ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এত দিন বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বলেছেন, বিএনপি আন্দোলনের দল নয়, তারা মাঠে নামবে না। কিন্তু গত বুধবার রাজধানীতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সত্যি
সত্যিই রাজপথে নামায় ভাবনায় পড়ে গেছে ক্ষমতাসীনরা। ওই দিন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরাকে কেন্দ্র করে ঢাকার বকশীবাজারে দলটির নেতা-কর্মীদের বড় ধরনের জমায়েতের ঘটনাকে রাজপথ দখলের মহড়া হিসেবে দেখছে ক্ষমতাসীনরা। এমন পরিস্থিতিতে তারা বিএনপিকে আর রাজপথে নামার কোনো সুযোগ দিতে চায় না। বিএনপির সম্ভাব্য আন্দোলন মোকাবিলায় রাজপথে শক্ত অবস্থান নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এ ব্যাপারে তাদের মনোভাব কঠোর বলে জানা গেছে। দলটির বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। দলীয় সূত্র জানায়, বুধবারের ঘটনার পর বিএনপিকে আর কোনো ছাড় না দিতে মনস্থির করেছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ৫ জানুয়ারি পূর্বঘোষিত ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ পালনের কর্মসূচির আগেই নতুন কর্মসূচি নিয়ে ঢাকা মহানগরে মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগ। তারা রাজপথে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে এক-দুই দিনের মধ্যেই কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে। গতকাল বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সভায় ৫ জানুয়ারির আগে ঢাকা মহানগরের চারটি স্থানে ও ঢাকার আশপাশে পাঁচ জেলায় কর্মী সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, দু-এক দিনের মধ্যেই এ কর্মসূচির তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করা হবে। আর ঢাকার বাইরে নেতা-কর্মীদের সক্রিয় রাখতে দলীয় সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ এলাকায় অবস্থানের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। ৫ জানুয়ারি সামনে রেখে বিএনপি জোট যেন দেশে ‘নাশকতা’ সৃষ্টি করতে না পারে সে বিষয়ে তাঁদের সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দলীয় সংসদ সদস্যদের ৫ জানুয়ারির আগে ও পরে নিজ এলাকায় থাকার নির্দেশ দেওয়া হবে। কারণ তাঁরা মাঠে থাকলে দলীয় নেতা-কর্মীরা চাঙ্গা থাকে। এ ছাড়া সংসদ সদস্যরা তৃণমূলে উপস্থিত থাকলে সেখানকার প্রশাসনের কাজের গতিও একটু বেশি থাকে।’ বিএনপি জোটের আন্দোলনের প্রসঙ্গে জাফর উল্যাহ বলেন, ‘বুধবার রাজধানীর বকশীবাজারে সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে বিএনপির উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে গেছে। তারা পরিকল্পিতভাবে সহিংসতা তৈরির চেষ্টা করছে। ৫ জানুয়ারির আগে ও পরে বিএনপি যদি আবারও এ ধরনের সহিংসতার চেষ্টা চালায়, তবে আমাদের নেতা-কর্মীরা তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই।’ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিভিন্ন সময় আমাদের সব সংসদ সদস্যকে নিজ নির্বাচনী এলাকায় থাকতে বলা হয়েছে। এলাকায় যার যা কাজ তা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ৫ জানুয়ারিতে সংসদ সদস্যরা বেশির ভাগই নিজ এলাকায় থাকবেন। তবে কারো ঢাকায় বিশেষ কাজ থাকলে তিনি হয়তো এলাকায় যাবেন না।’ আগামীকাল ২৭ ডিসেম্বর গাজীপুরে এবং ৩ ও ৫ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছে বিএনপি। এ সমাবেশের অনুমতি না পেলে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার হুমকি দিয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। এদিকে গাজীপুরে বিএনপি যে স্থানে সমাবেশ করতে চায়, একই স্থানে একই দিনে সমাবেশ ডেকেছে ছাত্রলীগ। আর ৫ জানুয়ারিতে রাজধানীতে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গতকাল রাজধানীর ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ জানিয়েছেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ৫ জানুয়ারি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগকে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির সমাবেশের অনুমতির বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি প্রশাসন। ২৭ ডিসেম্বর গাজীপুরে বিএনপির সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী পরশু (কাল শনিবার) গাজীপুরে বিএনপি যেখানে সমাবেশ করতে চায় সেখানে ছাত্রলীগ সমাবেশ ডেকেছে। দুটি সংগঠন একই স্থানে সমাবেশ ডাকায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আমরা এখনো চিন্তাভাবনা করছি।’ ৩ ও ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে বিএনপির সমাবেশের অনুমতির বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি বরাবরই নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করে থাকে। সে জন্য জনগণের জানমালের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে বিএনপির সমাবেশের অনুমতি দেওয়া যায় কি না তা নিয়ে আমরা ভাবছি।’ আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রভাবশালী মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বুধবার পরিকল্পিতভাবে বিএনপি যে সহিংসতার চেষ্টা চালিয়েছে এরপর আর তাদের কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। রাজপথে বিএনপিকে মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এখন থেকে কঠোর ভূমিকায় থাকবে।’ রাজধানীতে বিএনপির সমাবেশের অনুমতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মামলার হাজিরার দিনে বিএনপি নেতা-কর্মীরা একজন সংসদ সদস্যের গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। এতে তাদের পরিকল্পনা ও মনোভাব বোঝা যাচ্ছে। এমন অবস্থায় তাদের সমাবেশ করতে দেওয়া হবে বোকামি।’ দলীয় সূত্র জানায়, ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ঘোষিত গণতন্ত্রের বিজয় দিবস সফল করতে রাজধানীতে জোরালো তৎপরতা শুরু করেছে দলটি। কর্মসূচি সফল করতে ৫ জানুয়ারির আগে প্রস্তুতি হিসেবে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন অংশে চারটি বর্ধিত সভা করবে তারা। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা জেলায় বর্ধিত সভা হবে। গতকাল রাজধানীর ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাজধানীর রাজপথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তৎপর রয়েছে আওয়ামী লীগ। তারা এ মাসে কয়েক দফায় সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কমিটি এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও ঢাকার সংসদ সদস্যদের সঙ্গে যৌথসভা করেছে। দলীয় সূত্র জানায়, এসব সভায় ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্রের বিজয় দিবস ও ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে বিভিন্ন কর্মসূচি সফলভাবে পালনে নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। কর্মসূচি সফল করতে ঢাকার সংসদ সদস্যদের বিশেষভাবে তৎপর থাকারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। বিএনপির মাঠে নামার চেষ্টা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। গতকাল রাজধানীতে এক সমাবেশে মায়া বলেন, ‘এখন সময় এসেছে জবাব দেওয়ার। আর চুপ করে বসে থাকলে হবে না। রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনেছি, ক্ষমতায় এসেছি। রক্তের বিনিময়ে খালেদা-তারেককে সমুচিত জবাব দিতে চাই। তাঁদের কতটুকু জোর-ক্ষমতা আমরা দেখতে চাই।’ মায়া আরো বলেন, ‘আমরা বলি ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র রক্ষা দিবস। আর তারা নাকি ওই দিন ঢাকা শহর দখল করবে। পরিষ্কার ঘোষণা দিয়ে বলতে চাই, এই ঢাকা মুক্তিযোদ্ধা ও শান্তিকামী মানুষের শহর। এখানে আল-বদর আর রাজাকারদের কোনো স্থান নেই। যারা এদের রক্ষা করে, তাদের ঢাকা শহরে দাঁড়াতে দেওয়া হবে না।’ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গতকাল এ আলোচনা সভা আয়োজন করে জয় বাংলা মুক্তিযোদ্ধা লীগ।
No comments:
Post a Comment