ঈদের আগে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতন-বোনাস নিয়ে আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন মালিকরা। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক চুন্নুরও আশা- ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে পোশাক শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে সরকারের আগাম সতর্কতা ছিল বলে জানান তিনি। মালিকদের আশঙ্কা, এ বছর বড়জোর ১৫টি কারখানায় সমস্যা হতে পারে, তবে এটা গোটা খাতের সমস্যা নয়। গতকাল মঙ্গলবার সকালে দেশের অন্যতম শীর্ষ জাতীয় দৈনিক কালের কণ
্ঠ আয়োজিত ‘পোশাক শ্রমিকের বেতন বোনাস : প্রেক্ষিত ঈদ উৎসব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলনের সঞ্চালনায় বৈঠকে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক আইএফআইসি ব্যাংক। এ ছাড়া মিডিয়া পার্টনার ছিল ৭১ টেলিভিশন, এবিসি রেডিও এবং বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম। শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঈদের আগেই বেতন-বোনাস দেওয়ার বিষয়ে সরকার আগে থেকে সতর্ক ছিল। ইতিমধ্যে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক হয়েছে। আগামী ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, শ্রম আইনে উল্লেখ না থাকায় উৎসব-ভাতা নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে এর নিরসনে প্রথা অনুসারে মালিকরা সমাধান বের করবেন। বিষয়টি আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে শ্রমিক নেতাদের প্রতি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বৈঠকে পোশাক খাতে যড়যন্ত্র বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সারা বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় এবং আগামী দিনে এক নম্বর হতে চায়। তাই প্রতিযোগী দেশগুলো ষড়যন্ত্র করতেই পারে। তিনি জানান, শিগগির গৃহ শ্রমিকদের বিষয়ে আইন প্রণয়ন করা হবে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এবং পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনিসুল হক বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পের মজুরি নিয়ে যে সংকট ছিল এর অনেকটাই কেটে গেছে। ঈদের আগে বেতন-বোনাস দেওয়ার বিষয়টি কয়েক বছর ধরে বেশ ইতিবাচক। তিনি বলেন, এ বছর মাত্র ১৫টি কারখানায় বোনাস দিতে না পারার আশঙ্কা করছে বিজিএমইএ। ২০১৩ সালে ১৩টি, ২০১২ সালে ৩২টি, ২০১১ সালে ২২টি, ২০১০ সালে ১১টি এবং ২০০৯ সালে ৩১টি প্রতিষ্ঠান বেতন-বোনাস দিতে পারেনি। বিজিএমইএর সহসভাপতি রিয়াজ বিন মাহমুদ সুমন বলেন, গত ১৫ জুলাই শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বিজিএমইএর বৈঠক হয়েছে। এতে কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব কার্যকর করার চেষ্টা করছেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘প্রতি ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে একটা সংকট দেখা দেয়। আশা করি, প্রতিবারের মতো এবারও এ সংকট কেটে যাবে।’ তিনি আলোচকদের উদ্দেশে বলেন, শুধু পোশাক শ্রমিক নয়, নির্মাণ শ্রমিক ও মিডিয়াকর্মীসহ সব শ্রমিক-কর্মচারীর অধিকার নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। বিকেএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও ঈদের আগেই বেতন-বোনাস পরিশোধ করা হবে। বৈঠকে উত্থাপিত বোনাস নিয়ে নির্দিষ্ট বিধানের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, যে প্রতিষ্ঠান লোকসানে থাকবে তার পক্ষে বোনাস দেওয়া সম্ভব নয়। তাই শ্রম আইনে বোনাস নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। মালিকরা সামর্থ্য অনুযায়ী বোনাস দিয়ে থাকেন। কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘বাংলাদেশকে সারা পৃথিবীতে যে খাতটি পরিচিতি এনে দিয়েছে তা আমাদের গার্মেন্টশিল্প। আমাদের মেয়েরা পায়ের তলায় শক্ত মাটি পেয়েছে। ৪০ লাখ মানুষ এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। একটি শিল্প যখন বড় হয়ে ওঠে তার সঙ্গে নানা সমস্যাও তৈরি হয়। আমরা যদি একটু সচেতন হই, তাহলে এ শিল্পকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘যখনই ঈদ আসে, তখনই পোশাক কারখানায় কিছু সমস্যা আমরা দেখি। অনেক মালিক কারখানায় তালা দিয়ে চলে যান। শ্রমিকদের বেতন-বোনাস হয় না। তারা রাস্তায় চলে আসে। অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। আমরা কোনোভাবেই এ সমস্যা দেখতে চাই না। মালিকপক্ষের কিছু সমস্যা আছে, শ্রমিকদেরও সমস্যা আছে। এসবের পরও আমরা শ্রমিকদের বেতন-বোনাসের নিশ্চয়তা চাই।’ বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, ‘তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের জন্য তথ্য-ব্যাংক থাকা জরুরি। এটা না থাকায় রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর একজন হিন্দুকে দাফন আর একজন মুসলমানকে দাহ করার মতো ঘটনা ঘটছে।’ তিনি গার্মেন্টশিল্পের অবস্থা ইতিবাচক মন্তব্য করে বলেন, মালিক-শ্রমিক দূরত্ব অনেক কমে এসেছে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সৈয়দ আহমেদ বলেন, ‘শ্রম আইনে বোনাস দেওয়ার কোনো বিধান না থাকলেও মালিকরা দিচ্ছেন। মালিকরা ঈদ করবেন আর শ্রমিকরা খালি হাতে ফিরে যাবেন, সেটা যাতে না হয় এ জন্য অনেক আগে থেকেই বোনাস দেওয়া হচ্ছে। যেসব কারখানা বিজিএমইএর সদস্য নয় তাদের নিয়েই যত সমস্যা। আমরা সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের অনুরোধ করেছি, তাঁরা যেন সেসব মালিকের সঙ্গে বসে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস নিশ্চিত করেন।’ কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামাল বলেন, ‘গার্মেন্টশিল্পের শুধু নেতিবাচক দিক নয়, অনেক ইতিবাচক দিকও আছে। বিভিন্ন দেশে গিয়ে যখন মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা পোশাক দেখি তখন গর্বে বুক ভরে ওঠে। একসময় কথা উঠেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি-সুবিধা না পেলে এ শিল্প ধসে পড়বে। কিন্তু বাংলাদেশের পোশাকের মান ভালো হওয়ায় জিএসপি প্রত্যাহারের পরও আমাদের রপ্তানি বেড়েছে। কিন্তু এ শিল্প নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র আছে। প্রতিবেশী দেশগুলো, যারা গার্মেন্টশিল্পে বাংলাদেশের সমান্তরালে চলছে, তারা কখনো চায় না এ দেশ স্বাবলম্বী হোক।’ তিনি মালিকদের প্রতি যথাসময়ে শ্রতিকদের বেতন-বোনাস দিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, বর্তমান সরকার শ্রমিকদের সন্তোষজনক মজুরির ব্যবস্থা করতে সক্ষম হলেও কয়েক বছর ধরে ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। তাই একটা নীতিমালা দরকার। এটা হলে এমন ঝামেলা হতো না। এ ছাড়া বোনাসের ক্ষেত্রে বৈষম্য লক্ষ করা যায়। একেক প্রতিষ্ঠান একেক রকম নিয়ম অনুসরণ করে। এ বৈষম্য দূর হওয়া জরুরি। শিল্পাঞ্চল পুলিশের মহাপরিচালক আব্দুস সালাম বলেন, ২০১৩ সালের শ্রম আইনের সংশোধনীতে শ্রমিকের বেতন ও বোনাস নিয়ে একটি নির্দিষ্ট নীতিমালার কথা বলা হয়েছে, তাতে মালিক-শ্রমিক সমঝোতার মাধ্যমে ঈদের আগে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বোনাস বা উৎসব ভাতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাই মালিক, শ্রমিক ও সরকার মিলে যদি ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়, তাহলে গার্মেন্টশিল্প আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে। গামেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, গত ২০ রমজান পর্যন্ত ৮৫ শতাংশ কারখানার মালিকরা ঈদের আগে-বেতন বোনাস দিতে পারবেন- এমন প্রতিশ্রুতি দিতে পারেননি। আর পিস রেটে কাজ হয় যেসব কারখানায়, সেগুলোতে বেতন-বোনাস একেবারেই অনিশ্চিত। সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, ‘আগামী ২৬ জুলাইয়ে বেতন-বোনাস দেওয়ার ডেডলাইন। ছোটখাটো কিছু সমস্যা হচ্ছে। এসব আমরা রাজপথে না এসে মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করেই সমাধান করছি। অনেক ক্ষেত্রে সমাধান হলেও কিছু ক্ষেত্রে হচ্ছে না, তা বিজিএমইএ প্রতিনিধিরা জানেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো ২৪ ও ২৬ জুলাই। এ দুই দিনে যদি সমস্যা না হয়, তাহলে আশা করি আর সমস্যা হবে না।’ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গার্মেন্টস শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক লুৎফুন্নাহার লতা বলেন, গার্মেন্ট সেক্টরে ষড়যন্ত্র আছে, কিন্তু কারা করছে, তা কোনোভাবেই প্রমাণিত হচ্ছে না। ষড়যন্ত্র থাকলে তা খুঁজে বের করতে হবে। তিনি ঈদের দশ-পনেরো দিন আগে বোনাস দেওয়ার ব্যবস্থা করার দাবি জানান। বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি এম নুরুল হক বলেন, ‘গার্মেন্টশিল্পের শুরুটা স্ব-উদ্যোগে হলেও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আজ এ শিল্প বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করছে। অন্যদিকে শ্রমিকরা যে বেতন-বোনাসের জন্য রাস্তায় নামেন সেটা আমরা কেউ চাই না।’
No comments:
Post a Comment