Saturday, May 9, 2015

তারেকের সবুজ সংকেত:যুগান্তর

জামায়াতকে নিয়ে দিন দিন অস্বস্তি বাড়ছে বিএনপিতে। দলটির বেশির ভাগ নেতাকর্মী মনে করেন, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বলে পরিচিত এই দলটিকে জোটে রাখা না রাখার ব্যাপারে এ মুহূর্তে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। বিশেষ করে টানা তিন মাসের অবরোধে নাশকতা ও সহিংসতার ঘটনায় বিএনপির যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে, তার জন্য জামায়াত-শিবিরকেই দায়ী করছেন তারা। সর্বশেষ তিন সিটি নির্বাচনে জামায়াতের অসহযোগিতামূলক আচরণের পর তাদের সঙ্গে
সম্পর্কচ্ছেদের বিষয়টি বিএনপির ভেতরে আরও জোরালো হয়েছে। এমনকি এ ব্যাপারে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মনোভাবও ইতিবাচক। জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে তিনি এক ধরনের ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন বলেও দাবি করেছেন তার ঘনিষ্ঠ সূত্র। কিন্তু কৌশলগত কারণে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগে এ মুহূর্তে ‘ধীরে চলো নীতি’ অনুসরণ করছে দলটির হাইকমান্ড। তবে জামায়াতকে যদি সরকার নিষিদ্ধ করে, সেক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গেই তাদের সঙ্গ ত্যাগ করবে বিএনপি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার (অব.) আসম হান্নান শাহ শুক্রবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, সরকার যদি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে; সেক্ষেত্রে বিএনপি কোনো নিষিদ্ধ ঘোষিত দল বা সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। অতীতেও নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার নজির বিএনপির নেই। এ মুহূর্তেই জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে দলের প্রায় সব স্তরের নেতাদের মনোভাব ইতিবাচক। কিন্তু হাইকমান্ডের নেতিবাচক মনোভাবে দলের নীতিনির্ধারকদের কেউ নাম প্রকাশ করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। কারণ এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে জামায়াতের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করলে সংশ্লিষ্ট নেতা দলের হাইকমান্ডের বিরাগভাজন হতে পারেন। এমন নজির অতীতে রয়েছে। জানা গেছে, বিগত চারদলীয় জোট গঠনের সময়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার কারণেই ওই সময়ের দলের মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক সম্পাদক কবির হোসেনকে গুরুত্বহীন করে ফেলা হয়। যার কারণে ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের মন্ত্রিসভায় তার ঠাঁই হয়নি। তার কনিষ্ঠ অনেক নেতাই মন্ত্রী হয়েছেন। অথচ কবির হোসেন ’৯১ সালের বিএনপি সরকারের ভূমি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এদিকে হাইকমান্ডের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ মুহূর্তেই জামায়াতকে ছেড়ে দেয়া হলে সরকার ভিন্ন কৌশলে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে পারে। জামায়াত-শিবিরকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে আরও কোণঠাসা করা হতে পারে। যেমনটি করা হয়েছিল ’৯৬ সালে। তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতও নেমেছিল। এমন আশংকা থেকেই দলের ভেতর-বাইরে এত সমালোচনার পরও কৌশলগত কারণে এখনই জামায়াতের সঙ্গ ছাড়া যাচ্ছে না। এ বিষয়টি দলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বিদেশী কূটনীতিকদের কাছেও তুলে ধরা হয়েছে। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা এবং তাদের নেতিবাচক কার্যকলাপ দেশে এবং দেশের বাইরে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে জামায়াত। তাদের জোটে রাখায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বিএনপিও। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে আহ্বান জানিয়েছে একাধিকবার। খোদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা একই কথা বলেছেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে এক শুনানিতে জামায়াতের ব্যাপারে কঠোর মন্তব্য করা হয়েছে। বিশ্ব জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে দলটির যোগাযোগ রয়েছে বলে শুনানিতে জানানো হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্বাধীনতাবিরোধী এই দলটিকে ২০ দলীয় জোট থেকে বের করে দিতে বিএনপির ওপর নানামুখী চাপ বাড়ছে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা। দলীয় সূত্র জানায়, মুক্তিযোদ্ধার হাতে গড়া দলটি জামায়াতের সঙ্গে জোট করায় সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নানা সমালোচনার মুখে পড়েছে। দেশের প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হয়েও জামায়াত থাকার কারণে বিপদে-আপদে তাদের পাশে পাচ্ছে না দলটি। সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে জামায়াতে জোটে রাখা কতটা লাভ বা ক্ষতি সে বিষয়ে এখনি কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষে বিএনপির কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন সময়ে দলীয় ফোরামে জামায়াতকে জোট থেকে বের করে দেয়ার পরামর্শ দিলেও তাতে সাড়া দেয়নি দলটির কেন্দ্রীয় অনেক নেতা। কারণ ওই সময়ে জামায়াতের পক্ষে দলটির শক্তিশালী একটি গ্র“প কাজ করেছে। বর্তমানে ওই গ্রুপটি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান রোববার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘জামায়াত তাদের মতো রাজনীতি করে, তাদের গঠনতন্ত্রও আলাদা। জামায়াত চায় ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করতে। কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিশ্বাসী দল।’ দলীয় সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতের ভূমিকা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। ওই সময় তাদের নেতাকর্মীদের রাজপথে ততটা সক্রিয় দেখা যায়নি। দু-তিনটি জেলা ছাড়া কোথাও তাদের কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি। এই ব্যাপারে জামায়াতের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বেশির ভাগ সময় তাদের পাওয়া যায়নি। বিষয়টি খালেদা জিয়াকে অবহিত করেছিল আন্দোলন মনিটরিং টিম। পরে বিএনপি চেয়ারপারসনের নির্দেশে দলের স্থায়ী কমিটি একজন সদস্য ও যুগ্ম মহাসচিব পদের দুই নেতা জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর কয়েকদিনের জন্য আন্দোলনে মাঠে প্রকাশ্যে সক্রিয় ছিল জামায়াত-শিবির। কিন্তু টানা তিন মাসের অবরোধ ও থেমে থেমে হরতালের সময় বিএনপির সিদ্ধান্তের বাইরে অব্যাহত ছিল নাশকতা ও সহিংসতা। যেটি না করার জন্য কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের ধারণা, এসব ঘটনার সঙ্গে জামায়াত-শিবির জড়িত। দলের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, সবশেষ ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে দলটির ভূমিকা নিয়েও অস্বস্তি বিরাজ করছে বিএনপিতে। বারবার উদ্যোগ নিয়েও কাউন্সিলরদের ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। শত চেষ্টা করেও জামায়াতকে জোট সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণায় নামানো যায়নি। এমনকি ভোটের দিন মাঝামাঝি সময়ে কারচুপিসহ নানা অভিযোগে নির্বাচন বর্জন করলেও জামায়াতের কাউন্সিলর প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে ছিল। জাতীয় বা স্থানীয় যেকোনো নির্বাচন আসলেই জামায়াত দরকষাকষিতে নেমে পড়ে। তাদের মূল কাজই হচ্ছে নির্বাচনে ভাগাভাগি করা। বেশির ভাগ সময়েই তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। বিএনপির সিদ্ধান্তকে না মেনে তারাও প্রার্থী ঘোষণা করে। একই কাজ সিটি নির্বাচনে করেছে। বেশির ভাগ ওয়ার্ডে বিএনপি একক প্রার্থী চূড়ান্ত করে। কিন্তু জামায়াত একক সিদ্ধান্তে ২০-২৫টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী দেয়। প্রার্থী নিয়ে সমঝোতার লক্ষ্যে জামায়াতের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তারা কোনো সাড়া দেননি। এদিকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র যুগান্তরকে জানায়, সরকার বিরোধী আন্দোলন ও তিন সিটি নির্বাচনে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে বেশ ক্ষুব্ধ তারেক। বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে লন্ডনের তারেক জিয়ার রাজনৈতিক ডেস্ক। পাশাপাশি জামায়াতের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের নেতিবাচক মনোভাবের বিষয়টিও পর্যবেক্ষণ করছে এই ডেস্ক। প্রাথমিক পর্যক্ষেণে দেখা গেছে, জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করলে তা সফল হওয়া খুবই কঠিন হবে। জঙ্গিবাদের অভিযোগ বিএনপির ঘারেও চাপতে পারে। ইতিমধ্যেই এমন অভিযোগ বিএনপির বিরুদ্ধে উঠেছে। এমন অবস্থায় জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের ব্যাপারে তারেক রহমান অনেকটাই ইতিবাচক বলে দাবি করে সূত্রটি। বিএনপির একটি অংশ মনে করেন, পর্দার আড়ালে সরকারের সঙ্গে জামায়াতের একটি আঁতাত হয়েছে। এই কারণে তারা গা বাঁচিয়ে চলছেন। শুধু সরকারবিরোধী আন্দোলন নয়, জামায়াতের শীর্ষ নেতা এম কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পরও তারা ছিল অনেকটা নিষ্ক্রিয়। ফাঁসির প্রতিবাদে হরতাল ডাকা হলেও তা ছিল অনেকটা নিয়মরক্ষার। হরতাল ডেকে কেউ রাজপথে নামেননি। জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের বিষয়ে বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে শুক্রবার টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি নাম প্রকাশ করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘ওরা (জামায়াত) আমাদের আজীবনের শত্র“। ’৭১ সালে ওরা আমাদের শত্র“ ছিল। এখনও শত্রু। জামায়াতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে দল। কিন্তু প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে আমি কোনো কথা বললে হয়তো আমার পদ থাকবে না।’  

No comments:

Post a Comment