ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়েও ঠেকানো যাচ্ছে না বেপরোয়া অপরাধীদের। হত্যাকাণ্ড, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে। প্রতিবছরই রমজানে নাগরিকদের স্বস্তি দিতে নিরাপত্তা বাড়ায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের নিরাপত্তাব্যবস্থা ব্যাপক। এরই মধ্যে ঢাকায় তিন ছিনতাইকারী মারাও গেছে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’। কিন্তু রমজানের শুরু থেকেই
ঢাকায় খুন, অপহরণ, ছিনতাই ও ধর্ষণের মতো অপরাধ ঘটছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে পাওয়া অপরাধসংক্রান্ত মাসিক পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মে মাসের তুলনায় জুনে অপরাধ বেড়েছে ৩৩৭টি। মার্চের তুলনায় এপ্রিলে অপরাধ বেড়েছে দুই হাজার ৪২৮টি। ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে বেড়েছে দুই হাজার ২২৬টি অপরাধ। তবে এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে অপরাধ সামান্য কমেছে। এ ছাড়া চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনে বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার। অপরাধীদের হাত থেকে রেহাই মিলছে না সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পুলিশেরও। পরিবহন খাত ও ফুটপাতে চলছে নীরব চাঁদাবাজি। শাসকদলের নাম ভাঙিয়ে সরকারি জায়গাসহ সাধারণ মানুষের সহায়-সম্পত্তি দখল করা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাও। সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। আবার বর্তমানে র্যাবের টহল না থাকায় শুধু পুলিশের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এক শ্রেণির অদক্ষ পুলিশ কর্মকর্তা ব্যস্ত রাজনৈতিক নেতাদের খুশি রাখতে। র্যাবের নিষ্ক্রিয়তায় অপরাধীদের মধ্যে উৎসাহ বেড়ে গেছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে দ্রুত র্যাবকে মাঠে নামানোর ব্যবস্থা করার তাগিদ দেন তাঁরা। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে বিভিন্ন অপরাধে সারা দেশে মামলা হয়েছে ৮৯ হাজার ৫০৯টি। এ সময়ে দুই হাজার ২৬৩টি হত্যাকাণ্ড ঘটে। ছিনতাই হয়েছে সহস্রাধিক। পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা পাঁচ শতাধিক। ডাকাতির ঘটনা ঘটে ৪৪৮টি। জুন মাসে সারা দেশে মামলা হয়েছে ১৬ হাজার ৯১৮। এ সময়ে ঢাকা মহানগরে মামলার সংখ্যা এক হাজার ৬২২ এবং হত্যাকাণ্ড ২১টি। মে মাসে সারা দেশে মামলার সংখ্যা ১৬ হাজার ৫৮১। এ সময়ে ঢাকা মহানগরে মামলা হয়েছে এক হাজার ৬৯২টি, হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২১টি। এপ্রিলে সারা দেশে মামলার সংখ্যা ১৬ হাজার ৬৪৯। এ সময়ে ঢাকা মহানগরে মামলা হয়েছে এক হাজার ৫৫৯টি, হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২৪টি। মার্চে মামলার সংখ্যা সারা দেশে ১৪ হাজার ২২১, ঢাকা মহানগরে এক হাজার ৫৭০। এ সময়ে ঢাকা মহানগরে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১০টি। এর পাশাপাশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ : গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। চাঁদাবাজ, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, অজ্ঞান পার্টির সদস্য ও ছিনতাইকারীদের ধরতে বিশেষ দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এরই মধ্যে। নির্দেশনা পেয়ে রাজধানীতে চেকপোস্ট বাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপ নেয় পুলিশ। ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি ঠিক রাখতে পুলিশ সুপারদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। কিন্তু কোনো নির্দেশ বা কৌশলই কাজে আসছে না। কড়া নজরদারির মধ্যেই প্রতিদিন ঘটছে হত্যাকাণ্ড, নারী নির্যাতন, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি। অপরাধীরা ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের নাম ব্যবহার করে ফায়দা নিচ্ছে। তাদের ব্যাপারে পুলিশ জেনেও না জানার ভান করছে। আবার কিছু অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তার দলবাজির কারণে অপরাধীদের লাগাম টেনে ধরার আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি ছাত্রলীগ-যুবলীগের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভর্তি-বাণিজ্যসহ অন্যান্য অপরাধেও অতিষ্ঠ পুলিশ। অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মনে বিরাজ করছে আতঙ্ক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়নি। দু-একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটলেও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে। অপরাধীদের ধরতে চলছে অভিযান। সম্প্রতি যে কয়টি ঘটনা ঘটেছে তার বেশির ভাগের ক্লু উদ্ঘাটিত হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অপরাধী অপরাধীই, তার কোনো রাজনৈতিক দল থাকতে পারে না। ডিএমপির মুখপাত্র যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মো. মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, পবিত্র রমজান ও ঈদ ঘিরে মানুষের হাতে অর্থের প্রবাহ অনেক বেড়ে যায়। আর এ সুযোগে অপরাধীরা তৎপর থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে পুলিশও ব্যাপক তৎপর আছে। একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের লক্ষ্যে ঢাকার ৪৯ থানার ওসি ও আটটি ক্রাইম জোনের ডিসিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। অন্যদিকে বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপারদের নানা নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, দেশে কোনো বড় ধরনের ঘটনা ঘটার পরপরই শাসক দলের নেতারা পুলিশকে ব্যবহার করে ঘটনা ভিন্ন খাতে নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ফলে আসল খুনিরা গা ঢাকা দেয়। হঠাৎ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় পুলিশ কর্মকর্তারাও উদ্বিগ্ন। বিশ্লেষকদের অভিমত : বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক কালের কণ্ঠকে বলেন, অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ায় দেশে অপরাধ বেড়েই চলেছে। মাত্র ১০ শতাংশ মামলায় সাজা হচ্ছে। বিচার না হওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপসহ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাই দায়ী। পুলিশের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ বা পদোন্নতি ও অদক্ষ অফিসারদের গুরত্বপূর্ণ চেয়ারে বসিয়ে রাখলে কখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব আছে। নিজেদের আখের গুছানোর জন্য অদক্ষ পুলিশ কর্মকর্তারা রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশনা মেনেই চলেছেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক নেতারা পুলিশের ওপর খবরদারি করছেন। নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর র্যাবের নিষ্ক্রিয়তায় অপরাধীদের মধ্যে উৎসাহ দেখা দিয়েছে। ফলে অপরাধ বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যে হলেও জনগণকে নিরাপত্তা দিতে হবে। কোনো অজুহাত তোলার অবকাশ নেই।’ মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, দেশে আগের চেয়ে অপরাধ বেড়ে গেছে। পুলিশকে জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাহলেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। পুলিশের জন্য স্বাধীন কমিশন গঠন করলে তাদের ওপর আর কেউ খবরদারি করতে পারবে না। যেসব চেয়ার অযোগ্য পুলিশ অফিসার আকড়ে ধরে আছেন তাঁদের দ্রুত সরিয়ে যোগ্য অফিসারদের নিয়ে আসতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, র্যাবের টহল না থাকায় অপরাধীরা অনেকটা চাঙ্গা। অপরাধীদের রুখতে দ্রুত র্যাবকে মাঠে নামাতে হবে। রাজধানীতে অপরাধ : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ২ শতাধিক ব্যক্তি অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে ঢাকায়। গত ৭ জুলাই বাংলামোটরে পুলিশের দুই উপপরিদর্শককে গুলি করে ছিনতাইকারীরা। ওই ঘটনায় ৫৯ লাখ টাকাসহ এক ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৫ জুলাই তুরাগের চণ্ডালভোগ থেকে আমিন উদ্দিন ভুঁইয়া নামের এক বৃদ্ধকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে। ৩ জুলাই রাতে উত্তরায় এক তরুণীকে অপহরণে বাধা দিতে গিয়ে দুর্বৃত্তের গুলিতে প্রাণ হারান লিটন নামের এক নিরাপত্তাকর্মী। ২ জুলাই মুগদায় দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে শহিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি খুন হন। ২৪ জুন কল্যাণপুরে ব্যবসায়ী জাকারিয়া ও তাঁর কর্মচারীসহ পাঁচজনকে গুলি করে ৩০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ২২ জুন উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে বিকাশকর্মীকে গুলি করে ১১ লাখ টাকা এবং ২৩ জুন পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ী বিল্লালকে গুলি করে ১০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এনামুল হক শামীমকে ১৯ জুন ধানমণ্ডিতে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় যে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১৯ জুন লালবাগের নবাবগঞ্জে বিকাশকর্মচারী তামিম ও জনিকে কুপিয়ে এবং বোমা ফাটিয়ে ৩১ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। একই দিনে রামপুরার উলনে আরেক বিকাশকর্মী ইরান চৌধুরীকে গুলি করে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা লুট করা হয়। ৫ জুন রামপুরায় রমজান আলী নামের এক ব্যক্তিকে গুলি করে ছিনিয়ে নেওয়া হয় চার লাখ টাকা। ১৮ জুন মনিপুরে শিবলু নামের এক ব্যক্তির বুকে গুলি করে কিছু টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ১৭ জুন মুগদায় রুবেল নামের এক যুবককে গুলি করে ছয় লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। ওই দিনই ধোলাইখাল এলাকায় ব্যবসায়ী জাকিরকে গুলি করে ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ৭ জুন রায়েরবাজারে ছিনতাইকারীরা রাসেল নামে এক যুবককে গুলি করে ২১ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। পরদিন ওই যুবক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ১৯ মে খিলগাঁওয়ে গার্মেন্টব্যবসায়ী জহির আহমেদ ছিনতাইকারীদের গুলিতে আহত হন। তাঁর কাছ থেকে সাত লাখ টাকা লুট করা হয়।
No comments:
Post a Comment