চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় সমর্থন পেতে মেয়র প্রার্থীদের ২০ লাখ থেকে ৭ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়েছে বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে করা ‘ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০১৫: প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক গবেষণায় এই তথ্য এসেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, মেয়র প্রার্থীদের দেওয়া ওই অর্থ সরকারের বিভিন
্ন সংস্থা, দলীয় তহবিল এবং ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক নেতা-উপদেষ্টার পকেটে গেছে। প্রার্থী নিজে ছাড়াও এই অর্থের একটা অংশ বহন করেছেন স্থানীয় কিছু ঠিকাদার, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। গতকাল সোমবার ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ সময় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এ টি এম শামসুল হুদা ও টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। গবেষণা অনুসারে, চট্টগ্রামে সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীদের একাংশও দলীয় মনোনয়ন পেতে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থীদের একাংশ দিয়েছেন ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের মেয়র প্রার্থীদের মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের অর্থ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে ঢাকার দুই সিটির সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের কেউ কেউ দলীয় সমর্থন পেতে ১ থেকে ৮ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের অনেকে টাকা দিলেও পরিমাণ জানা যায়নি। তথ্য দিতে ইচ্ছুক মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী, নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রার্থীদের এজেন্ট, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যসহ ৮৭২ জনের দেওয়া তথ্য সংযোজন করে এই গবেষণাটি তৈরি করা হয়েছে। তিন সিটি করপোরেশনের ১৩৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৮টি ওয়ার্ডকে দ্বৈবচয়ন পদ্ধতিতে নমুনা এলাকা নির্ধারণ করা হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি-সমর্থিত নয়জন মেয়র প্রার্থীর ওপর গবেষণা পরিচালনা করা হয়। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ১০১ জন সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীর সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-সমর্থিত। গবেষণাকাল ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত। গবেষণা প্রতিবেদনের সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে টিআইবি বলেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। এর জন্য নির্বাচন কমিশন দায়ী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও ব্যর্থতা আছে। অবশ্য জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছিরের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এই অভিযোগ আনা হয়েছে। নাছিরের সমর্থনের বিষয়টি এসেছে দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। সেখানে রাজনৈতিক বিবেচনায়ই মুখ্য ছিল। বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলমের নির্বাচন সমন্বয়কারী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘মনজুর বিএনপির সমর্থন পাবেন—এটা তো তিনি জানতেনই না। কাকে, কেন টাকা দেবেন? তাঁদের প্রার্থীকে প্রচারণার ক্ষেত্রে এতই কোণঠাসা করে রেখেছিল যে ব্যয় করার সুযোগই পাননি।’ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, তিন সিটির নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে দোদুল্যমানতা, আচরণবিধি লঙ্ঘনের বেলায় সমানভাবে পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতা, ভোট জালিয়াতি, কারচুপি এবং কেন্দ্র দখল করে সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীনভাবে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংসদ সদস্যদের প্রভাব বিস্তারের কারণে সামগ্রিকভাবে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলা যায় না। আর বিএনপি মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনতার মনোভাব এসেছে গবেষণায়। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যোগ্যতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সক্ষম ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়ার, নির্বাচনী আইন পরিবর্তন ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার সুপারিশ করে টিআইবি। বাড়তি ব্যয়: গবেষণায় এসেছে, তিন সিটিতে তিন বড় দল সমর্থিত নয়জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে আটজনই নির্বাচন কমিশন অনুমোদিত ব্যয়সীমা অতিক্রম করেছেন। ঢাকা উত্তরের কেবল একজন মেয়র প্রার্থী নির্ধারিত ব্যয়সীমার মধ্যে ছিলেন। ঢাকা উত্তরে মেয়র প্রার্থীদের নির্ধারিত ব্যয়সীমা ছিল ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু একজন প্রার্থী ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা খরচ করেছেন। তিন প্রার্থী গড়ে ব্যয় করেন ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা করে। ঢাকা দক্ষিণে অনুমোদিত ব্যয়সীমা ছিল ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু প্রার্থীরা গড়ে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয় করেন। এর মধ্যে এক প্রার্থী একাই ব্যয় করেন ৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা। অন্যদিকে চট্টগ্রামে ব্যয়সীমা ছিল ৩০ লাখ টাকা। গড়ে প্রার্থীরা ব্যয় করেন ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। একজন ব্যয় করেন ৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। তিন সিটিতেই আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা বেশি ব্যয় করেছেন। ইসি শক্তিশালী করা জরুরি: সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, নির্বাচনটি ভালো হয়নি। পুরো দায় নির্বাচন কমিশনের। কারণ, আইনে সব ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া আছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন কীভাবে হওয়া উচিত—এমন এক প্রশ্নের জবাবে শামসুল হুদা বলেন, ‘মনে হয় না সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনবে। এখন সবার যেটা দাবি করা উচিত তা হলো শক্ত, নিরপেক্ষ ও সুযোগ্য একটা নির্বাচন কমিশন। এর সঙ্গে কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনেও ভালো নির্বাচন করা সম্ভব। তবে বিচার বিভাগ, সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রকে সঠিকভাবে কাজ করতে হবে।’ ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অনেক উপাদান অনুপস্থিত ছিল তিন সিটির নির্বাচনে। এটা সত্যিকার অর্থে সুষ্ঠু ও সঠিক হয়নি। তবে বিএনপির আগেভাগে নির্বাচন বর্জন ঠিক হয়নি। নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে নির্বাচন কমিশনও নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
No comments:
Post a Comment