Friday, June 19, 2015

নিরপেক্ষ ম্যাচে দুর্দান্ত প্রতিশোধ:কালের কন্ঠ

ম্যাচ শেষ হতে হতে প্রায় মধ্যরাত। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য সেটি হয়ে যায় যেন মধ্যাহ্ন! দিবারাত্রির দৈনিক চক্রে চারদিকে তখন অন্ধকারের রাজত্ব। ক্রিকেটীয় হিসাবে সেটি রূপ
ান্তরিত আলোর সাম্রাজ্যে! ঋতুচক্রের নিয়ম মেনে ওই মুহূর্তে আষাঢ়ের মেঘে ঢাকা আকাশ। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের আকাশে তখন হাজার তারার ফুল। ভারতকে ৭৯ রানে হারানোর অর্জন যে চাট্টিখানি ব্যাপার নয়! আর এটি তো শুধু যেনতেন একটি জয় নয়। এই জয়ে লুকিয়ে বীরত্বের গর্জন। সামর্থ্যরে ভাষণ। বঞ্চনার প্রতিশোধ। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের কাছে অন্যায্য হারের জবাব যেন দিল কাল মাশরাফি বিন মর্তুজার দল। ওয়ানডে সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই তাই কেন আটকে থাকবে সে জয়ের মাহাত্ম্য! এই ম্যাচটির পরতে পরতে কতই না রং! ভাঁজে ভাঁজে কতবারই না সম্ভাবনা-আশঙ্কার পালাবদল! শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে কাল যেন ওয়ানডে নয়, মঞ্চস্থ হলো কোনো এক টেস্ট ম্যাচ। আর তাতে চূড়ান্ত বিজয়ী বাংলাদেশ। রাতের অন্ধকার ভেদ করে গর্জে ওঠে তাই ৫৬ হাজার বর্গমাইল। আনন্দের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে মানচিত্রের প্রতি বর্গইঞ্চিতে। বাংলাদেশের শুরুটা দোর্দণ্ড প্রতাপেই। তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকারের ব্যাটিং তাণ্ডবে। আর তাতে দিশাহারা-দিকভ্রান্ত ভারত। তাদের বোলিং আক্রমণ দুমড়ে-মুচড়ে স্বপ্নের একেকটি সোপান যেন তৈরি করেন স্বাগতিক ব্যাটসম্যানরা। তাতে মিশে থাকে বিশ্বকাপ-বঞ্চনার প্রতিশোধের প্রত্যয়। নিজেদের সামর্থ্যরে জানান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। এক ইনিংসেই ম্যাচের গন্তব্য এঁকে দেওয়ার পথে যেন এগিয়ে যান বাংলাদেশের শিল্পীত-সুন্দর ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু এত সহজেই এমন অবিশ্বাস্য অর্জন কি আর হয়! বৃষ্টি-বাগড়ায় ছন্দপতন ঘটে তাই। সাড়ে তিন শর প্রতিশ্রুতিমাখা স্বাগতিকদের ইনিংস থেমে যায় ৩০৭ রানে। আশাটা তখনো ছিল। কিন্তু মশালের উজ্জ্বলতার বদলে প্রদীপের ম্রিয়মাণতা সেখানে। ভারতের বিশ্বখ্যাত ব্যাটিং লাইনকে কি আর তাতে আটকে রাখা যাবে! গেল তো! শিখর ধাওয়ান ও রোহিত শর্মার ৯৫ রানের জুটির পরও। ম্যাচ বাংলাদেশের মুঠো গলে বেরিয়ে যাচ্ছে, একাদশে চার পেসার খেলানোর যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে ক্রমশ- এমন সময়ই গর্জে ওঠেন মাঠের ১১ ক্রিকেট সৈনিক। যাঁদের নেতৃত্বে ১৯ বছরের এক আনকোরা তরুণ। মুস্তাফিজুর রহমান। কালই যিনি খেলতে নামেন ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে। এক বছর আগে এমনই এক জুনে ভারতের বিপক্ষে তাসকিন আহমেদ নামের আরেক পেসার অভিষেকে নেন পাঁচ উইকেট। তাতে ভারত কেঁপে ওঠে বটে, তবে শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জিতে বেরিয়ে যায় ঠিকই। কাল আর তা হয়নি। শুরুর দুই উইকেট নিয়ে শুরুটা করেন সেই তাসকিন। পরের পুরোটা অংশ জুড়েই মুস্তাফিজ-রূপকথা! ওয়ানডের পথচলার শুরুতে পাঁচ উইকেট নিয়ে ভারতকে হারানোর মহানায়ক যে তিনিই! নতুন বল হাতে প্রথম বলেই এলবিডাব্লিউর জোরালো আবেদন ওঠে মুস্তাফিজের বলে। খারিজ হয়ে যায় তা। পরের ওভারে আরো একবার একই দৃশ্যের পুনর্মঞ্চায়ন। সঙ্গে বেশ কবার ব্যাটের কানায় বাতাস লাগিয়ে বলের বেরিয়ে যাওয়া। এই করতে করতেই চার ওভারে ২৭ রান দিয়ে মুস্তাফিজের প্রথম স্পেল শেষ। স্টেডিয়ামের হাজার পঁচিশেক দর্শকের তখনো বোঝার উপায় নেই, কী অবিশ্বাস্য কীর্তি করতে চলেছেন ওই ১৯ বছরের পেসার। মুস্তাফিজ বোলিংয়ে ফেরেন ২১তম ওভারে। ততক্ষণে অল্প সময়ের ব্যবধানে শিখর ধাওয়ান ও বিরাট কোহলিকে আউট করে ম্যাচে ফেরার পথ খুঁজছে বাংলাদেশ। সেই পথটা খুঁজে পায় মুস্তাফিজের দুর্দান্ত বোলিংয়ে। একের পর এক কাটারে ব্যতিব্যস্ত-বিভ্রান্ত করে রাখেন ভারতের ব্যাটিং লাইনকে। দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে পর পর দুই ওভারে ভয়ংকর রোহিত শর্মা (৬৩) ও ভয়ংকর হয়ে ওঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া আজিঙ্কা রাহানের (৮) উইকেট। পরেরটিতে তাঁর স্লোয়ারের সঙ্গে কাভারে শূন্যে উড়ে নেওয়া নাসির হোসেনের ক্যাচের ভূমিকাও কম নয়। এর পরের ওভারেই রান নেওয়ার সময় মহেন্দ্র সিং ধোনির সঙ্গে সংঘর্ষ মুস্তাফিজের। যে কারণে মাঠের বাইরে পর্যন্ত চলে যেতে হয়। কিন্তু তাতেও কি দমানো যায় মুস্তাফিজকে! ফিরলেন তিনি। ফিরলেন রাজার মতোই। ভারত যখন গুছিয়ে নিচ্ছিল খানিক, তখনই মুস্তাফিজের পর পর দুই বলে আউট সুরেশ রায়না ও রবিচন্দ্রন অশ্বিন। পরের ওভারে রবীন্দ্র জাদেজাও। নিজের শেষ স্পেলে মোহিত শর্মার ফিরতি ক্যাচটি না ফেললে তো ছয় উইকেটই হয়ে যায় মুস্তাফিজের। তবু ৯.২-১-৫০-৫ স্পেলটিও বা মন্দ কি! এই বিধ্বংসী বোলিং করে ওই বাঁহাতি পেসারই তো বাংলাদেশকে এনে দেন হিরণ¥য় জয়। ৪৬ ওভারে ২২৮ রানে অলআউট হয়ে ভারত হার মানে ৭৯ রানে। অথচ ভারতীয় ওপেনারদের দাপুটে ব্যাটিংয়ের সময় মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের জন্য এই ম্যাচটি হয়ে রইবে বৃষ্টির আক্ষেপের গল্প। বৃষ্টির সঙ্গে সৃষ্টির যোগসূত্রটা বহু পুরনো। এ নিয়ে যুগে যুগে কত কবিতা! কত গান! কত গল্প! আবার ওই টাপুর-টুপুর ধ্বনিতে যে সব সময় সৃষ্টিসুখের উল্লাস থাকে, তাও তো না। যুগ-যুগান্তরে বহু অনাসৃষ্টির উৎস তা। সেটি নাগরিক জীবনের জলজট-যানজট থেকে শুরু করে সব ভাসিয়ে নেওয়া বন্যা পর্যন্ত। কাল শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের এক পশলা বৃষ্টি বাংলাদেশের জন্য তেমনই অনাসৃষ্টির উপলক্ষ হয়ে থাকার আশঙ্কা জাগিয়েছিল। ১৫.৪ ওভারে এক উইকেটে ১১৯ রান- ভারতের বিপক্ষে আগে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশের স্কোরটা দেখেও যেন বিশ্বাস হয় না। আর শুধু তো রান নয়! যে রাজসিক আধিপত্যে প্রতিপক্ষের বোলিং লাইন গুঁড়িয়ে দিচ্ছিলেন স্বাগতিক ব্যাটসম্যানরা, তাতে রীতিমতো স্তম্ভিত ভারত। চার-ছক্কার খই ফোটে শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের সবুজ চত্বরে। ড্রাইভ-কাট-পুলের বাহারি প্রদর্শনীতে ওঠে করতালির ঢেউ। তামিম ইকবাল তিন চার ও এক ছক্কা মারেন উমেশ যাদবের ওভারে। স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়ে গ্যালরিতে। সৌম্য সরকার ১০ বলের মধ্যে পাঁচবার সীমানাছাড়া করেন ভুবনেশ্বর কুমার, রবিচন্দ্রন অশ্বিন, মোহিত শর্মাকে। বিশ্বাসের রেণু স্টেডিয়ামের কংক্রিট পেরিয়ে উড়ে উড়ে যায় ৫৬ হাজার বর্গমাইলে। বিশ্বকাপ-বঞ্চনার প্রতিশোধ তাহলে নেওয়া যাবে এবার! ভারতকে হারিয়ে প্রমাণ করা যাবে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব। ১৩.৪ ওভারে ১০২ রানের ওপেনিং জুটিটা ভাঙে বড্ড নিষ্ঠুরভাবে। মাত্র ৪০ বলে ৫৪ রান করা সৌম্যর রানআউটে। তাতে দোষটা তাঁর ছিল নাকি তামিমের, এ নিয়ে আলোচনা বেশি দূর গড়ায় না। অভিষিক্ত লিটন দাস এসে তামিমকে যে দিতে শুরু করেন যোগ্য সঙ্গ! ১৫.৪ ওভারে এক উইকেটে ১১৯ রানের স্বপ্নিল মঞ্চে এভাবেই পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। তারপর? বৃষ্টি-বিধাতার বিমাতাসুলভ খেয়ালের শিকার বাংলাদেশ। আকাশ অন্ধকার করে আষাঢ়ের ঝুম বর্ষণ হয়নি। কিন্তু ওই এক পশলা বৃষ্টিতে যে ৬২ মিনিট খেলা বন্ধ থাকে, তাতেই যেন স্বাগতিকদের সর্বনাশের বীজ প্রোথিত হওয়ার আশঙ্কা। তাল-ছন্দ-লয় কেটে যায় বাংলাদেশের। আর হতভম্ব ভারতও সুযোগ পায় মাঝের সময়টায় নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার। তাইতো সাড়ে তিন শর স্বপ্ন দেখানো স্বাগতিকদের ইনিংস থেমে যায় ৩০৭ রানে। বৃষ্টির পর খেলা শুরুর ১১তম বলে আউট ৬২ বলে ৬০ রান করা তামিম। অশ্বিনের বলে লং অফে ক্যাচ প্র্যাকটিস করান তিনি। লিটন (৮) ও মুশফিকুর রাহিমও (১৪) প্যাভিলিয়নমুখো হতে সময় নেন না। দেখতে না দেখতে ২৩.৩ ওভারে ১৪৬ রানে চতুর্থ উইকেট পড়ে বাংলাদেশের। স্বপ্নপাখির ডানাটা যেন ভেঙে পড়ে তাতে! এর পরও ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেতে প্রথমবারের মতো ৩০০ রান পেরোয় বাংলাদেশ। সেটি মূলত সাকিব আল হাসান ও সাব্বির রহমানের ১৪.২ ওভারে ৮৩ রানের জুটির সৌজন্যে। ৪৪ বলে ৪১ রানের সাহসী-সুন্দর ইনিংস সাব্বিরের। সাকিব খেলেন ৬৮ বলে ৫২ রানের সময়োপযোগী ইনিংস। কিন্তু সেই সময়ের দাবিটা ছিল যেখানে ইনিংসের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার, সেখানে এই অলরাউন্ডার ব্যর্থ ভীষণ। যাদবের অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের বলে চালিয়ে পয়েন্টে সহজতম ক্যাচ দেন তিনি। সেটি ৪৪তম ওভারের ঘটনা। যদি শেষ পর্যন্ত থাকতে পারতেন সাকিব, তাহলে বাংলাদেশের আরো ২০-৩০ বেশি হতে পারত। নাসির (২৭ বলে ৩৪), মাশরাফিদের (১৮ বলে ২১) চেষ্টায় ৩০০ পেরিয়ে আরো সাত রান করে বটে বাংলাদেশ। কিন্তু ইনিংস শেষে আরো কিছু রানের আক্ষেপ এবং আরো বেশি করে ওই বৃষ্টির হাহাকারে জর্জর ১৬ কোটি ক্রিকেটপ্রাণ। কিন্তু মধ্যরাত ছুঁই ছঁই সময়ে সাকিবের বলে ভারতের শেষ উইকেট পড়ে যখন, তখন আর সেসব মনে রাখতে বয়েই গেছে! বাংলাদেশ ক্রিকেটের মধ্যাহ্নে তখন আলোর সাম্রাজ্য। আষাঢ়ের মেঘ ফুঁড়ে হাজার তারার ফুলে তখন কেবলই উৎসবের উপলক্ষ। বিশ্বকাপ-বঞ্চনার প্রতিশোধে ভারতের বিপক্ষে জয় বলে কথা!

No comments:

Post a Comment