Friday, June 19, 2015

ঠিকাদারের চিঠির পর বদলে গেল দরপত্রের শর্তাদি:যুগান্তর

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) অপারেটর নিয়োগের টেন্ডার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেখা যায়, টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরপরই মহলবিশেষের ভোল পাল্টে যায়। বিশেষ একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে তারা মরিয়া হয়ে মাঠে নামে। পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার জন্য দরপত্রের শর্তাদি রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যায়। দরপত্র ঘোষণার পরও সুবিধাভোগী সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতি
ষ্ঠানটি যেভাবে দরপত্রের শর্ত সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে সেভাবেই তা প্রতিপালন করা হয়। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এদিকে বন্দর ব্যবহারকারী ও বার্থ অপারেটররা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ‘সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড’ নামক সৌভাগ্যবান কোম্পানিকে কাজ দিতে প্রথম থেকেই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) টেন্ডারে এমন কিছু শর্তারোপ করে যা পূরণের যোগ্যতা একমাত্র এ কোম্পানি ছাড়া আর কারও নেই। এছাড়া দরপত্র ঘোষণার পরও শর্তাদিতে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে তাতেও সুবিধা পাচ্ছে এ কোম্পানিটি। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, টেন্ডারে পক্ষপাতিত্বমূলক এই শর্ত আরোপের খেলার মাধ্যমে প্রতিযোগিতার সুযোগ সীমিত করে ফেলা হয়েছে, যা ক্রয় সংক্রান্ত বিধি পিপিআরের স্পষ্ট লংঘন। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদী যুগান্তরকে বলেন, ‘চিঠি দেয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে সরকারি সেবা ও পণ্য ক্রয় বা সরবরাহে প্রচলিত আর্থিক বিধিবিধান প্রযোজ্য।’ এনসিটির ৪ ও ৫ নম্বর বার্থ পরিচালনার জন্য টেন্ডার আহবানের পর শর্তাদিতে পরিবর্তনের প্রস্তাবের বিষয়ে সাইফ পাওয়ারটেক কোম্পানির চিঠি বন্দর কর্তৃপক্ষ পেয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (প্রশাসন) জাফর আলম। তার দাবি, পিপিআর অনুযায়ী দরপত্রে শর্তারোপ করা হয়েছে। তিনি বলেন, দরপত্রে যা কিছু হয়েছে তা পিপিআর অনুযায়ী হয়েছে। পিপিআরের বাইরে কোনো কিছু সংশোধন বা পরিবর্তন করা যায় না। এখানে সাইফ পাওয়ারটেকের পক্ষে কিছুই করা হয়নি বলেও দাবি করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘শর্ত পরিবর্তনে ঠিকাদাররা আবেদন করতেই পারেন। পিপিআরেও অনেক জায়গায় সমঝোতার কথা বলা হয়েছে। দেখতে হবে, আমরা সেটা কিভাবে মূল্যায়ন করি।’ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এনসিটির ৪ ও ৫ নম্বর বার্থ পরিচালনার জন্য টেন্ডার খোলা হয় ৯ জুন মঙ্গলবার। এতে মোট ৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড, এমএইচ চৌধুরী ও এএন্ডজে এন্টারপ্রাইজ (যৌথভাবে) এবং বশির আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানি ও টার্মিনাল সার্ভিসেস লিমিটেড। দরপত্রদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এমএইচ চৌধুরী লিমিটেডের চেয়ারম্যান হলেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। এএন্ডজে এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী। যৌথভাবে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড, এমএইচ চৌধুরী ও এএন্ডজে এন্টারপ্রাইজ চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে বলে (যৌথভাবে) দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন। কারণ হিসেবে বন্দরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, টার্মিনাল পরিচালনার অভিজ্ঞতার দিক থেকে শর্ত পূরণ করতে পারছে একমাত্র সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। তবে যৌথভাবে অংশ নেয়া বাকি দুটি কোম্পানি অপারেটর হিসেবে নিয়োগ পেতে যাচ্ছে। প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা গেছে, টেন্ডার আহ্বানের পর সাইফ পাওয়ারটেকসহ বেশ কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেন্ডারের শর্ত পরিবর্তনের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়। গত ১৭ মে সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমআর আমিন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালককে (ট্রাফিক) দেয়া হয়। ওই চিঠিতে টেন্ডার শর্তের আইটিটি ১৮.২, আইটিটি ১৪.১(বি), আইটিটি ১৫.১(বি) অনুচ্ছেদে জয়েন্ট ভেঞ্চারের ক্ষেত্রে কয়েকটি শব্দ বাদ দিয়ে ‘নট এপ্লিকেবল’ শব্দযুগল জুড়ে দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। একইভাবে আইটিটি ১৫.১(এ) অনুচ্ছেদে কোম্পানির বার্ষিক লেনদেন ৩৫ কোটি টাকার পরিবর্তে ৩০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনার অনুরোধ জানানো হয়। এর আগে ১৩ মে টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স বশির আহমেদ চবক চেয়ারম্যানকে এক চিঠিতে টেন্ডারের কিছু শর্ত শিথিল করতে ৬টি প্রস্তাব দেন। এর মধ্যে অন্যতম প্রস্তাব হচ্ছে- কনটেইনার টার্মিনাল অপারেটরের অভিজ্ঞতার পরিবর্তে কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের অভিজ্ঞতা প্রতিস্থাপন, বার্ষিক টার্নওভার ৩৫ কোটি থেকে কমিয়ে ৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা। এরপর ২১ মে টেন্ডারের কয়েকটি শর্ত সংশোধনের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান। ওই চিঠির তৃতীয় দিন ২৪ মে চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালক (ট্রাফিক) গোলাম সরওয়ার স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে টেন্ডার শর্তে পরিবর্তন আনার বিষয়টি বলে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জানিয়ে দেয়া হয়। ওই চিঠিতে দেখা গেছে, আইটিটি ১৮.২, আইটিটি ১৪.১(বি), আইটিটি ১৫.১(বি), আইটিটি ১৫.১(এ), আইটিটি ১৭.১ (ভি) অনুচ্ছেদের শর্তে পরিবর্তন আনা হয়। একই সঙ্গে এনসিটি বার্থ নং-৪ ও ৫-এর দরপত্র দাখিলের সময় সাত দিন বাড়ানো হয়। দেখা গেছে, সংশোধিত শর্তের বেশির ভাগই পরিবর্তনের জন্য সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড প্রস্তাব করেছিল। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালক (ট্রাফিক) গোলাম সরওয়ার বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য নেই। আমাদের সবকিছু দেখভাল করেন অন্য কর্মকর্তা।’ নৌ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, টেন্ডার প্রক্রিয়ার প্রথম কঠিন শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। ওই শর্ত পূরণ একমাত্র সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড করতে পারবে। বিষয়টি নিয়ে চবকের বোর্ড সভায় আলোচনা হয়। পরে তা নৌ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানায় চবক। ওই চিঠিতে বলা হয়, টেন্ডার ডকুমেন্টের আইটিটি ১৪.১(বি)(৩) এ টেন্ডারের অভিজ্ঞতা হিসেবে শুধু টার্মিনাল অপারেটরের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা আছে। এছাড়া আইটিটি ৫.১-এ আরও বলা আছে যে, শুধু বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। কিন্তু বাংলাদেশের অপারেটর হিসেবে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শুধু একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কাজেই টেন্ডার ডকুমেন্টের ওই শর্তানুযায়ী এখানে প্রতিযোগিতার কোনো সুযোগ না থাকায় পিপিআরের ব্যত্যয় ঘটবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো আপত্তি জানালেও রহস্যজনক কারণে তা বহাল রাখা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল হল এনসিটি। প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই টার্মিনালটি পূর্ণ ক্ষমতায় চালু করা যায়নি ৭ বছরেও। মামলা সংক্রান্ত জটিলতা, আন্দোলন ইত্যাদি কারণে বারবার ব্যাহত হয়েছে এর দরপত্র প্রক্রিয়া। বর্তমানে এটা চুক্তিতে পরিচালনা করছে চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনালের অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। এনসিটির ৫টি বার্থের মধ্যে একটি সংরক্ষিত থাকবে পানগাঁও আইসিডির জন্য। বন্দর ব্যবহারকারীরা জানান, প্রতিবেশী ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার প্রস্তুতি হিসেবে এনসিটির পূর্ণাঙ্গ অপারেশন প্রয়োজন। একই সঙ্গে বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ২০০১ সালে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এক কিলোমিটার দীর্ঘ জেটি এবং পশ্চাৎ সুবিধাসহ এই টার্মিনালে পাঁচ জেটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই জেটিতে বড় আকৃতির তিনটি জাহাজ এবং মাঝারি আকৃতির পাঁচটি জাহাজ একই সঙ্গে বার্থিং দিয়ে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করা যাবে। টার্মিনালটি পুরোদমে চালু হলে বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডেলিং ক্ষমতা দ্বিগুণে উন্নীত হবে। এনসিটিতে একই সঙ্গে ৫টি জাহাজ ভিড়তে পারে। বর্তমানে পুরো বন্দরে একই সঙ্গে জাহাজ ভিড়তে পারে ১৭টি। এনসিটি চালু হলে তা দাঁড়াবে ২২টিতে। প্রায় ১ হাজার মিটার দীর্ঘ এই টার্মিনালে কনটেইনার ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৫ লাখ টিইইউস।  

No comments:

Post a Comment