Saturday, July 19, 2014

শোকে স্তব্ধ নেদারল্যান্ডস:প্রথম অালো

নেদারল্যান্ডসের রটারডাম শহরের এক রেস্তোরাঁর মালিক কেভিনের পরিবার। তাঁর বাবা-মা দুজনেই ছিলেন ইউক্রেনে ভূপাতিত মালয়েশিয়ার উড়োজাহাজ ফ্লাইট এমএইচ ১৭-এর যাত্রী। সে দেশেরই ভোলেনডাম শহরে ফুলের দোকান ছিল মাত্রই তিরিশের কোঠার এক দম্পতির। বন্ধুরা বলেছেন, বহুদিন পর একসঙ্গে বেড়ানোর ফুরসত মিলেছিল তাঁদের। কে জানত এটাই এ দম্পতির শেষ যুগল পথচলা! নেদারল্যান্ডসের আকাশে-বাতাসে আজ যেন কেবলই এ রকম টুকরা টুকরা শে
াকগাথার অনুরণন।দেশটি রুশ-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের কোনো পক্ষ না হলেও মালয়েশীয় উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা কেড়ে নিয়েছে তাদের ১৮৯ জন নাগরিকের প্রাণ।প্রাণহানির সংখ্যায় নেদারল্যান্ডসই শীর্ষে।দেশটির সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ শোকের ঘটনা এটি। সেখানে এক দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয় এ বিপর্যয়ে। শুধু নেদারল্যান্ডস নয়, কাঁদছে মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া আর ইন্দোনেশিয়াও। মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের দেওয়া হিসাবে এ দুর্ঘটনায় অস্ট্রেলিয়ার ২৭, মালয়েশিয়ার ৪৪ (১৫ জন ক্রু সদস্যসহ), ইন্দোনেশিয়ার ১২, যুক্তরাজ্যের ৯, জার্মানি ও বেলজিয়ামের ৪ জন করে, ফিলিপাইনের ৩ জন এবং কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের ১ জন করে নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া বাকি ৪ জনের নাগরিকত্ব নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর অবশ্য তাদের ১০ জন নাগরিক নিহত হয়েছে বলে জানায় গতকাল। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর দেশের একজন নাগরিক নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবারের এ ঘটনার নিন্দা করে আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছেন বিশ্বনেতারা। ৩০ জন আন্তর্জাতিক তদন্তকারী ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছেন দুর্ঘটনাস্থলে। খবর এএফপি, রয়টার্স ও বিবিসির। শোকাতুর নেদারল্যান্ডস: নেদারল্যান্ডসজুড়ে গতকাল জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত ছিল। দেশটিতে এক দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়। দেশবাসীর শোকে সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে যত দ্রুত সম্ভব দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী আর্সেনি ইয়াতসেনিউক। রাজা ভিলেম আলেক্সান্ডারের সপরিবারে ছবি তোলার কর্মসূচি ছিল কাল। ভয়াবহ এ বিপর্যয়ের কারণে তা বাতিল করা হয়েছে। নিহত ১৮৯ জন ডাচের মধ্যে রয়েছেন দেশটির সিনেটর ভিলেম ভিটিভিন ও বিশ্বখ্যাত এইডস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জোয়েপ ল্যাঞ্জে। সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে যাত্রীবাহী উড়োজাহাজটিকে ভূপাতিত করেছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। তবে বিদ্রোহীরা দাবি করছে, এ কাজ ইউক্রেনের সরকারি বাহিনীর। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ইউক্রেনের পাকধরা সোনালি গমের খেত আর বুনো ফুলের ঝাড়ে পড়ে আছে দেশ-বিদেশের নিরীহ মানুষের দেহ। নিথর, প্রাণহীন। তদন্তের দাবি বিশ্বনেতাদের: জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এ ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে গতকাল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আলোচনা করেছে। আলোচনার পর নিরাপত্তা পরিষদ ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। জরুরি ওই আলোচনায় জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক প্রধান জেফ্রি ফেল্টম্যান বলেন, এ ঘটনা ইউক্রেন সংকট সমাধানের গুরুত্বকেই তুলে ধরেছে। নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের মধ্যে বিতর্ক হয়। রাশিয়ার প্রতিনিধি এ জন্য ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে সে দেশের সেনাবাহিনীর অভিযান চালানোকে দায়ী করেন। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইউক্রেনের বিদ্রোহী অধিকৃত এলাকা থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রে উড়োজাহাজটি ধ্বংস হয়েছে মন্তব্য করে বলেছেন, এ বিষয়ে সত্য খুঁজে বের করা হবে। গতকাল হোয়াইট হাউসে এক ব্রিফিংয়ে ওবামা বলেন, এ জঘন্য কাজটি এটাই সামনে তুলে এনেছে যে ইউক্রেনে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি পূর্ব ইউক্রেনে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান। এর আগে একজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তাও বলেন, ওয়াশিংটন দৃঢ়তার সঙ্গে সন্দেহ করে, ইউক্রেনের মস্কোপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে উড়োজাহাজটি ভূপাতিত করেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, উড়োজাহাজ ভূপাতিত করার এ ঘট্নায় অবাধ ও পক্ষপাতহীন তদন্ত হওয়া জরুরি। পুতিন এ ঘটনাকে ‘বিয়োগান্ত’ আখ্যা দিয়েছেন। তবে বিমানটিতে কারা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল, সে বিষয়ে কিছু বলেননি। অভিযোগ অস্বীকার করে ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দাবি করেছে, তাদের হাতে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নেই। বরং ইউক্রেনের সেনাবাহিনীই ওই ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। এ অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়ে ইউক্রেন বলছে, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছে রাশিয়া। ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চলকে যুক্ত করে নেওয়া নিয়ে কিছুদিন ধরে রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রটির সঙ্গে উত্তেজনা চলছে। ইউক্রেনের রুশপন্থীরা সেখানকার সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে। হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, তদন্তে যত দ্রুত সম্ভব সহায়তা দিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত। ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের (এনটিএসবি) এক কর্মকর্তা শিগগিরই ইউক্রেনের উদ্দেশে রওনা হবেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের গতকালই এ বিষয়ে জরুরি বৈঠক করার কথা। উড়োজাহাজটিতে নয়জন ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন। ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী গতকাল বলেছেন, রুশপন্থী বিদ্রোহীরাই ওই উড়োজাহাজ গুলি করে ভূপাতিত করে। এ ঘটনায় তাঁদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবোটও অভিযোগ করেছেন, রুশ-সমর্থিত বিদ্রোহীরাই এ হামলা চালিয়েছে। মালয়েশিয়ার পরিবহনমন্ত্রী লিয়াউ তিয়ং লাই গতকাল বলেছেন, উড়োজাহাজটি ইচ্ছাকৃতভাবে ভূপাতিত করার নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেলে তা হবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ও সভ্যতার বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা। মালয়েশিয়ার জন্য এ ঘটনা বিশেষ রকম শোকের। গত মার্চ মাসেই কুয়ালালামপুর থেকে ২৩৯ আরোহী নিয়ে বেইজিং যাওয়ার পথে একই বিমান সংস্থার আরেকটি উড়োজাহাজ রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছিল। আজও তার খোঁজ বা ঘটনার কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি। মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজটি গত বৃহস্পতিবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম থেকে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর যাওয়ার পথে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হয়। এটি রাশিয়ার সীমান্তবর্তী পূর্ব ইউক্রেনে ভূপাতিত হলে ২৯৮ আরোহীর সবাই নিহত হন। গতকাল পর্যন্ত এ হামলার দায়িত্ব কেউ স্বীকার করেনি। বিমানের ত্রুটি ছিল না: মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের ইউরোপ অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ ভাইস প্রেসিডেন্ট হুইব গোর্টার বলেছেন, উড়োজাহাজটি ১৯৯৭ সাল থেকে চলছিল। এর রক্ষণাবেক্ষণ রেকর্ড ভালো ছিল। বিধ্বস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এর সঙ্গে যোগাযোগ ঠিক ছিল। রুট নিয়েও কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। আরও অনেক বিমান সংস্থার উড়োজাহাজই ওই সময় সে পথে চলছিল। তদন্তে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি: উড়োজাহাজটি ভূপাতিত হয় রাশিয়ার সীমান্ত থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলে। ওই অঞ্চলে রুশপন্থী বিদ্রোহীদের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে। রুশপন্থী এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার পর তাঁরা গতকাল সেখানে পৌঁছেছেন। তবে তাঁদের পুরোপুরি প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি বলে জানানো হয়েছে। এলাকাটিতে অস্ত্রধারী বিদ্রোহীরা ঘোরাফেরা করছিল। বিদ্রোহীরা বলেছিল, বৃহস্পতিবার তারা উড়োজাহাজটির একটি ব্ল্যাক বক্স খুঁজে পেয়েছে। গতকাল আরেকটি ব্ল্যাক বক্স পান উদ্ধারকর্মীরা। তবে পরে বিদ্রোহীদের এক নেতা ব্ল্যাক বক্স পাওয়া ও তা রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়ার খবর অস্বীকার করেছেন। ব্ল্যাক বক্সে উড়োজাহাজের উড্ডয়নের সময়ের সব ধরনের তথ্য সংরক্ষিত থাকে। জরুরি ত্রাণকর্মীরা জানিয়েছেন, অন্তত ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে উড়োজাহাজটির ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল পর্যন্ত অন্তত ১০০ জন আরোহীর ছিন্নভিন্ন দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সত্য খুঁজে বের করা হবে: ওবামা নিহত যাত্রীদের মধ্যে নেদারল্যান্ডসের ১৮৯, মালয়েশিয়ার ৪৪, অস্ট্রেলিয়ার ২৭, ইন্দোনেশিয়ার ১২, যুক্তরাজ্যের ৯, জার্মানি ও বেলজিয়ামের ৪ জন করে, ফিলিপাইনের ৩ জন এবং কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের ১ জন করে ছিলেন। বাকি ৪ জনের নাগরিকত্ব নিশ্চিত হওয়া যায়নি

No comments:

Post a Comment