতিঝিল ওয়াপদা শাখায় গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। সৈয়দ শরীফুল তখন ব্যাংকের ওই শাখা নিরীক্ষা করছিলেন। তাঁদের কাছে প্রথমে অস্বীকার করলেও সৈয়দ শরীফুল পরে স্বীকার করেন এবং টাকা ফেরত দেবেন বলে কথা দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১১ মার্চ সেগুনবাগিচা অডিট কমপ্লেক্সের পশ্চিম পাশের রাস্তায় অগ্রণী ব্যাংকের গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো ঘ ২-২৩৯৮) অপেক্ষা করেন ব্যাংকার কাদির খান ও রুহুল আমীন। কালো রঙের ব্যাগে করে ২৪ লাখ টাকা তাঁদের হাতে ফেরত দেন সৈয়দ শরীফুল। নারায়ণগঞ্জে ফিরে গিয়ে তাঁরা মোহাম্মদ হাতেম ও এমরান ফারুক মঈনের হাতে ওই টাকা তুলে দেন। যোগাযোগ করলে মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রপ্তানিকারকেরা অগ্রণী ব্যাংকের যে দুই কর্মকর্তার মাধ্যমে নিরীক্ষা দলকে ২৪ লাখ ২৮ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন, ওই দুই কর্মকর্তার মাধ্যমেই নিরীক্ষা দলের কাছ থেকে ২৪ লাখ টাকা এনে রপ্তানিকারকদের হাতে তুলে দিয়েছি।’ তদন্ত প্রতিবেদনে পুরো দলটির বিরুদ্ধেই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। গত এপ্রিলেই তদন্ত প্রতিবেদনটি দেওয়ার আট মাস পর, ৩ ডিসেম্বর সিএজি কার্যালয় অধিদপ্তরকে প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়। যোগাযোগ করলে সিএজি মাসুদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের হুট করে শাস্তি দেওয়া যায় না। অপরাধের ধরন অনুযায়ী ভর্ৎসনা ও অপসারণ করার নিয়ম রয়েছে। খতিয়ে দেখে স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর এখন পদক্ষেপ নেবে। স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাহতাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে শিগগিরই ব্যবস্থা নিচ্ছি আমরা।’ যোগাযোগ করলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক সিএজি এম হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো অবস্থাতেই ঘুষ নেওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়, নিরীক্ষার ক্ষেত্রে তো আরও নয়। জনগণের অর্থ লুটকারীদের ধরার দায়িত্ব যাঁদের ওপর, তাঁরা যদি ওই অর্থের ভাগীদার হতে চান, তাহলে আমি বলব সরষের মধ্যে ভূত ঢুকেছে।’ এই ভূত তাড়াতে নিরীক্ষা দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থা নয়, ফৌজদারি মামলা এবং ঘুষদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) পরামর্শ দেন তিনি।
No comments:
Post a Comment