প্লট কেলেংকারি ও দুর্নীতির ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) সাবেক চেয়ারম্যান তপন চন্দ্র মজুমদার ও সাবেক এস্টেট অফিসার আবু বকর সিদ্দিকসহ ১৩ জন। অভিনব জালিয়াতির মাধ্যমে প্লট বরাদ্দের অভিযোগে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছে দুদক। গত কয়েক মাসে সংশ্লিষ্টদের দুদকের প্রধান কার্যালয়ে তলব করে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াও এ সংক্রান্ত সব ফাইলপত্র জব্দ করেছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা আবদুছ ছাত্তার সরকার যুগান্তরকে জানান, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্লট দুর্নীতির অনুসন্ধান সম্পন্ন হয়েছে। মূল্যবান ৮টি বাণিজ্যিক প্লট কেলেংকারির ঘটনায় সংশ্লিষ্টরা সরাসরি দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন যা অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে। এতে সরকারের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সাবেক চেয়ারম্যান তপন চন্দ্র মজুমদার ও এস্টেট অফিসারসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি। নগরীর চন্দ্রিমা আবাসিক প্রকল্পের ৮টি মূল্যবান বাণিজ্যিক প্লট অভিনব জালিয়াতির মাধ্যমে বরাদ্দ দিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়ার পাশাপাশি সরকারের বিপুল ক্ষতি সাধনের অভিযোগের গত এক বছর ধরে অনুসন্ধান করছে দুদক। অনুসন্ধান কর্মকর্তা আরও জানান, প্লট দুর্নীতির অনুসন্ধান শেষ হয়েছে। এখন নথিকরণসহ মামলার প্রস্তুতি চলছে। সরকারি প্লট কেলেংকারির এই ঘটনায় সম্ভাব্য যাদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে তারা হলেন আরডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান তপন চন্দ্র মজুমদার, সাবেক এস্টেট অফিসার আবু বকর সিদ্দিক, সাবেক বেসরকারি সদস্য রেজাউন নবী দুদু ও খন্দকার সামসুল হক লায়ন, আরডিএ’র হিসাবরক্ষক রুস্তম আলী, অফিস সহকারী মোস্তাক আহম্মেদ, আবুল কাশেম আকন্দ, এনামুল হক, আবু রায়হান শোয়েব আহমেদ সিদ্দিকী, ডা. এসএম খোদেজা নাহার বেগম, ডা. রবিউল ইসলাম স্বপন, মাহফুজুল হক ও খায়রুল আলম। এদের মধ্যে তপন চন্দ্র মজুমদার (যুগ্ম সচিব) বর্তমানে ওএসডি হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত আছেন। আবু বকর সিদ্দিক কয়েক বছর আগে অবসর নিয়েছেন। অন্যদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ কয়েকজন চিকিৎসকও রয়েছেন। দুদক সূত্র জানায়, রাজশাহী মহানগরী পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার ৮টি বাণিজ্যিক প্লট বরাদ্দে ২০০৫ সালের ১৬ ফেব্র“য়ারি রাজশাহীর স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। অনুসন্ধান কর্মকর্তার মতে, পত্রিকাটির যেসব কপি বাজারে বিক্রির জন্য ছাড়া হয় সেগুলোতে প্লট বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তিটি নেই। তবে আরডিএ’র দরপত্র ফাইল থেকে জব্দ করা নথিপত্রে পত্রিকাটির যে কপি পাওয়া গেছে তাতে বিজ্ঞপ্তিটি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মতে, একই দিনে পত্রিকাটির দুই ধরনের কপি প্রকাশ করা হয়েছে। প্লটের আবেদন সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিটি যাতে জনসাধারণ জানতে না পারেন সেজন্য বাজারে ছাড়া কপিগুলোতে বিজ্ঞপ্তিটি ছাপানো হয়নি। অন্যদিকে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রচার সংক্রান্ত সরকারি বাধ্যবাধকতা পূরণে একই দিনে ও তারিখে সংশ্লিষ্ট পত্রিকাটির সীমিত সংখ্যক কিছু কপি পৃথকভাবে ছাপানো হয় যাতে বিজ্ঞপ্তিটি রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা নিশ্চিত পরিকল্পিত দুর্নীতির লক্ষ্যেই অভিনব এই জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক আবদুছ ছাত্তার যুগান্তরকে আরও বলেন, অনুসন্ধান পর্যায়ে রাজশাহীর ওই পত্রিকাটির প্রকাশককে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রকাশক অনুসন্ধান দলকে জানিয়েছেন পত্রিকাটির যে সংখ্যাটি বাজারে ছাড়া হয়েছিল সেটিই পত্রিকাটির আসল কপি। আরডিএ’র ফাইলে পত্রিকাটির যে কপিগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো তাদের ছাপানো পত্রিকা নয়। তিনি জানান, পত্রিকাটির প্রকাশকের এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পত্রিকাটি বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মে বিল নিয়েছে আরডিএ থেকে। তারা আলোচিত বিজ্ঞপ্তিটি না প্রকাশ করলে বিল নিল কীভাবে? সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আরও জানান, সরকারি বাণিজ্যিক প্লট বরাদ্দের নিয়ম হল, একটি স্থানীয় ও একটি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রচার করতে হবে এবং প্রতিযোগিতামূলক দরে সর্বোচ্চ দরদাতাকেই প্লট দিতে হবে। এই নিয়ম বাণিজ্যিক প্লটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। দুদক সূত্র আরও জানায়, বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ৮টি বাণিজ্যিক প্লটের জন্য মাত্র ৮টি আবেদন জমা পড়ে। আবেদনকারীরা যে দর উল্লেখ করেছেন সেই দরেই তাদের প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। একটি প্লটের জন্য মাত্র একটি আবেদন পড়ায় নিয়মানুযায়ী পুনঃবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা উচিত ছিল যা এখানে করা হয়নি। সূত্র মতে, এটি একটি সুপরিকল্পিত দুর্নীতি। ২০০৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্লটের আবেদন গ্রহণের শেষ দিন ছিল। আর ২০০৬ সালের ২ জানুয়ারি তড়িঘড়ি করে সাধারণ সভা ডেকে কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই ৮ আবেদনকারীকে ৫ কাঠা আয়তনের একটি করে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে পুরো দুর্নীতির প্রক্রিয়ায় আরডিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছাড়াও প্লট গ্রহীতারাও সরাসরি জড়িত। এই কাজের জন্য বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়ার প্রমাণ মিলেছে দুদকের অনুসন্ধানে। জানা যায়, ২০০৬ সালের শুরুতে যখন এসব লোভনীয় বাণিজ্যিক প্লট প্রতি কাঠা মাত্র ২ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়, ওই সময় এসব জমির বাজার মূল্য ছিল কাঠাপ্রতি ৫ লাখ টাকা করে। এই হিসেবে ৮টি প্লটের মোট ৪০ কাঠা জমি বরাদ্দে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। বর্তমানে এসব জায়গার কাঠাপ্রতি মূল্য ২০ লাখ টাকা। দুদকের উপ-পরিচালক বলেন, ফাইলপত্র পর্যালোচনা, সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্লট বরাদ্দের পুরো প্রক্রিয়াটি অনুসন্ধানে দুদক নিশ্চিত হয়েছে এটি একটি সুপরিকল্পিত দুর্নীতি। আরডিএ’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পরিকল্পিতভাবে গ্রহীতাদের প্লট বরাদ্দ দেয়ার জন্যই এই জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। খুব শিগগির সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন আইনে মামলা করা হবে বলে জানান দুদকের এই অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
No comments:
Post a Comment