একটি রাস্তা অংশে অংশে ভাগ করে বিভিন্ন সময়ে ছয়জন প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে মেরামত করানো হয়েছিল। কাজ শেষে দেখা গেল, কোথাও পিচ উঠে যাচ্ছে, কোথাও দেবে যাচ্ছে; গাড়ি নির্বিঘ্নে চলতে পারছে না। মানসম্মত কাজ হয়নি- এ অভিযোগ ওঠে প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে। প্রায় দেড় বছর আগে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গঠিত কমিটি তদন্তে নেমে দেখতে পায়, সত্যি সত্যি নিম্নমানের কাজ হয়েছে। ওই রাস্তায় আবার মেরামতের কাজ করাতে হ
য়েছে। এতে সরকারের প্রায় ১৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা উল্লেখের পাশাপাশি দ্বিতীয়বার কাজ করানোয় সরকারের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। পরে ওই প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অন্য কোনো শাস্তি কেন দেওয়া হবে না জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়া হয় তাঁদের। তবে শেষ পর্যন্ত শাস্তি না দিয়ে শুধু সতর্ক করে তাঁদের মামলা থেকে রেহাই দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে অব্যাহতির প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে গত ১১ মে। রেহাই পাওয়া প্রকৌশলীরা হলেন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফজলে রব্বে (পিরোজপুর), নির্বাহী প্রকৌশলী উৎপল সামন্ত (মৌলভীবাজার), নির্বাহী প্রকৌশলী ডি এ কে এম নাহীন রেজা (বাগেরহাট), নির্বাহী প্রকৌশলী মুহ. অলিউল হোসেন (খুলনা), প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ মোহাম্মদ শফিকুল আলম ও উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (সাময়িকভাবে বরখাস্ত) এস এম কামরুজ্জামান। অভিযুক্তরা গাজীপুর সড়ক বিভাগে থাকার সময় জয়দেবপুর-মির্জাপুর-টাঙ্গাইল-জামালপুর সড়কের মেরামতের কাজ করিয়েছিলেন। এ ছাড়া ঢাকা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আতাউর রহমানকে গত ১৭ মে তথ্য লুকিয়ে সনদপত্র দেওয়ার অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়া হয়। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অনিয়ম-দুর্নীতি কমানোর উদ্যোগ নিলেও অভিযুক্ত প্রকৌশলীরা আমলাদের সহযোগিতায় রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন। এ মন্ত্রণালয়ের অভিযুক্তরাও বিভাগীয় মামলা থেকে রেহাই পাচ্ছেন তদবির করে। বর্তমানে মন্ত্রণালয়ে ২০টি বিভাগীয় মামলা রয়েছে। অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অভিযুক্তদের যুক্তি গ্রহণযোগ্য মনে হওয়ায় তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে অপরাধের জন্য বহু প্রকৌশলীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে, শাস্তিও দেওয়া হয়েছে।' সওজ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, বিভাগীয় মামলায় অভিযুক্তদের শুধু অব্যাহতিই দেওয়া হয়নি, পদোন্নতিও দেওয়া হয়েছে। শাস্তির বদলে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ওই ছয় প্রকৌশলীর মধ্যে একাধিক জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে; ভালো জায়গায় পদায়ন করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে আত্মস্বীকৃত (ট্রুথ কমিশনে স্বীকারোক্তিদাতা) দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী মো. শাহাবুদ্দিনকে পর পর চারটি বিভাগীয় মামলা থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ থাকার পরও প্রধান প্রকৌশলী পদ দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। বর্তমানে সওজ অধিদপ্তরে আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী রয়েছেন সাতজন। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মো. ফজলে রব্বে গাজীপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী থাকার সময় ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে জয়দেবপুর-মির্জাপুর-টাঙ্গাইল-জামালপুর সড়কে প্রায় এক কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে মেরামতকাজ করান। মান বজায় রেখে কাজ করা হয়নি- এ অভিযোগ উঠলে ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি ফজলে রব্বেকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন দেয়। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫-এর বিধি ২(এফ) ও বিধি ৩(ডি) অনুসারে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে গত ১১ মে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। উৎপল সামন্ত গাজীপুর সড়ক বিভাগে কর্মরত থাকাবস্থায় ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে একই সড়কে তিন কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে মেরামতকাজ করান। এ ক্ষেত্রেও মানসম্পন্ন কাজ না হওয়ার অভিযোগের সত্যতা পায় ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গঠিত তদন্ত কমিটি। বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। তাঁকেও ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ডি এ কে এম নাহীন রেজা টঙ্গী সড়ক উপবিভাগে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় ২০১০-১১ থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে একই সড়কে এক কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে মেরামতকাজ করান। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, মান বজায় রেখে কাজ হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধেও বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। তাঁকেও ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে দিয়ে অব্যাহতি দেওয়া হয়। একই সড়কে ২০১১-১২ অর্থবছরে তিন কোটি ৪১ লাখ টাকার কাজের তত্ত্বাবধান করিয়েছিলেন শেখ মোহাম্মদ শফিকুল আলম। ওই সময় তিনি গাজীপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন। মান বজায় না রেখে কাজ করানোর অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। তদন্ত কমিটি অভিযোগের প্রমাণ পেলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। তাঁকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে ভবিষ্যতের জন্য সতর্কবাণী উচ্চারণ করে। এস এম কামরুজ্জামান টঙ্গী সড়ক উপবিভাগে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী থাকাবস্থায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে একই সড়কে এক কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে কাজ করান। ওই কাজও মানসম্মত ছিল না। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে গঠিত তদন্ত কমিটি কাজের গুণগত মান বজায় না রাখার অভিযোগের প্রমাণ পায়। তাঁর বিরুদ্ধেও বিভাগীয় মামলা হয়। ভবিষ্যতের জন্য সতর্কবাণী শুনে তিনিও অব্যাহতি পেয়েছেন। মুহ. অলিউল হোসেন গাজীপুর সড়ক উপবিভাগে কর্মরত অবস্থায় ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে একই সড়কে চার কোটি ৬৫ লাখ টাকার কাজ করান। তদন্ত প্রতিবেদনে একই কমিটি মন্ত্রণালয়কে জানায়, কাজের মান রক্ষা করা হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। তাঁকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে দিয়ে। আরো একজনকে অব্যাহতি : উপর্যুক্ত ছয় প্রকৌশলী ছাড়াও ঢাকা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আতাউর রহমানকে গত ১৭ মে তথ্য লুকিয়ে সনদপত্র দেওয়ার অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে। সনদপত্রে বলা হয়েছিল, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রিচি এন্টারপ্রাইজ রাস্তার কাজ শেষ করেছে। প্রকৃতপক্ষে উল্লিখিত সময়ে ওই প্রতিষ্ঠান কাজ শেষ করেনি।
No comments:
Post a Comment