দুটি কক্ষে গাদাগাদি করে ছয়টি বিছানা পাতা। বাকি কক্ষটিতে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারকক্ষের পাশের বাথরুমটিতে ওষুধ, পোশাক আর চিকিৎসার নানা জিনিস রাখা। বসার কক্ষ আর খাওয়ার জায়গা কাচ দিয়ে ভাগ করে এক পাশে একটি বিছানা বসিয়ে ‘কেবিন’ বানানো হয়েছে, অন্য পাশে অফিস কক্ষ। বাসাবাড়িতে এভাবে চলছিল ‘শাহজালাল জেনারেল হাসপাতাল’। গতকাল শনিবার সকালে র্যাব-২-এর ভ্রাম্যমাণ আদালত রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁওয়ের
বিএনপি বস্তিসংলগ্ন একটি পাঁচতলা ভবনের নিচতলার এ হাসপাতালে অভিযান চালানোর পর বন্ধ করে দেন। আদালত বলেছেন, ভুয়া চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ান এই হাসপাতাল চালাচ্ছিলেন। হাসপাতালের সরকারি অনুমোদনের মেয়াদও শেষ হয়ে গিয়েছিল। আদালত তাৎক্ষণিকভাবে ছয়জনকে দুই বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও ছয় লাখ টাকা জরিমানা করেন। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০১২ সালে এই হাসপাতালের অনুমোদন দিয়েছিল। আদালত পরিচালনাকারী র্যা বের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ এম আনোয়ার পাশা প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালের মালিক সুজন দাস। সুজন একসময় চুল কাটার দোকানে কাজ করতেন। অভিযান পরিচালনার সময় ঘটনাস্থলে প্রথম আলোর প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। অন্য কোনো সূত্র থেকে সুজন দাসের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সুজন প্রথম আলোকে বলেন, কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসে ছয় বছর বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেছেন। এরপর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে একটি হাসপাতাল খুলে বসেন। ২০১২ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ১০ শয্যার এই হাসপাতালের অনুমোদন নিয়ে আগারগাঁওয়ে চলে আসেন। হাসপাতাল ঘুরে যা চোখে পড়েছে তার তালিকাটি এ রকম: একটি পুরোনো এক্স-রে মেশিন, আটটি বিছানা, চারটি ছোট ড্রয়ার, বারান্দায় এক সেট সোফা, অফিস কক্ষে একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার, অস্ত্রোপচারকক্ষে একটি বিছানা, অস্ত্রোপচারের বাতি, অক্সিজেন সিলিন্ডার আর কিছু ছুরি-কাঁচি ও অ্যাপ্রোন। এক্স-রের জন্য আলাদা কক্ষ নেই। হাসপাতালে গতকাল দুজন ভর্তি রোগী ছিলেন। এ ছাড়া দুজন রোগী গতকাল সকালে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। সুজন দাস বলেন, হাসপাতালের সার্বক্ষণিক বা নিজস্ব চিকিৎসক নেই। অস্ত্রোপচার করতে চিকিৎসক ভাড়া করে আনা হয়। রোগীকে অজ্ঞান করা থেকে শুরু করে বাকি সবকিছুই করেন তিনি নিজে ও তাঁর কর্মীরা। মাসুম নামের কর্মী অস্ত্রোপচার-পরবর্তী চিকিৎসা দেন। কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, চলতি বছর জুনে সরকারি অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হয়েছে। অভিযান চলার সময় ঘটনাস্থলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (হাসপাতাল) স্বপন কুমার তপাদার উপস্থিত ছিলেন। ‘এরা কী করে সরকারি অনুমোদন পেয়েছিল’ এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বপন বলেন, ‘২০১২ সালে আমি দায়িত্বে ছিলাম না। আমার পক্ষে বলা সম্ভব না।’ হাসপাতালের সাইনবোর্ডে নাসির উদ্দীন, সাখাওয়াত হোসেন খান ও মোফাজ্জল হোসেন নামে তিন চিকিৎসকের নাম রয়েছে। এঁরা ভাড়ায় অস্ত্রোপচার করেন। মুঠোফোনে বারবার চেষ্টা করেও এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অসহায় রোগীরা: অন্ধকার একটি কক্ষে গায়ে গা লাগিয়ে তিনটি বিছানা পাতা। একটিতে বাঁ পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় শুয়ে আছেন ফরিদপুরের মিলন মোল্লা। এক বছর আগে নছিমন দুর্ঘটনায় বাঁ পায়ের হাড় ভেঙে যায়। ঢাকায় এসে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসা নেন। চিকিৎসা শেষে তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু হাড় জোড়া লাগেনি। এরপর পাঁচ দফা ঢাকায় এসে পঙ্গু হাসপাতালে চেষ্টা করেও ভর্তি হতে পারেননি। সর্বশেষ গত নভেম্বরের মাঝামাঝি পঙ্গু হাসপাতালে আসার পর এক দালাল তাঁকে আগারগাঁওয়ের ওই হাসপাতালে আনেন। মিলনকে পরীক্ষা করে হাসপাতালের মালিক সুজন বলেছিলেন, ৩০-৩৫ হাজার টাকা ব্যয় করলে সাত দিনেই পা ভালো হয়ে যাবে। ভর্তি হন মিলন। বাইরের একজন চিকিৎসক মিলনের পায়ের অস্ত্রোপচার করেন। এরপর গত ১৫ দিনে ওই চিকিৎসককে দেখেননি মিলন। এখন তাঁর পায়ে সংক্রমণ হয়েছে, মাংসে পচন ধরেছে। কর্তৃপক্ষ কোনো চিকিৎসককে ডাকেনি। মাসুমই চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে মিলনের ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। এই হাসপাতালের আরেক শিকার বাড্ডার সবজিবিক্রেতা জয়নাল আবেদিন। ২০১২ সালে তাঁর পা পুড়ে যাওয়ার পর থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু পা ভালো হয়নি। পা-কোমরে ব্যথা নিয়ে ক্রাচে ভর দিয়ে গতকাল এসেছিলেন হাসপাতালে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁর কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা নিয়ে অন্য আরেকটি হাসপাতালে যেতে বলে। পকেটে টাকা না থাকায় জয়নাল হাসপাতালের সোফাতেই বসে ছিলেন। এ অবস্থায়ই র্যা বের ভ্রাম্যমাণ আদালত সেখানে হাজির হন। এ অভিযান পরিচালনা করেন মেজর নাসির উদ্দিন আহমেদ।
No comments:
Post a Comment