Sunday, March 29, 2015

ক্ষমতা থাকলেও কিছুই করছে না কমিশন:প্রথম অালো

ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘সবার জন্য সমান সুযোগ’ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) সব প্রার্থীর জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হচ্ছে না। সরকার-সমর্থিত প্রার্থীরা যেভাবে এ সুযোগ পাবেন, বিরোধী জোটের প্রার্থীরা সেভাবে পাচ্ছেন না। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকাণ্ডে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও একজন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ
প্রথম আলোকে বলেন, আইন নির্বাচন কমিশনকে অনেক ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু তফসিল ঘোষণার ১২ দিনেও ‘সবার জন্য সমান সুযোগ’ তৈরিতে কমিশনকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। এমনকি বিরোধীপক্ষকে এ ব্যাপারে মৌখিকভাবেও আশ্বস্ত করা হয়নি। আন্দোলনরত জোটের অসংখ্য নেতা-কর্মী মামলা ও গ্রেপ্তার-আতঙ্কের কারণে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, অনেকে কারাবন্দী। তাঁরা নির্বাচনে প্রার্থী হলে কিংবা প্রার্থীদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে চাইলে কমিশন তাঁদের জন্য সেই সুযোগ তৈরি করে দেবে কি না, কিছুই বলছে না। ইতিমধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, প্রার্থীদের মধ্যে কারও বিরুদ্ধে মামলা থাকলে তিনি প্রকাশ্যে আসামাত্র তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। তবে কেউ আদালত থেকে জামিন নিয়ে এলে গ্রেপ্তার করা হবে না। এ বক্তব্যে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাঁরা এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ চাইছেন। কিন্তু কমিশন তাঁদের হতাশ করেছে। জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য যা যা করণীয়, তার সবই করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছে সংবিধান। সেই দিক থেকে বিরোধী জোটের নেতাদের যাতে হয়রানি করা না হয়, সে বিষয়ে ইসি ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু তারা সেই ভূমিকা রাখছে না। একই সঙ্গে নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য সরকারকেও আন্তরিক হতে হবে। নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০-দলীয় জোটের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা বরং কমিশনকে খানিকটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। কমিশন ধরে নিয়েছিল বিরোধী জোট নির্বাচনে আসবে না। কমিশন সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারও কারও মতে, সরকারপক্ষের মামলা-হামলায় বর্তমানে বিএনপি-জামায়াত জোট বিধ্বস্ত অবস্থায় আছে। এই কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল, স্বল্প সময়ের মধ্যে বিরোধীপক্ষ মাঠ গোছানোর সুযোগ পাবে না। তাই তারা নির্বাচনেও আসবে না। কমিশন সচিবালয় বলছে, ঢাকার দুই সিটিতে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১ হাজার ৯৬০টি। প্রতিটি কেন্দ্রে গড়ে ২৩ জন করে বাহিনী মোতায়েন করা হলে ৪৫ হাজারের বেশি বাহিনী লাগবে। এ ছাড়া র্যাব ও বিজিবির ভ্রাম্যমাণ বাহিনী মিলিয়ে মোতায়েন করা বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। তফসিল অনুযায়ী, আজ ২৯ মার্চ মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন আগামী ৯ এপ্রিল। ভোট গ্রহণ ২৮ এপ্রিল। ঢাকা উত্তর সিটিতে মেয়র পদে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। মিন্টুর নামে মামলা থাকায় তিনি প্রকাশ্যে আসছেন না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি থেকে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, অর্থবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন ও মহানগর নেতা আবুল বাশার। মামলা থাকায় তাঁরাও আত্মগোপনে। মনোনয়নপত্র সংগ্রহকারী নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টু ও শিক্ষকনেতা সেলিম ভূঁইয়া এখন কারাবন্দী। বিএনপির নেতারা বলছেন, মেয়র ও কাউন্সিলর পদে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকেই কারাগারে আটক আছেন। মামলা থাকায় গা-ঢাকা দিয়েছেন অনেকেই। মামলা না থাকলেও মামলা-হামলার ভয়ে গা-ঢাকা দিয়ে আছেন অনেক সম্ভাব্য প্রার্থী এবং অসংখ্য নেতা-কর্মী। এসব নেতা-কর্মী যাতে হয়রানির শিকার না হন, সে জন্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বিএনপিপন্থী শত নাগরিক জাতীয় কমিটির একটি প্রতিনিধিদল গত বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বৈঠক করে। কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, বৈঠকের আগে কমিশন ধরে নিয়েছিল, প্রতিনিধিদলটি ভোট গ্রহণের তারিখ পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানাবে। সে ক্ষেত্রে তারা দাবি নাকচ করবে। কিন্তু কমিশনকে বিস্মিত করে নাগরিক কমিটি শুধু মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় দু-তিন দিন পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানায়। এ ছাড়া তারা বিএনপি নেতাদের মধ্যে কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে তাঁকে জামিনে মুক্তি দেওয়া, যাঁরা আত্মগোপনে আছেন, তাঁরা যাতে প্রকাশ্যে এসে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারেন, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ইসির কাছে দাবি জানায়। সিইসি অবশ্য প্রতিনিধিদলকে হতাশ করেছেন। অন্য কমিশনারদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করে ওই দিনই সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় বাড়ানো যাবে না। পুলিশের ভয়ে যাঁরা পালিয়ে আছেন, তাঁদের ব্যাপারে কমিশন কী ব্যবস্থা নেবে, জানতে চাইলে সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ বিষয়ে তো আমি আশ্বস্ত করতে পারি না। কেউ পালিয়ে থাকলে তাঁকে কীভাবে খুঁজে বের করব?’ এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক প্রথম আলোকে বলেন, কারও বিরুদ্ধে মামলা থাকলে পুলিশ গ্রেপ্তার করবে। কারাগারে আটক কেউ প্রার্থী হলে তাঁকে জামিন দেওয়ার এখতিয়ার আদালতের। এসব ক্ষেত্রে কমিশনের কিছু করার নেই। তবে কারও বিরুদ্ধে মামলা না থাকা সত্ত্বেও পুলিশ যদি তাঁকে হয়রানি করে, তাহলে কমিশন অবশ্যই ভূমিকা রাখবে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য প্রার্থী ও নেতা-কর্মীরা যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন এবং পুলিশ যাতে তাঁদের হয়রানি না করে, সে বিষয়ে ভূমিকা রাখার সুযোগ সংবিধান কমিশনকে দিয়েছে। আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাশেমের মামলার রায়ে (ডিএলআর-৪৫, ১৯৯৩) হাইকোর্ট বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের অগাধ ক্ষমতা রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তারা বিধি-বিধানের সঙ্গে নতুন সংযোজনও করতে পারবে। তবে কমিশন এখন পর্যন্ত সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করেনি। জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মনোনয়নপত্র জমার তারিখ পেছানোর দাবিটি কমিশন মেনে নিতে পারত। পুলিশ বিএনপির প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের যাতে হয়রানি না করে এবং পুলিশ কর্মকর্তারা নির্বাচনকে প্রভাবিত করার মতো যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, সে বিষয়ে কমিশন ভূমিকা রাখতে পারত। কারণ, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ব্যাপক। সেটা করলে কমিশনের প্রতি তাদের আস্থা বাড়ত। তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, বিএনপির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সিইসির একা বসা এবং এককভাবে সিদ্ধান্ত জানানো উচিত হয়নি। কারণ, তাঁর ভুল হলে দায় কিন্তু পুরো কমিশনকে বহন করতে হবে। জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যে দাবিটুকু করেছিলাম, সেটা পূরণ করা কঠিন ছিল না। এটা ঠিক, যাঁরা কারাগারে আটক আছেন তাঁদের ব্যাপারে কমিশনের কিছুই করার নেই। কিন্তু যাঁদের নামে মামলা আছে বা যাঁরা ভয়ে পালিয়ে আছেন, তাঁদের যাতে পুলিশ হয়রানি না করে, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষমতা কমিশনের আছে।’ মাহবুব হোসেন বলেন, ‘তবু বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশ নেবে। তখন পুলিশ যদি প্রার্থী-সমর্থকদের গণহারে আটক করে, সেই দায় সরকার ও কমিশনকে নিতে হবে। আমরা শেষ পর্যন্ত দেখতে চাই, দেশবাসীকে দেখাতে চাই, সরকার ও কমিশন কতটা নগ্ন হতে পারে।’

No comments:

Post a Comment