পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব রাবেয়া বেগম। রক্তের গ্রুপ ও পজিটিভ। ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি তিনি। চিকিৎসক জানিয়েছেন তার রক্তের প্রয়োজন। তাই স্বজনদের ছুটে চলা রক্তের সন্ধানে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে স্বজনদের একজন যান মহাখালীর ৬১/১ নম্বর আমতলী রোগী কল্যাণ ব্লাড ব্যাংকে। ওই ব্যাংকে ১৫০০ টাকায় মিলল এক ব্যাগ রক্ত। সাথে একটি টেস্ট রিপোর্টও দেয়া হয় ব্লাড ব্যাংক থেকে। এতে রক্তদানকারীর নামও দেয়া হয়। কিন্তু ওই রিপোর্টট
ি অনুসন্ধানে দেখা যায় রক্তদানকারী একজন মাদকাসক্ত। এ ছাড়া রিপোর্টে ডাক্তারের স্বাক্ষর করেছেন ব্লাড ব্যাংকের কর্মচারী ইকবাল। একই সময় ওই প্রতিষ্ঠানের অন্য কক্ষে তাজুল শেখ নামে এক বৃদ্ধ ক্যান্সার রোগীকে এ পজিটিভ রক্ত পুশ করা হচ্ছিল, যা দূষিত রক্ত। তাজুলের রক্তের রিপোর্টটিও ছিল ভুয়া। ব্লাড ব্যাংকে সব সময় ডাক্তার ও নার্স থাকা বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে তা থাকে না। অদক্ষরাই ব্যাংকটি পরিচালনা করছিল। ব্যাংকের লাইসেন্স থাকলেও লাইসেন্সের কোনো শর্তই মানছে না মালিকেরা এমন দাবি করেছে র্যাব। এভাবেই ব্লাড ব্যাংকের নামে কিছু অসাধু রক্ত ব্যবসায়ী দালালদের কমিশনের মাধ্যমে ভেজাল রক্ত বেচাকেনা করে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে। মাদকাসক্ত ও পেশাদার রক্তদাতাদের দূষিত রক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই চিকিৎসকদের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া রিপোর্টে ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে রক্ত বিক্রি করে আসছে। প্রতারণার এখানেই শেষ নয়, এক ব্যাগ রক্তে স্যালাইন মিশিয়ে দুই ব্যাগ রক্ত তৈরি করে বিক্রি করছে ব্যবসায়ীরা। বিক্রি করা হচ্ছে মেয়াদউত্তীর্ণ রক্তও। ফলে দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। সুস্থতার আশায় ব্লাড ব্যাংক থেকে কেনা রক্তে রোগীরা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে মারণব্যাধির মারাত্মক সব জীবাণু। অন্য দিকে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগও দেশজুড়ে রক্ত পরীা আর নিরাপদ রক্তের জোগান নিশ্চিত করতে পারছে না। ফলে দিন দিন বাড়ছে রক্তের ভয়ঙ্কর বাণিজ্য। জানা গেছে, রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় নামহীন অসংখ্য অবৈধ ব্লাড ব্যাংক গড়ে ওঠায় নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অবৈধ ব্লাড ব্যাংকগুলোয় প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ছাড়াই রক্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি সরকার অনুমোদিত অনেক ব্লাড ব্যাংকও রক্ত সংগ্রহে পাঁচটি সংক্রামক জীবাণু যেমন এইডস, হেপাটাইটিস এওবি, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও তা করছে না। এ ছাড়া ব্লাড ব্যাংকগুলোতে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, একজন দায়িত্বরত চিকিৎসক ও একজন টেকনিশিয়ান থাকা বাধ্যতামূলক হলেও অবৈধ ব্লাড ব্যাংকগুলোতে রয়েছে মালিক, কয়েকজন দালাল, একজন মার্কেটিং ম্যানেজার ও একজন অফিস কর্মচারী। বেশির ভাগ ব্লাড ব্যাংক গড়ে উঠেছে অপরিচ্ছন্ন কুঠুরিতে। তারা বেশির ভাগ রক্ত সংগ্রহ করে মাদকসেবীদের কাছ থেকে। জরুরি মুহূর্তে অনেকেই বিপদে পড়ে ভেজাল রক্ত কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। রক্তের অবৈধ ব্যবসায়ের অভিযোগে রাজধানীর মহাখালীর রোগী কল্যাণ ব্লাড ব্যাংকের চার মালিকসহ ছয়জনকে কারাদণ্ড দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। তারা হলেনÑ মালিক রবিউল ইসলাম, রিপন উদ্দিন, সাইদুল ইসলাম, আব্দুল আজিজ, কর্মচারী আনোয়ার কালু ও ইকবাল কবির। র্যাব সূত্র জানায়, বৈধ লাইসেন্স নিয়ে অবৈধ ব্যবসায় করে আসছিলেন রোগী কল্যাণ ব্লাড ব্যাংক কর্তৃপ। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব সদস্যরা গতকাল ওই ব্লাড ব্যাংকে অভিযান চালিয়ে ছয়জনকে আটক করে। এ সময় সেখান থেকে ৩২ ব্যাগ দূষিত রক্ত জব্দ করা হয়। পরে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ এম আনোয়ার পাশা চার মালিকসহ পাঁচজনকে দুই বছর করে ও কর্মচারী ইকবালকে এক বছরের কারাদণ্ড দেন। সিলগালা করে দেয়া হয় ব্লাড ব্যাংকটি। এ সময় স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিনিধি ডা: যোগেশ চন্দ্র রায় ও র্যাব-১ এর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। দণ্ডপ্রাপ্ত কর্মচারী ইকবাল জানান, কোনো প্রকার পরীক্ষা ছাড়াই মালিকের নির্দেশে তিনি মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে ডাক্তারের সই জাল করে রক্ত বিক্রি করেন। এ ছাড়া আনোয়ার কালু জানান, তিনি অশিক্ষিত হলেও গত ২০ বছর ধরে মাদকাসক্তদের রক্ত সংগ্রহ করে বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে বিক্রি করে আসছেন। ওই ব্লাড ব্যাংকের মালিক চারজন। ওই ব্লাডব্যাংকে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ৬১/১ নম্বর আমতলীর ওই ভবনটির দ্বিতীয়তলায় কয়েকটি রুমে পরিচালিত হতো ব্লাড ব্যাংক। কোনো চিকিৎসক, টেকনিশিয়ান, নার্স কারও দেখা মেলেনি। পিয়নরাই চিকিৎসকের স্বার জাল করে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করতেন। এক রুমে মাহবুব নামে এক মাদকাসক্তকে পাওয়া যায়। তিনি রক্ত বিক্রি করতে এসেছেন। তার শরীর থেকে আনোয়ার কালু রক্ত গ্রহণ করছিলেন। ওই ব্যাংকে এক ব্যাগ রক্তকে পানি ও স্যালাইন মিশিয়ে দুই ব্যাগ করা হতো। র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ এম আনোয়ার পাশা জানান, ব্লাড ব্যাংকটিতে অভিযানের সময় অভিযুক্তরা পেশাদার রক্তদাতা ও মাদকসেবীদের কাছ থেকে রক্ত গ্রহণ করছিল। পরীক্ষা ছাড়াই ডাক্তারের জাল রিপোর্ট তৈরি করে রক্ত বিক্রয়ের সময় অভিযুক্তরা হাতেনাতে ধরা পড়ে। রক্তের পাঁচটি পরীক্ষা বাধ্যতামূলক(এইডস, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, সিফিলিস ও ম্যালেরিয়া) হলেও শুধু গ্রুপ পরীক্ষা করা হয়। ফলে এ রক্ত অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, অভিযুক্তরা জানান, মাদকসেবীরা মাত্র দুই থেকে আড়াই শ’ টাকার বিনিময়ে তাদের কাছে রক্ত বিক্রি করে। এ রক্ত তারা বিভিন্ন কিনিক ও হাসপাতালে দেড় থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করে। এ কারণে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন, ২০০২ অনুযায়ী ব্লাড ব্যাংকের চার মালিকসহ পাঁচজনকে দুই বছর করে ও এক কর্মচারীকে এক বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ব্লাড ব্যাংকটি সিলগালা করে বন্ধ করা হয়েছে। তিনি জানান, এরূপ অপরাধে র্যাবের মোবাইল কোর্ট ইতোমধ্যে ২৮টি অভিযানে ৫৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও জরিমানা করে এবং ব্লাড ব্যাংক সিলগালা করা হয়। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এ টি এম হাবিবুর রহমান বলেন, সারা দেশে ৭৭টি বেসরকারি ব্লাড ব্যাংকের অনুমোদন রয়েছে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত কিছু অসাধু ব্লাড ব্যাংকের অপতৎপরতা স্বাস্থ্য খাতকে অনিরাপদ করে তুলছে। সাধারণ মানুষের রক্ত প্রদানে ভীতি ও অবহেলার কারণে পেশাদার রক্তদাতাদের ওপর নির্ভর করে এসব অসাধু ব্লাড ব্যাংকগুলো ব্যবসায় করছে।
No comments:
Post a Comment