জনশক্তি রপ্তানির মন্দাবস্থা থেকে বের হতে পারছে না বাংলাদেশ। দুই বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে জনশক্তি রপ্তানি কমছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রবাসী-আয় (রেমিট্যান্স) কমে আসা। স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো রেমিট্যান্স কমছে। জনশক্তি রপ্তানিকারক এবং এই খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের একসময়ের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে সেভাবে লোক যাচ্ছেন না। এর মধ্যেই দুই বছর ধরে প্রায় বন্ধ হয়ে আছে দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজ
ার সংযুক্ত আরব আমিরাত। তৃতীয় বড় বাজার মালয়েশিয়ায় সরকারিভাবে লাখ লাখ কর্মী যাবে শোনা গেলেও দেড় বছরে মাত্র হাজার পাঁচেক কর্মী গেছেন। যুদ্ধাবস্থার কারণে লিবিয়া ও ইরাকের শ্রমবাজারেরও খারাপ দশা। ওমান, বাহরাইন ও কাতারে কর্মী যাওয়া বাড়লেও গত পাঁচ বছরে সেই অর্থে নতুন করে কোনো শ্রমবাজার তৈরি হয়নি। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতেও সরকারিভাবে কর্মী পাঠানোসহ নানা বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে এ খাতের ব্যবসায়ীদের দ্বন্দ্ব চলেছে। এরই প্রভাব পড়েছে শ্রমবাজারে। এর মধ্যেই আবার সরকারি ডেটাবেইসে নিবন্ধিত কর্মী নিতে হবে—মন্ত্রণালয়ের এমন বাধ্যবাধকতার কারণে সংকট আরও বাড়ছে। তবে খন্দকার মোশাররফ হোসেন দ্বিতীয় দফায় মন্ত্রী হওয়ার পর ব্যবসায়ীরা এখন তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। তবে এর সুফল এখনো আসেনি শ্রমবাজারে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে (২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন) দুই লাখ সাত হাজার ৯৫৭ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। ২০১৩ সালের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল দুই লাখ আট হাজার ৩৪০ জন। অথচ ২০১২ সালে একই সময়ে বিদেশে গিয়েছিলেন তিন লাখ ৭৪ হাজার ৮৩৭ জন। অর্থাৎ ২০১২ সালের চেয়ে ২০১৩ ও ২০১৪ সালের প্রথম ছয় মাসে প্রায় পৌনে দুই লাখ কর্মী কম বিদেশে গেছেন। জনশক্তি রপ্তানি কমার পাশাপাশি প্রবাসী-আয়ও কমেছে। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের চেয়ে ২০১৩ সালে সাত হাজার ৭৫০ কোটি টাকা কম প্রবাসী-আয় এসেছে। অর্থবছরের হিসেবেও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২০১২-১৩ অর্থবছরের চেয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ কম প্রবাসী-আয় এসেছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রবাসীরা এক হাজার ৪২২ কোটি ৭০ লাখ (১৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সেটি ছিল এক হাজার ৪৪৬ কোটি (১৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন) ডলার। প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অতিরিক্ত কর্মী থাকা—এসব কারণে জনশক্তি রপ্তানি কিছুটা কমলেও পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হবে। তবে জনশক্তি রপ্তানি কমার সঙ্গে রেমিট্যান্স কমার কোনো সম্পর্ক নেই বলে মনে করেন এই মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘যারা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠায়, তাদের কোনো সুবিধা দেওয়া হয় না। একটু সুবিধা দিলেই রেমিট্যান্স বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংককে আমরা সেই কথা বলেছি।’ যোগাযোগ করা হলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয় ব্যক্তি খাতের চাহিদা বৃদ্ধি করে। এর প্রবাহ কমে গেলে, বিশেষত গ্রামীণ অর্থনীতিতে তাঁর প্রভাব পড়বে। গ্রামে দালানকোঠা, বাড়ি নির্মাণ কমে যাবে। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী-আয় কমে যাওয়াটা গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। কেননা মধ্যপ্রাচ্যের থেকে যে আয় আসে, তা গ্রামে যায়। আমেরিকা থেকে যে অর্থ আসে, সেটা গ্রামে ততটা যায় না। আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারকে এটা গুরুত্ব দিয়ে রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান করতে হবে। জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানোর প্রচেষ্টা নিতে হবে। তা না হলে আমদানিতে এর প্রভাব পড়বে। এখন আমদানি বাড়তে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে অর্থনীতি আরও সচল হলে আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হবে। ফলে সে বিষয় বিবেচনায় নিয়ে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ। আট বছরের চিত্র: ২০০৭ সালে আট লাখ ৩২ হাজার ৬০৯ জন এবং ২০০৮ সালে আট লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই আগের বছরের তুলনায় জনশক্তি রপ্তানি অর্ধেকে নেমে আসে। ২০০৯ সালে চার লাখ ৭৫ হাজার ২৭৮ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছিল। পরের বছর ২০১০ সালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হলেও ২০১১ সালে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার এবং ২০১২ সালে ছয় লাখ আট হাজার কর্মী বিদেশে যান। কিন্তু ২০১৩ সালে তা চার লাখে নেমে আসে। এ বছরও সেই মন্দা অব্যাহত আছে। কমার কারণ: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে গড়ে দেড় লাখ করে কর্মী গেছেন। কিন্তু ২০০৯ সালে এই বাজারটি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। গত সাড়ে পাঁচ বছরে মাত্র ৭৭ হাজার অর্থাৎ গড়ে বছরে ১৪ হাজারেরও কম কর্মী গেছেন দেশটিতে। সৌদি আরবে কিছু বাংলাদেশির অপরাধপ্রবণতা এবং কূটনৈতিক যোগাযোগের ব্যর্থতায় এখনো এই বাজারটি সেভাবে চালু হয়নি বলে জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা মনে করছেন। জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, সৌদি আরবের বাজার পুরোপুরি চালু করা গেলে জনশক্তি রপ্তানির ধস ঠেকানো যেত। কিন্তু কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানোর পরেও সফল হয়নি বাংলাদেশ। তবে গত বছর দেশটিতে চলা সাধারণ ক্ষমার সুবিধায় আট লাখ বাংলাদেশি বৈধতা পেয়েছে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বড় বাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত। ১৯৭৬ সাল থেকে প্রতিবছরই এই বাজারে কর্মী যাওয়া বেড়েছে। এর মধ্যে ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে আড়াই লাখ করে কর্মী গেছেন দেশটিতে। কিন্তু ভিসা জালিয়াতি ও কিছু প্রবাসীর অপরাধপ্রবণতার কারণে দুই বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া প্রায় বন্ধ করে দেয় দেশটি। এরপর সরকারের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতায় ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০২০ কে সামনে রেখে রাশিয়াকে সমর্থন দিলে ক্ষুব্ধ হয় আরব আমিরাত। ফলে এই বাজারটিতে জনশক্তি রপ্তানি এখন বন্ধ। গত দেড় বছরে মাত্র ২৫ হাজার কর্মী গেছেন দেশটিতে। কুয়েতের শ্রমবাজার ২০০৯ থেকেই বন্ধ। গত সাড়ে পাঁচ বছরে মাত্র ৭৭৬ জন কর্মী গেছেন দেশটিতে। কুয়েতের জনশক্তি রপ্তানির সমস্যা সমাধানে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুয়েত সফর করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কুয়েতের আমিরকে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু চার বছর পেরিয়ে গেলেও ইতিবাচক কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। যুদ্ধাবস্থার কারণে পরিস্থিতি খারাপ লিবিয়া ও ইরাকেও। বাংলাদেশের আরেকটি বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। ২০০৭ ও ২০০৮ সালেও এই বাজারে চার লাখ কর্মী গেছেন। কিন্তু প্রতারণাসহ নানা অনিয়মের কারণে ২০০৯ সালের মার্চে এসে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয় দেশটি। দীর্ঘ কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর ২০১২ সালের নভেম্বরে মালয়েশিয়া এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। এরপর দুই দেশের মধ্যে সরকারিভাবে কর্মী আদান-প্রদানের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ঘোষণা দেন, মালয়েশিয়া প্রতিমাসে ১০ হাজার করে কর্মী নেবে। বছরে তারা লাখ খানেক কর্মী নেবে। আগামী কয়েক বছরে পাঁচ লাখ কর্মী নেবে। কিন্তু গত দেড় বছরে মাত্র ছয় হাজার লোক মালয়েশিয়ায় গেছেন। নতুন বাজার নেই: ওমান, কাতার, বাহরাইন ও সিঙ্গাপুরে চাহিদা আছে বলেই বাংলাদেশের শ্রমবাজার এখনো পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। গত ছয় মাসে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছেন ওমানে। এই সংখ্যা ৫৪ হাজার ২৮৪। এ ছাড়া ২৬ হাজার কর্মী সিঙ্গাপুরে, ৩৮ হাজার কর্মী কাতারে, ১১ হাজার কর্মী বাহরাইনে, সাড়ে ১০ হাজার কর্মী জর্ডানে, সাত হাজার কর্মী লেবাননে, চার হাজার কর্মী ব্রুনাই গিয়েছেন। সরকারের তরফ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, নতুন নতুন বাজার খোঁজা হচ্ছে। তবে এই উদ্যোগের সফলতা নেই। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বর্তমানে এক শরও বেশি দেশে কর্মী পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পুরোনো ১০টি দেশের ওপরই এখনো নির্ভর করে আছে বাংলাদেশ। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জনশক্তি রপ্তানি বাড়াতে প্রচলিত শ্রমবাজারের বাইরে ১৬টি দেশের তালিকা করা হয়। এ দেশগুলো হলো: জাপান, হংকং, তাইওয়ান, ইতালি, বেলজিয়াম, জার্মানি, স্পেন, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, চেকস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা ও জিম্বাবুয়ে। এই দেশগুলোর পরিস্থিতি দেখতে প্রবাসী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে পাঁচটি দলও গঠন করা হয়। এই কমিটির সদস্যরা অনেক দেশ সফর করলেও কোনো নতুন বাজার চালু করতে পারেননি। জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকার ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে দ্রুত একটি বৈঠক করে এই খাতের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। তারপর সমাধানের কাজেও নামতে হবে একসঙ্গে। জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সভাপতি আবুল বাসার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখন সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করছি। খুব দ্রুতই পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করছি।’
No comments:
Post a Comment