Wednesday, July 23, 2014

চাঁদাবাজদের কবজায় রাজধানীর ফুটপাত:কালের কন্ঠ

রাজধানীর মূল সড়কের প্রায় সব ফুটপাত চাঁদাবাজদের দখলে। আর এই চাঁদাবাজির লাগাম আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, স্থানীয় রাজনীতিক ও সন্ত্রাসীদের হাতে। সারা বছরই চলে চাঁদাবাজি। তবে ঈদের সময় চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। প্রায় দেড় শ কিলোমিটার ফুটপাতে বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলছে এখন। কারণ নিয়মিত চাঁদার সঙ্গে ‘উপরি’ বা ‘বকশিশ’ যোগ হয়েছে ঈদ উপলক্ষে। টাকা না মিললে নানাভাবে হয়রানি করা হয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। প্রায়ই তাঁদে
র গ্রেপ্তার করে চালান করে দেয় পুলিশ। ফুটপাতের পাশাপাশি মার্কেটের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্ট থানার ওসি থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত চাঁদার ভাগ পান। ফলে পুলিশের কাছে বারবার অভিযোগ করেও চাঁদাবাজির বিষয়ে কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। এক সপ্তাহ ধরে ঢাকার বিভিন্ন ফুটপাত এবং কয়েকটি মার্কেটে সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে। শুধু চাঁদাবাজিই নয়, কোনো কোনো এলাকার ফুটপাতের দোকানের পজেশনও বিক্রি হয়। এক মাসের জন্য ২৫ হাজার থেকে এক লাখ টাকায়। অনুসন্ধানকালে পল্টন, উত্তরা, সদরঘাট, নিউ মার্কেট, মিরপুর, মতিঝিল প্রভৃতি স্থানে দেখা গেছে, প্রকাশ্যেই চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। চাঁদা তুলছে লাইনম্যান বা সোর্সরা। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, তারা পুলিশ, স্থানীয় রাজনীতিক ও সন্ত্রাসীদের নির্দিষ্ট ভাগ বুঝিয়ে দেয়; নিজেরাও একটা অংশ পায়। মাঝেমধ্যে রাজনীতিক ও সন্ত্রাসীরা নিজেরাই টাকা তোলে। আবার কিছু স্থানে চাঁদাবাজি হয় গোপনে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে ফায়দা লুটছে চাঁদাবাজরা। তাদের দৌরাত্ম্যে ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দিশাহারা। কয়েক জায়গায় বড় রাজনীতিকদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুরান ঢাকায় (ডিসিসি দক্ষিণ) ক্ষমতাসীন দলের একজন বড় নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণ ও তাদের কাছ থেকে বখরা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর গাবতলী-মিরপুরে (ডিসিসি উত্তর) একজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদার বখরা নেওয়ার জোরালো অভিযোগ রয়েছে। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানের এলাকাগুলোর ফুটপাতের দোকান থেকে মাসে চাঁদা উঠছে প্রায় ১৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। প্রতিদিন চাঁদা আদায় হয় প্রায় ৪৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। আবার দোকানের ‘পজেশন’ বিক্রি করে মাসে আয় হয় এক কোটি টাকা। হকার্স সমিতির সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর অলিগলি পর্যন্ত বিবেচনায় নিলে ব্যবসার স্পট আছে দুই হাজারেরও বেশি। সব মিলিয়ে দিনে প্রায় ৬০ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এ হিসাবে মাসে ১৮ কোটি এবং বছরে ২১৬ কোটি টাকা রাজধানীর চাঁদাবাজদের পকেটে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, যদি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বৈধভাবে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে এ টাকা সরকারের রাজস্ব খাতে জমা হতো। সেই ব্যবস্থা না থাকায় সরকার বছরে ২০০ কোটিরও বেশি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। বিপরীতে চাঁদাবাজদের পকেট ভারী হচ্ছে। মেয়র হানিফের আমলে ওসমানী উদ্যান, মুক্তাঙ্গন, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, মিরপুর, শাহ আলী, পান্থপথ ও আজিমপুর- এই আটটি এলাকায় হকারদের পুনর্বাসনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে মোট ২০টি এলাকায় পুনর্বাসনের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু কোনো প্রস্তাবই আলোর মুখ দেখেনি। রাজধানী ঢাকার সদর রাস্তাগুলোর ফুটপাতে দোকান আছে ৭৫ হাজারের মতো। তবে বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী দোকানের সংখ্যা দুই লাখ ৬০ হাজার। উত্তরার আবদুল্লাহপুর থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত ফুটপাতে দোকান আছে সহস্রাধিক। সেখানে প্রতি দোকান থেকে গড়ে ৬০ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। এ হিসাবে প্রতিদিন চাঁদা তোলা হয় ৬০ হাজার টাকা। মাসে উঠছে ১৮ লাখ টাকা। ওই এলাকার চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে উত্তরা থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক এস এম মাহবুব আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে কেউ চাঁদাবাজি করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমার জানা মতে, স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মী চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নেই। আর পুলিশের চাঁদাবাজির ব্যাপারে আমি কোনো কথা বলব না।’  উত্তরার মাসকট প্লাজা ও নর্থ টাওয়ারের সামনের ফুটপাতে শাসক দলের কতিপয় নেতার নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয়েছে একটি মিনি মার্কেট। এটির দেখাশোনা করেন যুবলীগ নেতা কবির হোসেন ওরফে বরিশাইল্যা কবির ও তাঁর ভাগিনা আলম এবং গফুর, সেলিম, খোকন, কায়েস, মিন্টু, ফেরদৌস, কায়েস, বাবু, জসীম ও হেলাল। নেতৃত্বে রয়েছেন খোকন, কায়েস, বাবু ও সেলিম। সেখানে রয়েছে শতাধিক জামাকাপড়ের দোকান। আরো জানা গেছে, এলাকার সংসদ সদস্যের নাম ভাঙিয়ে উত্তরা ১১, ১২, ৭, ৩, ৪ ও ৬ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, মার্কেট ও ফুটপাতের দোকান থেকে নিয়মিত নির্দিষ্ট হারে চাঁদা তোলা হচ্ছে। সন্ধ্যার পর চাঁদাবাজরা মোটরসাইকেলে করে চাঁদা তুলতে আসে। প্রতিটি দোকান থেকে আদায় করা হয় দেড় শ থেকে আড়াই শ টাকা। সেখানে পুলিশের পক্ষে চাঁদা তুলছে লাইনম্যান ও সোর্সরা। উত্তরা পশ্চিম ও উত্তরা মডেল থানার ওসি থেকে শুরু করে কনস্টেবল- সবাই চাঁদার ভাগ পাচ্ছেন। উত্তরা পশ্চিম থানার সেকেন্ড অফিসার মামুুনের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ ফুটপাতের দোকান থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা তোলে বলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন। মাসকট প্লাজার সামনে দোকান নিয়ে বসেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী করিম মিয়া। তিনি বলেন, ‘প্রথম রমজানেই চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। থানার পুলিশ, ডিবিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন, রাজনৈতিক নেতা ও সন্ত্রাসীরা চাঁদা আদায় করে। কিছুদিন আগে টাকা না দেওয়ায় আমাকে পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, মালপত্রও নিয়ে যাওয়া হয়। পরে টাকা দিলে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রায় ১০ হাজার টাকার মাল আর ফেরত দেয়নি তারা।’ তিনি আরো বলেন, ‘সাংবাদিক পরিচয় দিয়েও টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে তারা রিপোর্ট করে দেবে বলে হুমকি দেয়।’ চাঁদা না দিলে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, মালপত্র গায়েব করে ফেলে। পেটের দায়ে চাঁদা দিয়েই ব্যবসা চালাতে হচ্ছে। এ ছাড়া উপায় নেই। এ প্রসঙ্গে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার থানার কোনো সদস্য ফুটপাত বা কোথাও থেকে চাঁদা আদায় করার সাহস পায় না। থানার প্রত্যেক সদস্যকে মনিটর করা হয়। যেসব অভিযোগ আসছে সেসব মোটেও সত্য নয়।’ নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, নীলক্ষেত, আজিমপুর, ঢাকা কলেজের সামনের রাস্তা, চাঁদনী চক এলাকার ফুটপাতে দোকান আছে ১০ হাজারের মতো। চাঁদাবাজরা প্রতিদিন প্রতি দোকান থেকে গড়ে ৭০ টাকা করে চাঁদা নিচ্ছে। এ হিসাবে প্রতিদিন চাঁদা তোলা হচ্ছে সাত লাখ টাকা। মাসে উঠছে দুই কোটি ১০ লাখ টাকা। ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেট-সংলগ্ন ফুটপাতের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, তাঁরা ঢাকা কলেজের ছাত্র নামধারী চাঁদাবাজদের হাতে জিম্মি। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তখন সে দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মী পরিচয় দিয়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হয়। এখন ঈদ সামনে রেখে তারা চাঁদার রেট বাড়িয়ে দিয়েছে। চন্দ্রিমা সুপারমার্কেটের ব্যবসায়ী জালাল মোল্লা জানান, চাঁদাবাজদের অত্যাচারে তাঁরা অতিষ্ঠ। চাঁদাবাজরা পোশাকসামগ্রী পর্যন্ত লুটে নিচ্ছে। পুলিশ ও র‌্যাবকে জানানোর পরও কোনো কাজ হচ্ছে না। আবার পুলিশের সোর্সদের নিয়মিত টাকা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি দোকান থেকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। সন্ধ্যার পর চাঁদাবাজদের আনাগোনা বেড়ে যায়। ওই এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয়দানকারী দুলাল মিয়া, রমজান আলী, হোসেন, কালা বাবু, জনি এবং পুলিশ সোর্স বাদশা, রহিম প্রমুখ। মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা সুপারমার্কেট, মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্স, কো-অপারেটিভ মার্কেট সোসাইটি, কুসুম এ বাগদাদ শপিং কমপ্লেক্স ও শাহ আলী শপিং কমপ্লেক্সে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মী পরিচয়ে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। পাশাপাশি ফুটপাত থেকে তোলা হচ্ছে চাঁদা। ওই সব জায়গায় চাঁদাবাজি করছে কালাম, আজম, গফুর, নয়ন, রুহুল আমিন, জুলহাস, টোকাই ফারুক, কালু, পুলিশের সোর্স কবির, মান্নান, মালেক প্রমুখ এবং হান্নান গ্রুপ। মিরপুর, পল্লবী, দারুস সালাম, কাফরুল, শাহ আলী এলাকায় ফুটপাতে দোকান আছে সাত হাজার। প্রতিদিন প্রতিটি দোকান থেকে গড়ে ৭০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এ হিসাবে প্রতিদিন চাঁদা উঠছে চার লাখ ৯০ হাজার টাকা। মাসে উঠছে এক কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এ প্রসঙ্গে মিরপুর থানার ওসি সালাহ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুলিশের নাম ভাঙিয়ে কেউ চাঁদা আদায় করলে তার নিস্তার নেই। ফুটপাতে যাতে কোনো ধরনের চাঁদাবাজি না হয় সে ব্যাপারে সজাগ আছি।’ গুলিস্তান, জিপিও, বায়তুল মোকাররম, পল্টন, সদরঘাট, সুন্দরবন স্কয়ার এলাকায় দোকান আছে ১৬ হাজারের মতো। প্রতি দোকান থেকে গড়ে ৫০ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিদিন চাঁদা উঠছে প্রায় আট লাখ টাকা। মাসে উঠছে দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা। জিপিওর সামনের ক্ষুদ্র দোকানি ফুল মিয়া বলেন, ‘চাঁদাবাজদের অত্যাচারে ঠিকমতো ব্যবসা চালাতে পারছি না। প্রতিদিন শাসক দলের ক্যাডার, সন্ত্রাসী ও পুলিশকে চাঁদা দিতে হচ্ছে। ঈদ ঘনিয়ে আসায় ওরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কোনো কোনো দোকান থেকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকাও আদায় করা হয়। গড়ে দোকানপ্রতি ৫০ টাকা তোলা হচ্ছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশের কাছে অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই। চাঁদার ভাগ তারাও পায়। এ ব্যাপারে পল্টন মডেল থানার ওসি মোরশেদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফুটপাতে যেন কেউ চাঁদাবাজি করতে না পারে সে জন্য কঠোর নজরদারি রয়েছে। আমি চাই হকারদের পুনর্বাসন করে সব কটি ফুটপাত দখলমুক্ত করা হোক। তাহলে ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজি শব্দটি চিরতরে বিদায় নেবে।’ জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু হকার্স মার্কেটের পাশের ফুটপাতের দোকানগুলো থেকে চাঁদা আদায় করছে লাইনম্যানদের সরদার আবুল, কালাম, দুলাল, আবদুস সালাম (শ্রমিক লীগ নেতা), বাবুল, হাসান, হারুন, জজ, কালা নবী ও ছোটন; পুলিশ সোর্স ফোরকান, দুলাল ও কালা মনির। গোলাপ শাহ মাজার থেকে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত রাস্তার ফুটপাতে চাঁদা আদায় করে রহিমের বাবা, রুহুল (হকার্স লীগ নেতা), কাইল্লা পাপ্পু, জনি, টোকাই মিজান, বাবু প্রমুখ। সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের সামনের ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করছেন চটপটি বাবু ও কবির। ফকিরাপুল, মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে টিকাটুলী মোড় পর্যন্ত ফুটপাত, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের রাস্তা ও বঙ্গভবনের উত্তর পাশের রাস্তার ফুটপাতের দোকান আছে ১০ হাজার। প্রতিটি দোকান থেকে প্রতিদিন গড়ে তোলা হচ্ছে ৬০ টাকা করে। এ হিসাবে প্রতিদিন চাঁদা উঠছে ছয় লাখ টাকা। মাসে উঠছে এক কোটি ৮০ হাজার টাকা। মতিঝিল আলিকো অফিসের সামনের ফুটপাতের ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক জানান, ‘ভাই, চাঁদাবাজির কথা বলে কি লাভ? পত্রিকায় লিখলেও কোনো কাজে আসে না। বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও মাস্তানদের চাঁদা দিয়ে আসছি। সবচেয়ে বেশি চাঁদা দিতে হয় থানা-পুলিশকে। এরপর আছে ডিবি পুলিশ।’ এ প্রসঙ্গে মতিঝিল থানার ওসি বি এম ফরমান আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার জানা মতে ওই সব এলাকায় কোনো চাঁদাবাজি হয় না। আর থানা-পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তা সত্য নয়।’ মতিঝিল এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন নুরুল ইসলাম, তাজু, বড় হারুন (আওয়ামী লীগ নেতা), লিটন, বাবু, সাইফুল ইসলাম, পুলিশ সোর্স রমজান, করিম মিয়া প্রমুখ। তেজগাঁও, ফার্মগেট, বেগুনবাড়ী, সাতরাস্তা, কাঁঠালবাগান, এফডিসি এলাকায় ফুটপাতে দোকান আছে আট হাজারের মতো। সেখানে প্রতিদিন চাঁদা আদায় করা হচ্ছে চার লাখ টাকা। মাসে উঠছে এক কোটি ২০ লাখ টাকা। ফার্মগেট এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় যুবলীগ নেতা পরিচয়দানকারী কানা দুলাল; লাইনম্যান হাফিজ ও হোসেন। ফার্মভিউ সুপারমার্কেটের সামনের ফুটপাতের ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন জানান, পুলিশ থেকে শুরু করে সবাইকে টাকা দিতে হয়। প্রতিদিন কোনো দোকান থেকে ৩০০ টাকা, কোনো দোকান থেকে ৫০ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তেজগাঁও থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমার জানা মতে, এলাকার ফুটপাতগুলোতে কোনো চাঁদাবাজি হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা তো কোনো অভিযোগ করছে না।’ কারওয়ান বাজার ও এর সংলগ্ন এলাকার ফুটপাতের দোকানের সংখ্যা প্রায় ৭০০। রেলগেট, সাতরাস্তা, ট্রাকস্ট্যান্ড ও এফডিসি গেটের পশ্চিম পাশে দোকানের সংখ্যা বেশি। এসব ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন সরদার কাদের, হানিফ ও সজিব। সেখানে প্রতি দোকান থেকে গড়ে ৬০ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। এ হিসাবে দৈনিক চাঁদা উঠছে ৪২ হাজার টাকা। আর মাসে উঠছে ১২ লাখ ছয় হাজার টাকা। কারওয়ান বাজার লা ভিঞ্চি রেস্তোরাঁর সামনের ফুটপাতের ব্যবসায়ী আবিদুর রহিম কালের কণ্ঠকে বলেন, আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে উঠতি মাস্তানরা নিয়মিত চাঁদা আদায় করে। আর পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের অত্যাচার তো রয়েছেই। সন্ত্রাসীদের মধ্যে সুইডেন আসলামের ছোট ভাই জাকির, পিচ্চি হান্নানের শ্যালক ছোট হান্নান ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ বেশি চাঁদা আদায় করে। বাড্ডা, রামপুরা, মৌচাক, শান্তিনগর, মালিবাগ মোড়, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও রেলগেট ও মালিবাগ রেলগেট এলাকায় ফুটপাতে দোকান আছে ১০ হাজার। প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক গড়ে ৫৫ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। এ হিসাবে দৈনিক চাঁদা উঠছে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর মাসে উঠছে এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা। ব্যবসায়ীরা জানান, মালিবাগ চৌরাস্তা এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন পুলিশ সোর্স মকবুল, আনোয়ার, মতি, আরশাদ ও খবির। মগবাজার নিয়ন্ত্রণ করে লাইনম্যান আজিজ, রুবেল। খিলগাঁও রেলগেট এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে সরদার আলাউদ্দিন, শফিক প্রমুখ। যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, ধোলাইপাড়, পোস্তগোলা, জুরাইন আলম মার্কেটের সামনের রাস্তার ফুটপাতে দোকান আছে পাঁচ হাজার। দৈনিক প্রতি দোকান থেকে গড়ে ৬০ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। প্রতিদিন তোলা হচ্ছে তিন লাখ টাকা। মাসে উঠছে ৯০ লাখ টাকা। জুরাইন আলম মার্কেটের সামনের ফুটপাতের হকার রফিক জানান, অনেককে চাঁদা দিতে হচ্ছে। পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতারাই বেশি সমস্যা করছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা-৪ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার এলাকায় কাউকে চাঁদাবাজি করতে দেব না। ফুটপাতে চাঁদাবাজি চিরতরে বন্ধ করা হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঈদের পর অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা হবে।’ যাত্রাবাড়ী থানার ওসি অবনী শংকর বলেন, ‘বাবা জন্ম দিয়ে থাকলে হলফ করে বলতে পারি, ফুটপাতের চাঁদাবাজির টাকা আমি খাচ্ছি না। থানার নাম ভাঙিয়ে কেউ যদি ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায় করে তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’ সরেজমিনে অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী এলাকায় সোনা মিয়া, জয়নাল, মনির, রাব্বি; ছাত্রলীগ নেতা চয়ন, লাইনম্যান মান্নান, সোনা মিয়া, অনু ও তোরাব এবং জুরাইনে সিরাজ তালুকদার, নুরুল ইসলাম, সেলিম প্রমুখ চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। মহাখালী, গুলশান ও বনানী এলাকার ফুটপাতে দোকান আছে আট হাজার। প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক গড়ে ৫০ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এ হিসাবে প্রতিদিন চাঁদা আদায় হচ্ছে চার লাখ টাকা। মাসে উঠছে এক কোটি ২০ লাখ টাকা। এ প্রসঙ্গে গুলশান থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চাঁদাবাজদের রুখতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমার থানার প্রতিটি সদস্যকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছি- কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।’ ফুটপাতে চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু ফুটপাত কেন, যেখানেই চাঁদাবাজি বা অন্য অপরাধ সংঘটিত হোক; অভিযোগ আসামাত্র ব্যবস্থা নেওয়া হয়। চাঁদাবাজির ঘটনায় পুলিশের কোনো সদস্য জড়িত থাকলে তাকে চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, চাঁদাবাজদের রুখতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফুটপাত ও এর সংলগ্ন এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি এম এ কাশেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চাঁদাবাজদের অত্যাচারে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দিশাহারা। প্রতিদিন সব কটি ফুটপাতের দোকান থেকে শাসক দলের নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাস্তানরা চাঁদা নিচ্ছে। সরকারের শীর্ষ মহলকে অবহিত করার পরও কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে সরকার মাসে কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে পারত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুনর্বাসনের ব্যাপারে আন্তরিক। কিন্তু একটি চক্র হতে দিচ্ছে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘টাকা না দিলে পুলিশ নানাভাবে হয়রানি করে। সবাই মিলে আমাদের পেটে লাথি মেরে যাচ্ছে।’ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্টভাবে অভিযোগ আসার পরও আমরা কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছি না তা সত্য। আর এর জন্য রাজনৈতিক নেতারা দায়ী। স্থানীয় অনেক নেতাই চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত। থানা-পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার সদস্যরাও টাকা আদায় করেন বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি। কিন্তু কাউকে হাতেনাতে ধরা সম্ভব হচ্ছে না।’ একজন লাইনম্যানের ভাষ্য : পাঁচ বছর ধরে গুলিস্তান ও জিপিও এলাকায় ফুটপাতের লাইনম্যান হিসেবে কাজ করেন দুলাল মিয়া। তিনি কখনো পল্টন, সূত্রাপুর ও মতিঝিল থানা-পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করেন। ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা তাঁকে চেনেন কানকাটা দুলাল হিসেবে। রবিবার দুপুরে গোলাপ শাহ মাজারের পূর্ব পাশে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে কথা বলতে। পরে রাজি হন। তিনি বলেন, ‘চাঁদাবাজি করতে ভালো লাগে না। একসময় গুলিস্তানে কাপড়ের ব্যবসা করতাম। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে থানা-পুলিশের টাকা তুলতে গিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিই। পরে নাম লিখিয়ে ফেলি চাঁদাবাজির খাতায়। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর দোকান থেকে টাকা তোলা হয়। থানা ও রাজনৈতিক নেতাদের নামে টাকা তুলি আমি। বড় সাইজের দোকান থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত তোলা হয়। কোনো দোকান থেকে ২০০ টাকা। তবে গড়ে ৫০ টাকা ওঠানো হয়। রমজানে চাঁদার রেট বেড়ে যায় কিছুটা। রাত ১১টার দিকে টাকা কালেকশন শেষ হয়। সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশের ক্যাশিয়ার ও একজন এসআই এসে তাঁদের ভাগের টাকা নিয়ে যান। আর থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’ তবে দুলাল রাজনৈতিক নেতাদের নাম জানাতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, ‘তাঁরা শাসক দলের নেতা। তাঁদের নাম ফাঁস করে দিলে জীবন শেষ হয়ে যাবে। থানা ও নেতাদের টাকা দেওয়ার পর প্রতিদিন আমার ভাগে থাকে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। মাঝেমধ্যে সন্ত্রাসীরা নিজেরা এসেই টাকা নিয়ে যায়। কোনো হকার টাকা না দিলে তাকে এলাকায় ব্যবসা করতে দেওয়া হয় না। চাঁদার ভাগ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও মহানগর পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের কাছেও যায়।’ দুলাল বলেন, ‘ফুটপাতের প্রতিটি পয়েন্টে তাঁর মতো অনেকেই লাইনম্যান হিসেবে কাজ করে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে চাঁদাবাজি আর থাকবে না। সরকারের কোষাগারে অনেক টাকা জমা পড়বে। আমাদের এ অবৈধ কাজ আর করতে হবে না।’ কথার শেষে তিনি অনুরোধ করেন, ‘ভাই, আমার নাম পত্রিকায় লিখে দিলেও আমাকে চিনিয়ে দেবেন না। তাহলে আমার খুব বিপদ হবে, ধরে নিয়ে মেরেও ফেলতে পারে।’

No comments:

Post a Comment