দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৈষম্য কমিয়ে দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা বাড়াতে বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সইয়ের প্রস্তাব দিয়েছে চীন। এফটিএ সইয়ের জন্য চীন আলোচনা শুরুরও প্রস্তাব দিয়েছে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণে মিয়ানমার হয়ে চট্টগ্রাম থেকে কুনমিং পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রস্তাবে চীন ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। গতকাল রোববার বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত
্রী পর্যায়ের বৈঠকের পর পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। এদিকে, গতকাল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীন গতকালের বৈঠকে আবারও আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য নতুন জায়গা ঠিক করা হবে কি না সেটিও বিবেচনায় রয়েছে। প্রসঙ্গত, দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সরকার প্রাথমিকভাবে কক্সবাজারের সোনাদিয়াকে নির্বাচিত করে বিভিন্ন দেশের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সোনাদিয়ার পরিবর্তে পটুয়াখালীর পায়রাসহ একাধিক স্থানকে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের তালিকায় ভাবা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের সময় পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে তেলসমৃদ্ধ দেশটির বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানান। গতকাল সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ১৯-সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল এবং চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ১৩-সদস্যের চীন প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক তিন ঘণ্টার মতো স্থায়ী ছিল। আর এ আলোচনা মধ্যাহ্নভোজেও অব্যাহত ছিল। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের চার দশক পূর্তি উপলক্ষে দুই দেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের সফর বিনিময়সহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই তিন দিনের সফরে গত শনিবার দুপুরে ঢাকায় আসেন। পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক বলেন, এফটিএ সইয়ের জন্য আলোচনা শুরু করতে বৈঠকে চীন প্রস্তাব দিয়েছে। চীন মনে করে, এফটিএ সই হলে তাদের পক্ষে থাকা বিপুল বাণিজ্য বৈষম্য কমবে, যার সুফল পাবে বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান জানতে চাইলে শহীদুল হক বলেন, ‘চীনের সঙ্গে এফটিএ সই করলে লাভ-ক্ষতির ব্যাপারে আমরা এখনো অবস্থান ঠিক করতে পারিনি। এ ছাড়া এ বিষয়ে আলোচনা করব কি না সেটিও ঠিক করিনি।’ বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ এখন ১০ বিলিয়ন ডলার। যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মাহমুদ আলী মিয়ানমার হয়ে চট্টগ্রাম থেকে কুনমিং পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই প্রাথমিকভাবে সড়ক যোগাযোগের প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দেন। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রসচিব জানান, চট্টগ্রাম-কুনমিং যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে আলোচনার প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো উপস্থাপিত এ প্রস্তাবকে চীন স্বাগত জানিয়েছে। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে শিল্প খাতে সহযোগিতা, জ্বালানি, অবকাঠামো ও কৃষি খাতে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষায়িত শিল্পাঞ্চল (ইইজেড) নির্মাণে গভীর কৃতজ্ঞতা জানান চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব সাংবাদিকদের জানান, ইইজেডের ব্যাপারে আগামী বছর দৃশ্যমান অগ্রগতি হবে বলে চীন আশাবাদী। দেশটির অনেক প্রতিষ্ঠান ওই বিশেষায়িত শিল্পাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে বলে বৈঠকে চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। প্রতিরক্ষা খাতে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে বেশ জোরাদার। গতকালের বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব জানান, সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে আলোচনা না হলেও দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে দুই পক্ষ কথা বলেছে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ: চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই গতকাল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন বলে জানায় বাসস। বঙ্গভবনে সাক্ষাতের সময় রাষ্ট্রপতি দুই দেশের জনগণ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং ও চট্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি সড়ক ও রেলযোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সাক্ষাতের পর রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বাসসকে এ কথা জানান। বিকেলে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এ কে এম শামীম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। শেখ হাসিনা দেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের জন্য চীনা উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, চীনের উচিত বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগ করা। এ সময় চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের চাহিদায় তাঁর দেশ সব সময় পাশে থাকবে। বাংলাদেশকে ২০২১ সালে একটি মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত করতে চীন সব ধরনের সহযোগিতা দেবে।
No comments:
Post a Comment