ফিলিস্তিনের আকাশে একটু পর পর ছুটে আসছে ইসরায়েলি জঙ্গি বিমান। গাজাবাসীর মাথার ওপর ফেলে যাচ্ছে বোমা। আরও বোমা ফেলার হুমকি দিয়ে গাজার মানুষকে বলা হচ্ছে, বাড়িঘর ফেলে সরে পড়তে। কিন্তু কোথায় যাবে গাজাবাসী? একান্ত নিরাপদ যে ঘর সেখানে, আর ঘরের বাইরে পথেঘাটে কখন কোথায় বোমা পড়বে, তা তারা জানে না। খবর বিবিসি, রয়টার্স ও এএফপির। এর পরও ঘর ছেড়ে জীবন হাতে নিয়ে পালাচ্ছে গাজার মানুষ। গাজার বাসিন্দা সাওলা আল ত
িবি তাঁদেরই একজন। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, ‘পথে পা বাড়ানোর পর নিরাপত্তা বলে আর কিছু নেই ... পুরো গাজা উপত্যকা এখন জ্বলছে।’ বাড়ি, হাসপাতাল, ধর্মস্থান, সাধারণ বসতি কিংবা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ভেতর—সর্বত্রই বোমা ফেলেছে ইসরায়েল। জ্বলন্ত গাজায় ঝরছে প্রাণ। মরছে নিরীহ নারী-পুরুষ আর নিষ্পাপ শিশুরা। ঘরের কোণে মায়ের কোলে থাকা শিশুর প্রাণ যাচ্ছে আকাশ থেকে ফেলা বোমায়, বাবার হাত ধরে পথে নামা শিশুও মরছে একইভাবে। অনেক আদরের ছোট্ট সোনার ছোট্ট শরীরটি সাদা কাপড়ে মুড়ে মা তুলে দিচ্ছেন বাবার হাতে, দাফন করতে। কাঁদছে সবাই। কখনো-বা কাঁদার মতো কেউ থাকছে না, পরিবারের ছোট-বড় সবাই মিলে চাপা পড়ছেন বিমান হামলায় ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসাবশেষের নিচে। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলা গতকাল সোমবার সপ্তম দিনে পড়েছে। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী এই এক সপ্তাহে বিমান থেকে ফেলা বোমায় নিহত হয়েছে অন্তত ১৭৩ জন। এদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এ ছাড়া আহত হয়েছে এক হাজার ২৬০ জন। আর জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা জানিয়েছে, ‘জঙ্গিদের’ লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হচ্ছে বলে ইসরায়েলের দিক থেকে বলা হলেও হামলায় এ পর্যন্ত যারা নিহত হয়েছে, তাদের ৭৭ শতাংশ নিরীহ মানুষ। এক সপ্তাহের এই হামলায় প্রায় এক হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে পালানো প্রায় ১৭ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে জাতিসংঘের শিবিরে। গাজার অবস্থা বোঝাতে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি ম্যানুলে হাস্সাসিয়ান বিবিসিকে বলেন, ‘কোনো আশ্রয় নেই, নেই বাঙ্কার। যাওয়ার কোনো জায়গা নেই ঘর ছাড়া। আর ঘর ছেড়ে বের হলেই তারা মারা পড়বে রাস্তায়। সব মিলিয়ে গাজায় এক ভয়াবহ মানবিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।’ গাজাবাসীর এই দুরবস্থার জন্য ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসকেই দায়ী করছে ইসরায়েল। তারা বলছে, হামাসের জঙ্গিরা গাজা থেকে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে রকেট ছুড়ছে। তাদের শায়েস্তা করতেই বাধ্য হয়ে বিমান হামলা চালাতে হচ্ছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস টেলিভিশনকে বলেছেন, ‘দুর্ঘটনাক্রমে যেসব বেসামরিক লোকজন মারা পড়ছে, তাদের জন্য আমরা দুঃখিত। কিন্তু এসব হতাহতের জন্য হামাসই পুরোপুরি দায়ী।’ ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েলের সর্বশেষ এই হামলার সূত্রপাত ইসরায়েলি তিন কিশোরকে সম্প্রতি অপহরণ ও হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। হামাসই ওই ঘটনা ঘটায় বলে মনে করে ইসরায়েল। তবে হামাস তা অস্বীকার করে। পরে ফিলিস্তিনি এক কিশোরকে একইভাবে হত্যা ও অপহরণের পর উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়। এরপর গাজা থেকে রকেট ছোড়া হচ্ছে, এমন দাবি তুলে ‘অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ’ শুরু করে ইসরায়েল। কয়েক দিনের বিমান হামলার পর গত শনিবার রাতে স্থল অভিযানে নামে ইসরায়েলি নৌ কমান্ডোরা। পাল্টা জবাব দিতে গাজা থেকে রকেট ছোড়া হচ্ছে। কিন্তু এতে ইসরায়েলি কোনো নাগরিক নিহত হয়েছে বলে এখনো জানা যায়নি। গাজা উপত্যকায় প্রায় একতরফা এই নৃশংসতায় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। হামলা বন্ধে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘসহ পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। চাপও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে অভিযান অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। যদিও শনিবার রাতের পর গত রোববার বা গতকাল সোমবার আর স্থল অভিযান চালানো হয়নি। কিন্তু সীমান্তের কাছে সেনা সমাবেশ ও গোলাবারুদসহ সাঁজোয়া যান বৃদ্ধি করছে ইসরায়েলি বাহিনী। যেকোনো সময় তারা ঢুকে পড়তে পারে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে। ইসরায়েলের দিক থেকে তেমন হুমকিও দেওয়া হয়েছে। বাড়িঘর ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে ঠাঁই নেওয়ার ‘উপদেশ’ দিয়ে রোববার গাজার বেইত লাহিয়া শহরে আকাশ থেকে লিফলেট ফেলে ইসরায়েলি জঙ্গি বিমান। এরপর ওই শহরের ৭০ হাজার বাসিন্দার প্রায় এক-চতুর্থাংশ শহর ছেড়ে পালিয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। রোববার সন্ধ্যায় ইসরায়েলের মন্ত্রিসভার বৈঠকে স্থল অভিযান আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বিমান হামলা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয় বলে জানিয়েছে গণমাধ্যম। এরপর ওই রাতে গাজার প্রায় ৪০ লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলা চালায় ইসরায়েলি জঙ্গি বিমান। এতে নিহত হয় দুজন। আর গতকাল সকালে গাজার উপকূলবর্তী এলাকায় হামাসের সামরিক শাখা কাশেম ব্রিগেডের তিনটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে বিমান থেকে বোমা ফেলা হয়। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি। এ ছাড়া বিমান হামলা হয় গাজার দক্ষিণে দায়ার আল-বালাহ এলাকা ও উত্তরের জাবালিয়া শহরের একাধিক ভবন লক্ষ্য করে। এতে অনেকেই আহত হয়। আর আগের দিন যে শহরের বাসিন্দাদের সরে যেতে বলা হয়েছিল সেই বেইত লাহিয়া শহরে গতকাল দফায় দফায় বিমান হামলা হয়। অন্যদিকে ইসরায়েলি বাহিনী গতকাল দাবি করে, গাজার উত্তরাংশ থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে উপকূলীয় এলাকায় একটি চালকবিহীন বিমান (ড্রোন) ধ্বংস করেছে তারা। ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে বিমানটি ধ্বংস করা হয়। এটি হামাসই ব্যবহার করছিল বলে দাবি করে ইসরায়েলি বাহিনী। একই সঙ্গে তারা জানায়, ইসরায়েল সীমান্তবর্তী লেবানন ও সিরীয় ভূখণ্ড থেকে গতকাল রকেট ছোড়া হয়েছে। এর জবাবে ইসরায়েলি বাহিনী গোলা নিক্ষেপ করেছে। এই অবস্থায় ফিলিস্তিনের মানুষকে রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সুরক্ষার দাবি জানিয়েছে আরব লিগ। মিসরের কায়রোতে গতকাল আরব লিগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক জরুরি বৈঠক থেকে এই দাবি তোলা হয়। গাজার নৃশংসতা থামাতে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করছে মিসরসহ অনেক দেশ। কিন্তু জাতিসংঘের মহাসচিব মান কি মুন শুধু একবার আহ্বান জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতি। বলেছেন, হামলা বন্ধ করতে। আর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ শনিবার একটি বিবৃতি দিয়েছে হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে। এর আগে ২০১২ সালের নভেম্বরে গাজায় অভিযান চালায় ইসরায়েল। তখন আট দিনের মাথায় মিসরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে ফিলিস্তিনের দুই অংশ পশ্চিম তীর এবং গাজা ২০০৭ সালের আগস্টে চলে যায় দুটি দলের নিয়ন্ত্রণে। সেই থেকে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে ফাতাহ পশ্চিম তীরে ও খালেদ মেশালের নেতৃত্বে হামাস গাজা শাসন করছিল। এই অবস্থায় গত এপ্রিলে দুই দলের মধ্যে একটি চুক্তি হয়, সে অনুযায়ী নতুন করে নির্বাচনের পর চলতি বছরের শেষ নাগাদ একটি জাতীয় সরকার গঠনের কথা। কিন্তু হামাস-ফাতাহর চুক্তিকে ভালোভাবে নেয়নি ইসরায়েল। তাদের মতে, হামাস একটি জঙ্গি সংগঠন। হামাস-ফাতাহ জাতীয় ঐক্যের সরকার হলে সেই সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় যাবে না বলে জানিয়ে দেয় ইসরায়েল। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের জন্য ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের শুরু। এর পর থেকে নিয়মিত রক্ত ঝরলেও আজও তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বাধীন সত্তা মেনে নিতে রাজি নয় ইসরায়েল।
No comments:
Post a Comment