Monday, July 7, 2014

ডেসটিনির সম্পত্তি পুলিশ খাচ্ছে!:প্রথম অালো

বিতর্কিত বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) কোম্পানি ডেসটিনির নামে থাকা বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির দায়িত্ব এখন পুলিশের। কিন্তু দায়িত্বের বাইরে গিয়েও কাজ করছে পুলিশ। আবার অনেক জায়গায় রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বটুকুও পুলিশ পালন করছে না। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ডেসটিনির কিছু আয় পুলিশের নামে ব্যাংকে জমা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে তিনটি সিনেমা হলের আয়। ডেসটিনির বাড়িভাড়াও নিচ্ছে
পুলিশ। আদায় করা সেই ভাড়া পুলিশের কাছেই থাকছে। পুলিশ ডেসটিনির ৫০টি গাড়িও ব্যবহার করছে। অবশ্য পুলিশের দাবি, ডেসটিনির আয় তারা ভোগ করছে না, বরং হিসাব রাখছে। তবে গাড়িগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে বলে পুলিশ স্বীকার করেছে। আদালতের নির্দেশে এক বছর চার মাস ধরে ডেসটিনির সম্পদের রিসিভার বা তত্ত্বাবধায়ক পুলিশ। রাজধানীতে থাকা ডেসটিনির সম্পদ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এবং রাজধানীর বাইরের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছেন সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপার (এসপি)। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক যুগ ধরে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পাঁচ হাজার কোটির বেশি টাকা সংগ্রহ করে ডেসটিনি। এই টাকা দিয়ে ডেসটিনির কর্তাব্যক্তিরা কথিত প্রতিষ্ঠান ও নিজেদের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ কিনেছেন। বাড়ি, গাড়ি, সিনেমা হল ছাড়াও এর মধ্যে রয়েছে পাটকল, হিমাগার, টেলিভিশন চ্যানেল, বিপুল পরিমাণ ধানি জমি ও শপিং কমপ্লেক্স করার জমি। জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ডেসটিনির সম্পদে বিনিয়োগকারীদের হক রয়েছে। আদালতের রায়ে পুলিশ যেহেতু এই সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাই এর অপব্যবহার হলে পুলিশই দায়ী থাকবে। ডেসটিনির আয় সংরক্ষণের ব্যাপারে আবারও আদালতের নির্দেশনা চাওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। আলী ইমাম বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে চলুক। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের অর্থ ফিরিয়ে দিতে উপায় বের করা উচিত। এ জন্য আইন না থাকলে প্রয়োজনে নতুন আইন করতে হবে। ২০১২ সালের ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় ডেসটিনির ২৩ কর্তাব্যক্তির বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২২ মাস পর গত ৪ মে দাখিল করা অভিযোগপত্রে আসামি করা হয় ৫১ জনকে। চার হাজার ১১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং তার মধ্যে ৯৬ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয় তাঁদের বিরুদ্ধে। দুদক সূত্র জানায়, পুলিশ ডেসটিনির যেসব সম্পদ তদারক করছে, তার আর্থিক মূল্য মাত্র ৬৩১ কোটি টাকা। ডেসটিনির সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে একটি কমিটি করেছে ডিএমপি। এর নাম ‘ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি ও ডেসটিনি ২০০০ লি. নামক কোম্পানির ক্রোককৃত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও তদারকি-সংক্রান্ত আহ্বায়ক কমিটি।’ ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) রেজাউল করিম এ কমিটির বর্তমান আহ্বায়ক। গত ২৬ মে ডিএমপি কার্যালয়ে সদ্যবিদায়ী আহ্বায়ক শাহাবুদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, সিনেমা হলের আয় ব্যাংকে জমা হচ্ছে। আর গাড়িগুলোও চলছে। পুলিশ কেন ডেসটিনির গাড়ি ব্যবহার করছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যবহার করা না হলে গাড়িগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। প্রথম আলো অনুসন্ধান করে দেখেছে, রাজধানীর ফার্মগেটের আনন্দ-ছন্দ সিনেমা হল থেকে প্রতি মাসে ১১-১২ লাখ টাকা আয় হচ্ছে। সিনেমা হল থেকে তেজগাঁও থানায় দাখিল করা হিসাবপত্র অনুযায়ী, গত এপ্রিলে দুই হল থেকে আয় হয়েছে ১০ লাখ ২৬ হাজার ৫৪০ টাকা। এর মধ্যে আনন্দের আয় ছয় লাখ ৬৮ হাজার ৮৫০ ও ছন্দের তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৯০ টাকা। দুই সিনেমা হলের আয় জমা রাখার জন্য তেজগাঁও থানার সহকারী কমিশনার (এসি), ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং দ্বিতীয় কর্মকর্তার নামে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় একটি যৌথ হিসাব খোলা হয়েছে। তেজগাঁও থানার জ্যেষ্ঠ এসি মোহাম্মদ আফরুজুল হক বিষয়টি স্বীকার করেন। আফরুজুল হক অবশ্য বলেন, ‘কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ বিভিন্ন খাতে আয়ের বেশির ভাগই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। বাকি টাকা রাখা হচ্ছে ব্যাংকে।’ এপ্রিলে আট লাখ ৭২ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, ডেসটিনির বিষয়টি সুরাহা হলে জমা রাখা অর্থ প্রকৃত মালিকের কাছেই যাবে। প্রকৃত মালিক হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, যাঁরা ডেসটিনিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেন। রাজধানীর খিলক্ষেত থানার ওসি নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর থানার দায়িত্বে রয়েছে (লেকসিটি কনকর্ডে) ডেসটিনির একটি ফ্ল্যাট এবং এটি থেকে কোনো আয় হচ্ছে না। বাকি ফ্ল্যাটগুলো ভাটারা থানার আওতায়। ভাটারা থানার ওসি আবদুল জলিল জানান, বিষয়টি দেখভাল করতেন দ্বিতীয় কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম। তিনি সম্প্রতি বদলি হওয়ায় এ ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারছেন না। গত শুক্রবার লেকসিটি কনকর্ডে থাকা আটটি ফ্ল্যাটের ব্যাপারে সরেজমিনে জানা যায়, প্রতিটি ফ্ল্যাটেই ভাড়াটে রয়েছেন। ভাড়া ১০-১২ হাজার টাকা। লেকসিটি কনকর্ডের রূপালী ভবনের ষষ্ঠ তলায় ৬/বি৩ নম্বর ফ্ল্যাটের ভাড়াটে হাসানুল বান্না জানান, এক বছরের বেশি সময় ধরে তাঁরা ফ্ল্যাটটিতে থাকছেন। মাসে ১০ হাজার টাকা করে ভাড়া দিয়ে আসছেন নজরুল ইসলাম নামের একজনকে। নজরুল ইসলাম ওই ভবনেরই চতুর্থ তলার ৪/বি১ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকেন। বাসায় গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। অনেকক্ষণ কলিংবেল চাপলেও দরজা খোলেননি কেউ। নজরুল ইসলাম গতকাল রোববার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ভাড়া তুলছেন এবং রফিকুল আমীনের দুই সন্তানের পড়াশোনার খরচ জোগাতে তা ব্যয় হচ্ছে। পুলিশ তা জানে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হয়তো পুলিশের কাছে মানবিক কারণ দেখিয়ে আবেদন করা হয়েছে। পুলিশ তা অনুমোদনও করেছে।’ ডেসটিনির কোম্পানি সচিব মিজানুর রহমান এ ব্যাপারে বলেন, লেকসিটি কনকর্ডের ফ্ল্যাটগুলো থেকে তাঁরা কোনো টাকা পাচ্ছেন না। আবার পুলিশও বলছে, এ ব্যাপারে তারা কিছুই জানে না। ডেসটিনির যত সম্পদ: দুদক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকাসহ দেশের ২২টি জেলায় ডেসটিনির সম্পদ রয়েছে। এ সম্পদ দুই ভাগে বিভক্ত, প্রতিষ্ঠানের নামে ও পরিচালকদের নামে। তবে গ্রুপভুক্ত ৩৭ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ডেসটিনি ২০০০, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস এবং ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশনের নামেই বেশি সম্পদ। রাজধানীর বাইরে মুন্সিগঞ্জ জেলায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি সম্পদ। জেলার সিরাজদিখানেই রয়েছে এক হাজার ৩০০ কাঠা জমি। এদিকে, ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমীনেরই ২৮টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর মধ্যে লেকসিটি কনকর্ডে তাঁর নামে রয়েছে আটটি ফ্ল্যাট। এ ছাড়া মগবাজারে একটি, ধানমন্ডিতে দুটি এবং খিলক্ষেতে রয়েছে একটি ফ্ল্যাট। পুরান ঢাকার ২৫ নম্বর কোর্ট হাউস স্ট্রিট ভবনে আট কাঠার প্লট এবং ধানমন্ডিতে দুই হাজার ৬৩৩ বর্গফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে তাঁর স্ত্রী ফারাহ দীবার নামে। ঢাকার কল্যাণপুরের দারুসসালাম ও পুরানা পল্টন লাইনের স্থাপনাবিহীন বাড়ি এবং বাংলামোটরে নাসির ট্রেড সেন্টারের দশম তলায় রয়েছে পাঁচ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্লোর। ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইনের নামে সিদ্ধেশ্বরী, খিলগাঁও, গেন্ডারিয়া, ক্যান্টনমেন্ট ও ভাটারায় প্লট-ফ্ল্যাট রয়েছে। বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে রয়েছে ২৪টি রাবার বাগান। খুলনায় সাত একর জমি, ছয় বিভাগীয় শহরে ডেসটিনি ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস সেন্টার নির্মাণের জমি, কক্সবাজারে জমিসহ নির্মীয়মাণ হোটেল ও গাজীপুরে ডেসটিনি অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ স্থাপনের জন্য জমি রয়েছে। ঢাকার বাইরের সম্পদ অরক্ষিত: ডেসটিনির নামে থাকা রাজধানীর বাইরের সম্পদ পুরোপুরিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করছে না পুলিশ। সংশ্লিষ্ট এসপিরা বলছেন, তাঁরা কিছু জানেনই না এ ব্যাপারে। ডিএমপির সঙ্গে কোনো সমন্বয়ও নেই জেলাগুলোর। ফলে সম্পদগুলো অরক্ষিত থেকে যাচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহীর বর্ণালী সিনেমা হলটি বন্ধ। সিনেমা হলের মাঠে মাঝেমধ্যে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ থেকেও অবশ্য আয় হয়। প্রথম আলোর রাজশাহী কার্যালয়কে রাজশাহীর এসপি আলমগীর কবির জানান, ডেসটিনির বিষয়ে আদালতের নির্দেশ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। বান্দরবানের লামা থানায় রয়েছে ডেসটিনির সবচেয়ে বেশি রাবার বাগান। এগুলো পুরোপুরিভাবে অরক্ষিত। যাঁদের কাছ থেকে এ বাগানগুলো কেনা হয়েছিল, তাঁরাই এখন এগুলো দখলে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে ডেসটিনি গ্রুপের কোম্পানি সচিব মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বন বিভাগকে এ বাগানগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে ডেসটিনির পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল। বন বিভাগ এতে রাজি হয়নি। বান্দরবানের এসপি দেবদাস ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ডেসটিনির রাবার বাগান রক্ষণাবেক্ষণের কোনো নির্দেশ সম্পর্কে তিনিও কিছু জানেন না। লামা থানার ওসি শাহজাহান ভূঁইয়াও একই কথা বলেন। ডেসটিনির সম্পদ কেনা হয় মূলত ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন এবং ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রফিকুল আমীন, ডেসটিনি ২০০০-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইনসহ পরিচালকদের নামে। সুরাহার উদ্যোগ নেই: দুদকের মামলায় ৫১ আসামির মধ্যে রফিকুল আমীন, মোহাম্মদ হোসাইন, দিদারুল আলম বর্তমানে কারাগারে। জামিনে রয়েছেন পরিচালক আকবর আলী সুমন। ডেসটিনি গ্রুপের সভাপতি সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশিদকেও শর্তসাপেক্ষে জামিন দেওয়া হয়েছিল ২০১২ সালে। তিনিও এখন জামিনে। বাকি আসামি সবাই পলাতক। কিন্তু ডেসটিনিতে যাঁরা বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণের কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। শুরুর দিকে ‘ডেসটিনি কমিশন’ নামে একটি কমিশন করার কথা অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে বলা হলেও পরে সেটি আর হয়নি। বিষয়টি ঠেলে দেওয়া হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দিকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজেসকো) থেকে নিবন্ধন নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে ডেসটিনি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলম বিষয়টি একান্তই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বলে জানান। অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বাণিজ্যসচিব থাকা অবস্থায় অবশ্য বলেন, ‘ডেসটিনির বিষয়টি খুবই জটিল প্রকৃতির। আমরা অপেক্ষায় আছি মামলা নিষ্পত্তির।’ ডেসটিনির বিরুদ্ধে মামলাকারী দুদকের উপপরিচালক মোজাহার আলী সরদার বলেন, ডেসটিনির সব সম্পদ দখলে নিতে পারেনি পুলিশ। মামলার সর্বশেষ অবস্থা কী এবং আসামিরা ধরা পড়ছে না কেন, জানতে চাইলে মোজাহার আলী সরদার বলেন, এটি একান্তই আদালতের বিষয়। আসামিরা ধরা না দিলে একতরফা বিচার হতে পারে এবং এতে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন তাঁরা।

No comments:

Post a Comment