বিশ্বকাপ শুরুর আগে লুইস ফেলিপে স্কলারিকে যদি বলা হতো, আপনার দলের এমন দুজন খেলোয়াড়ের নাম বলুন, যাঁদের আপনার চাই-ই চাই। কোন দুটি নাম বলতেন ফেলিপাও? কুইজের প্রশ্ন হিসেবে এটা খুবই পচা। উত্তরটা অনুমান করা যে একটুও কঠিন নয়। আগামীকাল বেলো হরিজন্তের এস্তাদিও মিনেইরোতে জার্মানির বিপক্ষে সেমিফাইনালে সেই দুজনই দর্শক! নেইমারের যে যন্ত্রণাকাতর ছবি দেখলাম, তাতে দর্শক হিসেবে খেলা দেখাটাও তাঁর জন্য সহজ হবে
না। মানসিক যন্ত্রণার কোনো তুলনাই চলে না, শারীরিক যন্ত্রণাও তো কম নয়। হেলিকপ্টারে করে সাও পাওলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে নেইমারকে। দল সেমিফাইনালে খেলছে আর এই বিশ্বকাপের ‘পোস্টার বয়’কে তা দেখতে হচ্ছে টেলিভিশনে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে নিষ্ঠুরতম ঘটনা হিসেবে এর কোনো তুলনা নেই। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ থেকে ডিয়েগো ম্যারাডোনার বিদায়ও একই রকম আলোচিত। তবে সেটি ছিল তাঁর নিজের পাপে। এই বিশ্বকাপ থেকে লুইস সুয়ারেজের বহিষ্কৃত হওয়াও তা-ই। নেইমারের ঘটনা তো তা নয়। তাঁর কোনো দোষ নেই। তিনি ফুটবল মাঠে নৃশংসতম আক্রমণের শিকার। গত শুক্রবার রাত থেকে হুয়ান ক্যামিলো জুনিগা যে ব্রাজিলে সবচেয়ে ঘৃণিত মানুষ, সেটি বোধ হয় না বললেও চলছে। ব্রাজিলের এই দলে সামনে যেমন নেইমার, পেছনে থিয়াগো সিলভা। দলের অধিনায়ক। অনেকের চোখেই বিশ্বের সেরা সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারও। দুই হলুদ কার্ড সেমিফাইনালে দর্শক বানিয়ে রাখছে সিলভাকেও। জার্মানি কি তাহলে ফাইনালে উঠেই গেল? এভাবে কি আর বলে দেওয়া যায় নাকি! তবে এটা তো বলাই যায়, বিশ্বকাপ ড্রয়ের পর সেমিফাইনালে যখন ব্রাজিলকে দেখেছে, জার্মানি কল্পনাও করেনি আক্রমণের ফলা আর রক্ষণের স্তম্ভ দুটিই হারিয়ে ব্রাজিল এমন হীনবল হয়ে থাকবে! ‘সুবর্ণ সুযোগ’ বলে যে একটা কথা আছে, জার্মানির জন্য এটা তা-ই। বিশ্বকাপ ড্রয়ের পর জার্মানি সেমিফাইনাল দেখেছে কথাটা ভেবেচিন্তেই লেখা। সেমিফাইনাল খেলাটাকে প্রায় জন্মগত অধিকার বানিয়ে ফেলেছে জার্মানরা! পশ্চিম জার্মানি-জার্মানি কূটতর্কে না গেলে এবারের আগে ১৭টি বিশ্বকাপের ১২টিতেই সেমিফাইনালিস্ট। এবার টানা চতুর্থবারের মতো। সেখানে বাকি তিনটি সেমিফাইনালিস্টকে দেখুন। ব্রাজিলের আরও যেসব রেকর্ড আছে, সেসব কোনো দিন ভেঙেও যেতে পারে। যেটি কখনোই ভাঙার নয়, তা হলো সব কটি বিশ্বকাপেরই অংশ হয়ে থাকা। সেই ব্রাজিলও সেমিফাইনাল খেলায় জার্মানির বেশ পেছনে। সেমিফাইনালে উঠল দশমবারের মতো। আর্জেন্টিনা ও হল্যান্ড মাত্র পঞ্চমবার। বিশ্বকাপ নতুন একটা সেমিফাইনালিস্ট পেতে পেতে পায়নি, সেটি নিয়ে কোস্টারিকানদের আক্ষেপ থাকবেই। টাইব্রেকারের লটারিতে হারার কারণে আরও বেশি। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে থেমে যাওয়া স্বপ্নযাত্রাতেই এই বিশ্বকাপের সুন্দরতম গল্পটা লিখে ফেলেছে কোস্টারিকা। যা দেখতে দেখতে বারবার মনে পড়েছে বিশ্বকাপ শুরুর আগে সান্তোসের ওই সকাল। পেলের মাঠে অনুশীলন করছে কোস্টারিকা দল। গ্যালারিতে ঢাকঢোল নিয়ে রীতিমতো সমর্থকদের উৎসব। এরই মধ্যে কোচ হোর্হে লুইস পিন্টো খেলোয়াড়দের উদ্দেশে উদ্দীপনামূলক কিছু বলতে অনুরোধ করেছেন ১৯৭০ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলের মিডফিল্ডার ক্লদওয়ালদোকে। যা জানার পর সান্তোসের তরুণ সমর্থক বলছেন, ‘তোমরা যে গ্রুপে পড়েছ, তাতে ক্লদওয়ালদো কেন, পেলে আর ম্যারাডোনা একসঙ্গে উৎসাহ দিলেও কোনো কাজ হবে না।’ সেই কোস্টারিকাই ‘বিস্ময়’ শব্দটাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে এই বিশ্বকাপে। সেটি সেমিফাইনাল পর্যন্ত বিস্তৃত না হওয়ায় শেষ চারে এসে কিন্তু আর কোনো চমক নেই। বিশেষজ্ঞদের বিশ্বকাপ-পূর্ব পূর্বাভাস বরং প্রায় মিলেই যাচ্ছে এখানে এসে। ‘প্রায়’ শব্দটা হল্যান্ডের কারণে। গতবারের রানার্সআপদের নিয়ে এবার ডাচরাই খুব বড় কোনো আশা করেনি। বিশ্বকাপ ড্রয়ের পর সম্ভাব্য সেমিফাইনাল লাইনআপ ছিল—একদিকে ব্রাজিল-জার্মানি, অন্যদিকে আর্জেন্টিনা-স্পেন। প্রথম রাউন্ড থেকেই স্পেনের বিদায় অবশ্যই বড় অঘটন। তবে হল্যান্ডের সেমিফাইনাল খেলা অবশ্যই তা নয়। সম্ভাবনার সব দুয়ারও খোলা রাখছে সেমিফাইনাল লাইনআপ। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা তথাকথিত স্বপ্নের ফাইনালের তো বটেই, দক্ষিণ আমেরিকার মাটিতে অল-ইউরোপীয় ফাইনালের মতো অকল্পনীয় সম্ভাবনাও। বিশ্বকাপ ট্রফি যে দুই মহাদেশের মধ্যেই হাতবদল হয়, ফাইনালে সেই ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার লড়াই-ও লেখা থাকছে সম্ভাবনার খাতায়। নাটকের শেষ অঙ্কের পাণ্ডুলিপি কী লিখে রেখেছেন ফুটবল-বিধাতা, কে জানে! সেমিফাইনাল ব্রাজিল–জার্মানি ফাইনাল ১৩ জুলাই রিও ডি জেনিরো ৯ জুলাই হল্যান্ড–আর্জেন্টিনা
No comments:
Post a Comment