
রমজান মাসে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস নিয়ে রোজাদারদের জন্য কোনো সুখবর নেই। ইফতার, তারাবি এবং সেহরির সময় নগরবাসী একসঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা নাও পেতে পারেন। প্রতিদিন গড়ে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থাকবে। পানির ঘাটতি ১৫ কোটি লিটার, গ্যাসের ঘাটতি ২০ কোটি ঘনফুট। ঘাটতির প্রভাবে তিন খাতেই সংকট বাড়বে। ফলে নগরবাসীকে অন্যান্য সময়ের মতোই দুর্ভোগ মাথায় নিয়েই পার করতে হবে রোজার মাস।
platinum.ritsads.com/ads/server/adserve/www/delivery/ck.php?n=acd94d5f' target='_blank'>

গ্রামের অবস্থা আরও ভয়াবহ। শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পল্লী বিদ্যুতের চাহিদা অর্ধেকের বেশি কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে রোজার মাসে গ্রামবাসীর দিন-রাত মিলিয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। রোজায় দুর্ভোগ হবে এটা বলতে বা মানতে রাজি নন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কর্তাব্যক্তিরা। তাদের মতে, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের তেমন কোনো সমস্যাই হবে না। এজন্য তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছেন। বিদ্যুৎ বিভাগের মতে, লোডশেডিং এখন শূন্য। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে সব ধরনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িতদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। প্রায় একই কথা বলছেন ওয়াসা এবং তিতাসের শীর্ষ কর্মকর্তারা। তবে এসব খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, জোড়াতালি দিয়ে সংকট নিরসন করতে গিয়ে সব ক্ষেত্রে হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হবে। তাদের মতে, বর্তমানে গ্যাসের ঘাটতি প্রায় ২০ কোটি ঘনফুট। সংকট নিরসনে রমজানে কিছু কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হবে। একই সঙ্গে অনেক এলাকার শিল্প-কারখানায়ও গ্যাস কমিয়ে দেয়া হবে। এতে গ্যাসের সাশ্রয় হবে। কিন্তু বিদ্যুৎ সংকট বাড়বে। এতে লোডশেডিং বেড়ে যাবে। বিদ্যুৎ না থাকার প্রভাব পড়বে পানি উত্তোলনে। অপরদিকে শিল্প-কারখানায় গ্যাস কমিয়ে দেয়া হলে ব্যাহত হবে শিল্পোৎপাদন। আর শিল্প উৎপাদন কম হলে শ্রমিক-কর্মচারীরা সমস্যায় পড়তে পারেন। ঈদের বেতন বোনাস নিয়ে সংকট সৃষ্টি হতে পারে। তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী নওশাদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এ বছর রমজান মাসে গ্যাসের ঘাটতি থাকবে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এই ঘাটতির কারণে নগরবাসীকে যাতে কোনো সমস্যায় পড়তে না হয় সেজন্য তিতাসের আওতাধীন সবগুলো স্টেশনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার রমজান মাসের ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করা হয়েছে। সিস্টেমের অবস্থা ভালো। তিনি বলেন, এবার লোড সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রথম রোজা থেকে পুরো লোড ডিসপার্স মনিটরিং করা হবে। যখন যেখানে লোড প্রয়োজন হবে সেখানে গ্যাস দেয়া হবে। কাজেই ইফতার, সেহরিতে গ্যাসের কোনো সমস্যা হবে না বলে তিনি আশা করছেন। ঢাকা ওয়াসার পরিচালক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, রোজায় পানির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকলেও যাতে পানি উঠানো যায় সেজন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ বছর রমজানে পানির চাহিদা ২৩০ কোটি লিটার। বর্তমানে ওয়াসার উৎপাদন ক্ষমতা ২৪২ কোটি লিটার। আর উৎপাদন হচ্ছে ২১০ থেকে ২১৫ কোটি লিটার। এ অবস্থায় এখন পর্যন্ত রমজানে বিশেষ কোনো প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। ২ সপ্তাহ ধরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেশের বাইরে থাকায় রজমানের প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয়নি। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা গেছে, এ বছর রমজানে বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছে ৮,৫০০ মেগাওয়াট। কিন্তু এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন হচ্ছে ৭,৫০০ মেগাওয়াট। ঘাটতি ১ হাজার মেগাওয়াট। পিডিবির চেয়ারম্যান শাহীনুল ইসলাম খান যুগান্তরকে জানান, বর্তমানে বিদ্যুতের কোনো লোডশেডিং নেই। সঞ্চালন লাইনের দুর্বলতার কারণে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। বর্তমানে সঞ্চালন লাইনের ধারণ ক্ষমতা সাড়ে ৭ হাজার মেগাওয়াট। এ কারণে মূল চাহিদা অনুযায়ী সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করা যাচ্ছে না। পিডিবি চেয়ারম্যান বলেন, রমজানে সেহরি, ইফতার এবং তারাবির নামাজে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে বিতরণ কোম্পানিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শহর এলাকার পাশাপাশি গ্রামেও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে আরইবির (রুরাল ইলেকট্রিসিটি বোর্ড) সূত্রে জানা গেছে, রমজানের আগেই ইতিমধ্যে গ্রামে লোডশেডিং প্রকট আকার ধারণ করেছে। গত দুই মাসে লোডশেডিং অনেক বেশি ছিল। রজমানে তা আরও বাড়বে। বর্তমানে আরইবির চাহিদা সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু গত দুই মাসে আরইবি সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ সরবরাহ পেয়েছে ২ হাজার ৫৬৪ মেগাওয়াট। রমজানে চাহিদা আরও বাড়বে। কিন্তু উৎপাদন বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে সংকট তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আরইবি সূত্রটি আরও জানায়, মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৫০ শতাংশ পল্লী এলাকায় সরবরাহ করার কথা। সেখানে কম-বেশি ৩৫ শতাংশ সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে তারা কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। এছাড়া বিতরণ লাইন ও ট্রান্সমিশন দীর্ঘদিনের পুরনো হওয়ায় পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ নিতে পারছে না। প্রায়ই ট্রান্সফরমার ওভারলোডেড হয়ে শাটডাউন হচ্ছে। এ অবস্থায় লোডশেডিং রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এবার প্রথম রমজান থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দোকান মার্কেট ও বিপণিবিতান খোলা রাখার সিদ্ধান্তে গ্রামে লোডশেডিং আরও বাড়তে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রমজানে ইফতারের সময় সব দোকানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বন্ধ রাখা ও কোথাও আলোকসজ্জা করা যাবে না বলে নির্দেশনা থাকলেও এই নির্দেশ কেউ মানে না। রোজায় ইফতারি তৈরি এবং বিক্রির জন্য নতুন নতুন দোকান গড়ে ওঠে। অস্থায়ী দোকানগুলোতে অবৈধভাবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। এতে গ্যাস-বিদ্যুতের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়। এতে ভোগান্তির শিকার হন নিয়মিত গ্রাহকরা। সূত্র জানায়, রমজানে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে সাম্প্রতিক বৈঠকেও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উৎপাদনকারী এবং সরবরাহকারীদের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, বিতরণের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করতে বলা হয়েছে। কোথাও যান্ত্রিক সমস্যা সৃষ্টি হলে দ্রুত তা সমাধানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এজন্য বিকল্প হিসেবে ট্রলি ট্রান্সফরমার প্রস্তুত রাখতে হবে। কোথাও ট্রান্সফরমার বিকল হলে বিকল্প দিয়ে সরবরাহ স্বাভাবিক রেখে মূল ট্রান্সফরমার ঠিক করতে বলা হয়। দেশে সান্ধ্যকালীন বিদ্যুৎ উৎপাদনের হিসাব হচ্ছে গড়ে সাত হাজার ৬৭৫ মেগাওয়াট। প্রাথমিক ব্যবহার এবং সঞ্চালন ক্ষতি বাদ দিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে ৬ হাজার ৫৩৬ মেগাওয়াট। চাহিদা চেয়ে ১১৩৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপন্ন হচ্ছে। তবে এটা প্রতিদিনের চিত্র নয়। কোনো দিন উৎপাদন বেশি হলে ঘাটতি কমে। উৎপাদন কম হলে ঘাটতি বাড়ে। এজন্য গড়ে ঘাটতির হিসাব করা হয়েছে এক হাজার মেগাওয়াট। উৎপাদন ও সরবরাহের এ অবস্থায় ইফতার, তারাবি ও সেহরির সময় বিদ্যুৎ সুবিধা স্বাভাবিক রাখতে সন্ধ্যায় এবং গভীর রাতে শিল্পকারখানা আংশিক বন্ধ রাখা হবে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ সময় শিল্পকারখানা বন্ধ থাকছে কিনা তা সংশ্লিষ্ট বিতরণ কোম্পানিগুলো তদারকি করবে। এছাড়া সপ্তাহে এলাকাভিত্তিক শিল্পকারখানা বন্ধ রাখার নিয়ম কঠোরভাবে প্রতিপালন করা হবে। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার সন্ধ্যাকালীন যে চাহিদার কথা বলছে, বাস্তবে তার আরও বেশি। একই সঙ্গে উৎপাদনের যে হিসাব দিচ্ছে বাস্তবে উৎপাদনও হচ্ছে এর চেয়ে অনেক কম। জানা গেছে অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আছে (বিশেষ করে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল) যাদের অনেক ইউনিট বন্ধ থাকলেও প্রতিদিন সেগুলো থেকে শত শত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ভুয়া উৎপাদন দেখানো হচ্ছে। এভাবে কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ চাহিদার সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ জানান, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা আর উৎপাদনে বিরাট ফারাক আছে। সত্যিকার অর্থে চাহিদা আর উৎপাদন কত এটা কেউ জানে না। তবে এটা সত্য, সরকার যা বলছে চাহিদাও তার চেয়ে বেশি, একইভাবে উৎপাদনের পরিমাণও সরকারের হিসাবের চেয়ে কম। কাজেই বর্তমান অবস্থায় কোনোভাবেই রজমানকে সামাল দেয়া যাবে না। সেহরি, ইফতার ও তারাবির সময় লোডশেডিং মুক্ত করা সম্ভব হবে না। ঢাকা ওয়াসা বর্তমানে চারটি পানি শোধনাগার ও ৬৭৫টি গভীর নলকূপের সাহায্যে উত্তোলনের পর নগরীতে পানি সরবরাহ করছে। রমজান উপলক্ষে আরও ১০টি গভীর নলকূপ চালু করা হবে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সময় পানির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য সাড়ে ৪শ’ জেনারেটর দেয়া হতে পারে। এছাড়া ২২০টি পানির পাম্পে রয়েছে বৈদ্যুতিক দ্বৈত সংযোগ। রমজানে ৪৬টি পানির গাড়ি ও ১৯টি ট্রাক্টর কাজ করতে পারে পানি পরিবহনে। ইফতার ও সেহরির সময় টার্মিনাল ও জনবহুল এলাকায় প্লাস্টিক পানির ট্রাংক ও ট্রলির মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হবে। পানি সরবরাহ পরিস্থিতি তদারক করতে গঠন করা হবে ভ্রাম্যমাণ দল। তারা কাজ করবে নগরীতে। তবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক না থাকায় সিদ্ধান্তগুলো এখনও নেয়া যায়নি। নগরবাসীর অভিযোগ, এখনই রাজধানীর অর্ধেক এলাকায় পানি সংকট চলছে। মিরপুরসহ পুরান ঢাকার অনেক এলাকায় পানি নেই। এসব এলাকার সমস্যা এতটাই প্রকট এগুলো জোড়াতালি দিয়ে ঠিক করা যাবে না। ডেবে যাওয়া ও সরু হয়ে যাওয়া লাইনে পানি যাচ্ছে না। রজমানে এসব এলাকার মানুষজনকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ১৫ থেকে ২০ কোটি লিটার পানির ঘাটতি রয়েছে। ৫ কোটি লিটার পানি তোলা যাচ্ছে না বিদ্যুৎ সংকটের কারণে। বর্তমানে পানি সংকটের ৬০ ভাগ কারণ হচ্ছে বিদ্যুৎ সংকট। ওয়াসার দাবি অনুযায়ী পানি উৎপাদন হলেও কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুতের কারণে তা সাপ্লাই পাইপে দেয়া যাচ্ছে না। বারবার বিদ্যুতের অফ-অন হওয়ায় পানি ওয়াসার লাইনে দেয়া যাচ্ছে না। এ কারণে বাসাবাড়ির পানির লাইন শুকনো থাকছে।
No comments:
Post a Comment