রাজধানীর পল্লবীর কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পে হামলা এবং আগুন দিয়ে ও গুলি করে ১০ জনকে হত্যার ঘটনায় এক মাসেও দুর্বৃত্তরা কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। এমনকি এই নৃশংস ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্তও করতে পারেনি পুলিশ। উল্টো আক্রান্তদের আসামি করে মামলা দেওয়া হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবার ও ক্যাম্পের বাসিন্দা আটকে পড়া পাকিস্তানিদের অভিযোগ, হামলায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী ও এর নেপথ্যে কারা ছিল, তা স্থানীয় পুলিশের অজানা
নয়। গত ১৪ জুন ভোরে দুর্বৃত্তরা পুলিশের সঙ্গে এসে হামলা চালায়। তারা নয়টি ঘরের দরজায় বাইরে তালা লাগিয়ে আগুন দেয়। এতে এক পরিবারের নারী-শিশুসহ নয়জন নিহত হন। অপর একজন নিহত হন (কারচুপি শ্রমিক আজাদ) পুলিশের গুলিতে। এ কারণে ঘটনার পর থানায় মামলা করতে গেলে তাঁদের মামলা পুলিশ নেয়নি। অবশ্য পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিয়াউজ্জামান প্রথম থেকেই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। তিনি দাবি করেন, নিহত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে কেউ থানায় মামলা করতে আসেননি। এ ঘটনায় পল্লবী থানায় মোট ছয়টি মামলা হয়। এর মধ্যে দুটি পুলিশ বাদী হয়ে এবং অপর চারটি বিভিন্ন ব্যক্তি বাদী হয়ে করেছেন। সবগুলোতেই আসামি করা হয়েছে হামলার শিকার ক্যাম্পের বাসিন্দাদের। সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গেলে ক্যাম্পের বাসিন্দা আরমান, খোকন, সুমনসহ আরও কয়েকজন এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করেন, একজনকে পুলিশ গুলি করে মারল, আবার সেই মামলার বাদীও পুলিশ। বাকি মামলাগুলোও পুলিশ তাদের পছন্দের লোককে দিয়ে করিয়েছে। এসব মামলায় ক্যাম্পের তিন হাজার ৭১৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, এসব মামলা এখন তদন্ত পর্যায়েই রয়েছে। মামলাগুলো তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এমন একটি মামলার বাদী হলেন কুর্মিটোলা ক্যাম্পের পাশে অবস্থিত বায়তুর রহমত জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি মোবারক হোসেন। মসজিদে ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগে করা এই মামলায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৮০০-৯০০ জনকে আসামি করা হয়। কিন্তু মোবারক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি পুলিশের কাছে এমন কোনো অভিযোগ বা মামলা করেননি। তিনি বলেন, ‘পুলিশ আমাদের মসজিদের কোষাধ্যক্ষকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক করে। তাঁকে ছাড়িয়ে আনতে আমি থানায় যাই। তখন পুলিশ আমাকে বিহারি ক্যাম্পের লোকদের বিরুদ্ধে মামলা করতে বলে। আমি রাজি হইনি। পরে পুলিশের একজন এসে দুটি কাগজে আমার সই নিয়ে যায়। তখনো বুঝতে পারিনি আমাকে মামলার বাদী করা হচ্ছে।’ এ ঘটনায় নিহত আজাদের বৃদ্ধ মা সাইদা বেগম তাঁর ছেলেকে হত্যার জন্য পুলিশকে দায়ী করেন। তাই মামলা করতেও ভয় পাচ্ছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করলে তারা তো আমাদের থাকতে দেবে না। তাই বিচারের ভার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিচ্ছি।’ এদিকে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, সরকারদলীয় স্থানীয় সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহর মদদে পল্লবী থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রানার নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী ওই রাতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছে। এ ঘটনার পর সংবাদমাধ্যমেও অনেক খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু জুয়েল রানাকে গ্রেপ্তার করা তো দূরের কথা, তাঁকে এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি। অবশ্য এ-সংক্রান্ত মামলাগুলোর তদন্ত-তদারক কর্মকর্তা ডিবির উপকমিশনার মো. শেখ নাজমুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, জুয়েল রানাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, স্পর্শকাতর ছয়টি মামলা তদন্তে পৃথক ছয়জন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পুলিশ সন্দেহভাজনদের প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেছে। যাচাই-বাছাই শেষে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। আর সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ দাবি করেন, এই হামলারসঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি বলেন, ঘটনার তিন দিন আগে তিনি পাশের রাজু বস্তিতে বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়ার জন্য বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর কথা না শোনায় তিনি চলে আসেন। এ নিয়ে তিনি আরও কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। জুয়েল রানা প্রসঙ্গে এই সাংসদ বলেন, জুয়েলসহ তাঁর কোনো লোক হামলায় জড়িত আছেন, তা তদন্তে প্রমাণিত হলে তিনি তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। তবে ওই এলাকায় বিভিন্ন পেশার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কালশী সড়কসংলগ্ন উড়ালসড়ক তৈরি হওয়ায় ওই এলাকার জমির দাম অনেক বেড়ে গেছে। তাই এখান থেকে বিহারিদের উচ্ছেদ করে স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিপণিবিতান নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। ওই হামলার জন্য এটা একটা কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। বিহারিদের সংগঠন স্ট্রান্ড্রেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপেট্রিয়েশন কমিটি (এসপিজিআরসি) কুর্মিটোলা ক্যাম্পের সাধারণ সম্পাদক শওকত হোসেন অভিযোগ করেন, ওই দিন দুর্বৃত্তরা পুলিশের সঙ্গে এসে হামলা চালিয়েছিল। এ কারণে পুলিশের তদন্তের ওপর তাঁদের আস্থা নেই। তাই তিনি ১০ হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
No comments:
Post a Comment