Sunday, June 21, 2015

ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে অনীহা শিল্প মালিকদের:যুগান্তর

সাত বছরেও শেষ হয়নি ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনসংক্রান্ত প্রকল্প ‘অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট’ (এপিআই)। সরকারের সংশ্লিষ্টদের ‘রহস্যজনক’ গাফিলতি ও ওষুধ শিল্প মালিকদের অনীহার কারণেই মূলত ‘কচ্ছপ গতিতে’ চলছে প্রকল্পটির যাবতীয় কাজ। দেশে কাঁচামাল তৈরি করে ওষুধ প্রস্তুত করা হলে মুনাফা কম হবে- এমন আশংকা থেকেই প্রকল্প বাস্তবায়নে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না শিল্প মালিকরা।
.com/ads/server/adserve/www/delivery/ck.php?n=acd94d5f' target='_blank'> ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিওর) বেঁধে দেয়া সময় শেষ হচ্ছে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশসহ এলডিসিভুক্ত দেশগুলো কাঁচামাল তৈরিতে সক্ষমতা অর্জনে ব্যর্থ হলে মেধাস্বত্বের মূল্য যোগ করে অতিরিক্ত দামে কাঁচামাল আমদানি করতে হবে। সেক্ষেত্রে বেড়ে যাবে ওষুধের খুচরা মূল্যের দাম- যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে বলে আশংকা সংশ্লিষ্টদের। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ডব্লিউটিওর ছাড়ের মেয়াদ আরও ১০ বছর বাড়াতে নানা তৎপরতা শুরু করেছে ওষুধ শিল্প মালিকরা। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্টদেরকেও ‘ম্যানেজ’ করেছেন তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য ওষুধ পণ্যের ক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মেধাস্বত্ব অধিকারের ছাড়ের সময় শেষ হচ্ছে ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ডব্লিউটিওর মেধাস্বত্ব অধিকারের বাণিজ্যবিষয়ক (ট্রিপস) চুক্তি অনুযায়ী, এ সময়ের মধ্যে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোকে ওষুধের কাঁচামাল তৈরিতে সক্ষমতা অর্জন করতে বলা হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের অধিকার বা মেধাস্বত্বের নীতিমালার আলোকে ডব্লিউটিও ১৯৯৫ সালে আন্তর্জাতিক ট্রিপস (trade related aspect of intellectual property right) চুক্তি ঘোষণা করে। ডব্লিউটিওর পক্ষ থেকে বলা হয়, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের অধিকার রক্ষায় ন্যূনতম মান নিশ্চিত করতে এই চুক্তি ঘোষণা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সব সদস্য রাষ্ট্রের জন্য এই চুক্তি মানা বাধ্যতামূলক। পরে ২০০১ সালে ডব্লিউটিওর মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে গৃহীত দোহা ঘোষণায় ট্রিপস কার্যকর করার ক্ষেত্রে এলডিসির ৫০টি রাষ্ট্রের জন্য চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন ছাড়ের ব্যবস্থা রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে এই চুক্তি কার্যকর করতে বাংলাদেশের হাতে সময় আছে আর মাত্র ৬ মাস। ট্রিপস চুক্তি অনুযায়ী ছাড়ের মেয়াদ শেষে কাঁচামাল উৎপাদনে কোনো দেশ ব্যর্থ হলে, সেক্ষেত্রে মেধাস্বত্বের মূল্য যোগ করে অতিরিক্ত দামে কাঁচামাল আমদানি করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের অভিযোগ, দেশে কাঁচামাল উৎপাদন করার ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নন ওষুধ শিল্প মালিকরা। বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণা ও উন্নয়নের পরিবর্তে চিকিৎসকদের খুশি করতে এবং ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে বেশি আগ্রহী। এর মূল কারণ কাঁচামাল আমদানিতে যে অর্থ ব্যয় হয়, সেই তুলনায় গবেষণা ও উন্নয়ন কাজে এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়। কাঁচামাল উৎপাদন করতে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সার্বক্ষণিকই গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। অন্যদিকে মেধাস্বত্ব ছাড়ের সুবিধা থাকায় আমদানিতে কম খরচ হয়। এছাড়া কাঁচামাল উৎপাদনে শিল্প মালিকদের নতুন করে বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি রয়েছে শিল্প কারখানা পরিচালনার নানা ঝক্কি। এসব বিষয় বিবেচনায় এনে ওষুধ শিল্পের মালিকরা এখনও পর্যন্ত প্রকল্পেও কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার নির্মাণের টাকা জমা দেননি। উল্টো তারা চাচ্ছেন ডব্লিউটিওর ছাড়ের মেয়াদ আরও ১০ বছর বাড়ানো হোক। এ ব্যাপারে নানা তৎপরতাও শুরু করেছেন তারা। এ সুবিধা থাকলে উৎপাদন খরচ পড়ে কম। পাশাপাশি বিক্রয় মূল্য হয় বেশি। কিন্তু কাঁচামাল উৎপাদন করে ওষুধ তৈরি করা হলে তাদের মুনাফা কম হবে- এমন আশংকা থেকে ওষুধ শিল্প মালিকরা সরকারের সংশ্লিষ্টদেরকে ‘ম্যানেজ’ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকেও ‘ধীরে চল নীতি’ অনুসরণ করা হচ্ছে। ঝুলে গেছে প্রকল্প বাস্তবায়ন। সূত্র আরও জানায়, ওষুধ শিল্প মালিকরা যদি শতভাগ আন্তরিক হন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বাভাবিক গতি অব্যাহত থাকে, সেক্ষেত্রে কাঁচামাল তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে বাংলাদেশকে কমপক্ষে আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মুক্তাদির যুগান্তরকে বলেন, চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়াতে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আশা করছি সরকার চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সচিব জিয়াউল হক যুগান্তরকে বলেন, এপিআই শিল্প পার্কের কাজ শেষ হতে এখনও অনেক সময়ের প্রয়োজন। তবে সমিতির পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চুক্তিও মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়াতে আনুরোধ করা হয়েছে। আশা করছি, মন্ত্রণালয় ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। কাঁচামাল উৎপাদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেই সক্ষমতা অর্জনে আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন। কারণ কাঁচামাল উৎপাদন প্লান্টের জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। সামগ্রিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আরও সময় বাড়ানো জরুরি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ওষুধ শিল্পের উন্নয়নে এবং কাঁচামাল উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জনে ‘অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট’ বা এপিআই শিল্প পার্ক স্থাপন কাজ শুরু হয় ২০০৮ সালে। কিন্তু প্রায় সাত বছর ধরে পার্ক স্থাপনের কাজ চললেও বাস্তবায়ন চলছে ধীর গতিতে। নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় এ প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় প্রায় ২০০ একর জমিতে চলছে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। এটির সার্বিক তত্ত্বাবধান করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)। ২০০৯ সালে ২১৩ কোটি টাকার প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন জটিলতায় তিন দফা সময় ও প্রায় ১২০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে ২০১৫ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে প্রকল্পের মোট ব্যয় নির্ধারণ হয়েছে ৩৩১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এরমধ্যে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন বাবদ ৮০ কোটি টাকা ওষুধ শিল্প সমিতির দেয়ার কথা। বিসিকের এ প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একজন প্রকৌশলী শামসুল আলম জানান, এপিআই শিল্প পার্ক স্থাপনের কাজ শেষ হতে আরও সময় লাগলেও যত দ্রুত সম্ভব প্লট বরাদ্দ দেয়ার চেষ্টা চলছে। কারণ বর্জ্য শোধনাগার ( সিইটিপি বা এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) বসানোর জন্য ৮০ কোটি টাকা ওষুধ শিল্প সমিতির দেয়ার কথা। কিন্তু প্লট না দিলে তারা টাকা দিতে পারবে না বলে জানিয়েছে। বিসিকের অপর এক বকর্মকর্তা জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা ছিল গত মে মাসের মধ্যে প্লট বরাদ্দ দেয়া। কিন্তু আনুষঙ্গিক কাজ না হওয়ায় প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে গেছে। প্লট বরাদ্দ দেয়ার কাজটিও কাক্সিক্ষত সময়ের মধ্যে হয়নি। এপিআই শিল্প পার্ক স্থাপন প্রকল্পটি ২০০৮ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায়। এরপর এর কাজ শুরু হলেও তিন দফা সময় বাড়িয়ে সর্বশেষ চলতি জুনে মেয়াদকাল ধরা হয়। কিন্তু এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত কেবল মাটি ভরাট ও কিছু অংশে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। এখনও ৫টি পয়েন্টে সীমানা প্রাচীর করা সম্ভব হয়নি। ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে এ পার্কে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি), ডাম্পিং ইয়ার্ড ও ইনসিনারেটর নির্মাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করা যায়নি। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ সড়ক ব্যবস্থা, ড্রেন নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন স্থাপন, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থার কাজও অসমাপ্ত রয়েছে। তবে বিসিকের কার্যালয় ইতিমধ্যে নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রকল্পটির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক আবদুল বাছেত যুগান্তরকে বলেন, ৩৩১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের অবশিষ্ট কাজ শেষ করতে এরই মধ্যে ঠিকাদারকে তাগিদ দেয়া হয়েছে। এতে প্লটের সংখ্যা হবে ৪২টি। ওষুধ শিল্পের প্রকৃত উদ্যোক্তারা প্লটের জন্য আবেদন করতে পারবেন। প্লটের প্রতি শতাংশের দাম পড়বে আড়াই লাখ টাকা- যা কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ থাকবে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ওষুধ তৈরিতে ৯৭ শতাংশ কাঁচামালই আমদানি করতে হয়। দেশে ১৫টি প্রতিষ্ঠান স্বল্প পরিসরে ৪৩টি ওষুধের কাঁচামাল তৈরি করতে পারলেও নতুন মলিকিউল তৈরির সক্ষমতা এখনও অর্জিত হয়নি। এমনকি চূড়ান্ত হয়নি প্যাটেন্ট আইন। তারা জানান, মুন্সীগঞ্জের বাউশিয়ায় ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য এপিআই শিল্প পার্কের কাজ চললেও উৎপাদন শুরু হতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত লেগে যাবে। এর আগেই ২০১৬ সাল থেকে ট্রিপস চুক্তি বাস্তবায়ন শুরু হলে ওষুধের দাম অনেক বেড়ে যাবে। অনেকেই তা বহন করতে পারবে না। পাশাপাশি ওষুধ রফতানিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশের ওষুধ বিশ্বের ৭০টি দেশে রফতানি হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বাড়লে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবম ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ট্রিপস চুক্তির প্রভাবে অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধের মূল্য অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাবে। সাধ্য মতো ওষুধ না পাওয়ায় দরিদ্র পরিবারে মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে। যার প্রধান শিকার হবে দেশের নারী ও শিশুরা। এছাড়া ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বেকার হয়ে পড়বে কয়েক লাখ মানুষ। তিনি বলেন, বর্তমানে যে ওষুধ আমরা ১ টাকায় কিনতে পারি, ট্রিপস চুক্তি কার্যকর হলে তার দাম বেড়ে দাঁড়াবে ১০ টাকা। আর ১০ টাকার ওষুধের দাম গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ১০০ টাকায়। এর ফলে ওষুধের দাম চলে যাবে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। একই সঙ্গে মেধাস্বত্ব মূল্য এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গিয়ে দেশীয় ওষুধ শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে। যার প্রত্যক্ষ এবং প্ররোক্ষ শিকারে পরিণত হবে দেশের স্বল্প আয়ের মানুষ। তিনি বলেন, হাতে আর সময় না থাকলেও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এর ভয়াবহ পরিণতি পুরো জাতিকেই বহণ করতে হবে।  

No comments:

Post a Comment