গত দুই মাসে মন্ত্রিসভা বৈঠকে চূড়ান্ত ও নীতিগত অনুমোদন পাওয়া তিন আইন নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার। এর মধ্যে বিদেশি অনুদান আইন নিয়ে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা ও এনজিওগুলো উদ্বিগ্ন। এনজিওগুলোর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ-সংক্রান্ত খসড়া আইনটি বাতিলের দাবিও উঠেছে। ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইনে নানা ফাঁকফোকর থাকায় তা নিয়ে সমালোচনা সর্বত্র। আর ইপিজেডে শ্রমিক সংগঠন করার সুযোগ রেখে সংশোধন করা ইপিজেড শ্রম আইন নিয়েও উ
দ্বেগ কম নয়। বিদেশি অনুদান নেওয়ার ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে এবং অনুমোদন ছাড়া প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না করার বিধান রেখে ২ জুন ‘বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন-২০১৪’-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। প্রস্তাবিত আইনে রাজনৈতিক দল, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মচারী, জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থীরা বিদেশি অনুদান নিতে পারবেন না। বিদেশি অনুদান নেওয়া এনজিওগুলোর বিদেশি উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা ছাড়পত্র নিতে হবে। কোনো এনজিও ফৌজদারি অপরাধ, যেমন- সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদে অর্থায়ন ও সহযোগিতা, নারী-শিশুপাচার, মাদক-সংক্রান্ত অপরাধ করলে দেশের প্রচলিত আইনে আলাদাভাবে তাদের বিচার করা যাবে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী, বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওগুলোর মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড় হয়েছে। ব্যুরোর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে দুই হাজার ৩০৩টি এনজিও। এগুলোর বাইরেও সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে কয়েক লাখ এনজিও। এই অবস্থায় বৈদেশিক অনুদান আইন সংশোধনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায় চালু এনজিওগুলো। এগুলোর মধ্যে অজানা আশঙ্কাই কাজ করছে বেশি। স্টেকহোল্ডার হিসেবে এনজিওগুলোর সঙ্গে কথা বলে আইনটির খসড়া করা হলেও চূড়ান্ত খসড়ায় কী আছে তা তাদের জানানো হয়নি। এই অবস্থায় গত ৮ জুন বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের তৎকালীন প্রধান উইলিয়াম হানা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে বৈঠক করে নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ ছাড়া ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ-টিআইবিসহ ১৫টি বেসরকারি সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এরা আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে আইনের কপি চেয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনজিও) ওপর বিধিনিষেধ আরোপ-সংক্রান্ত খসড়া বাতিল করার তাগিদ দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ)। এইচআরডাব্লিউয়ের এশিয়াবিষয়ক উপপরিচালক পিল রবার্টসন বিবৃতিতে বলেন, খসড়া এই আইনটি খুব সহজেই অপব্যবহার করা সম্ভব। নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটির ওয়েবসাইটে গত ৬ জুলাই রবিবার এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এ সংস্থার মতে, বাংলাদেশে অবস্থিত যেকোনো আন্তর্জাতিক বা বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানের তহবিল নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে এই আইনে। বৈদেশিক তহবিলের প্রকল্পগুলো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অবস্থিত এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মাধ্যমে অনুমোদন দেওয়া হবে। এর মধ্যদিয়ে এনজিও এবং এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি এবং দলের কার্যকলাপ গভীরভাবে যাচাই-বাছাই করা হবে। রবার্টসন আরো বলেন, সরকারি-বেসরকারি খাত দুর্নীতিতে সয়লাব। সেখানে সরকার নতুন করে এনজিওর জন্য আইন প্রণয়নে ব্যস্ত। এমন অবস্থায় দেশে দুর্নীতি আরো বাড়বে বলে তিনি মন্তব্য করেন। খসড়া আইনের চারটি বিধান নিয়ে এনজিওগুলোর প্রবল আপত্তি রয়েছে। বর্তমান আইনে এনজিও ব্যুরো আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে এনজিওকে নিবন্ধন দিয়ে থাকে। নতুন খসড়া আইনে ৯০ দিনের মধ্যে নিবন্ধন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে করে এনজিও ব্যুরো তাদের ইচ্ছামতো হয়রানি করতে পারবে। বর্তমান আইনে যেকোনো প্রকল্প ৪৫ দিনের মধ্যে অনুমোদন বা বাতিল করতে হয়। প্রস্তাবিত আইনে এই সময়সীমাও তুলে দিয়ে প্রকল্প অনুমোদনের কাল সীমাহীন করা হয়েছে। নতুন খসড়ায় কেউ আইনের ব্যত্যয় ঘটালে ব্যুরো সংশ্লিষ্ট এনজিও বিলুপ্ত করতে পারবে। প্রয়োজনে সরকার যেকোনো সময় এনজিওতে প্রশাসক নিয়োগ করতে পারবে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম) রেগুলেশন আইনটির কিছু বিষয় নিয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ রয়েছে। বিষয়গুলো আমরা সরকারকে জানিয়েছি। আশা করি সরকার আমাদের সঙ্গে আলোচনা করবে। কারণ এ আইন প্রণয়নে আমরাও সরকারকে পরামর্শ দিয়েছি। আমাদের বেশ কিছু পরামর্শ গ্রহণ করা হয়েছে আইনে। আবার নতুন কিছু বিতর্কিত বিষয়ও স্থান পেয়েছে।’ একটি এনজিওর প্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার এমএলএম বা কম্পানিতে প্রশাসক বসাতে চেয়েছিল, কিন্তু এফবিসিসিআইয়ের চাপে সে অবস্থান থেকে সরে আসে। এখন এনজিওতে প্রশাসক বসাতে চাচ্ছে সরকার। বর্তমান আইনে ৯০ দিনের মধ্যে এনজিওর নিবন্ধনের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হয়। এটা সীমাহীন করে দিলে এনজিও ব্যুরো আমাদের হয়রানি করবে। প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটতে পারে। এনজিও ব্যুরোকে যেকোনো এনজিও বিলুপ্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক বাংলাদেশি তাদের প্রবাসী আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে বিদেশ থেকে ছোট আকারের তহবিল সংগ্রহ করে। দেশের দুস্থদের সহায়তার জন্য ব্যক্তিগতভাবে এসব টাকা আনতে হয়। নতুন আইনে ব্যক্তিগতভাবে এসব তহবিল আনা যাবে না। এই ফান্ড বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের দুস্থ মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ খাবারে কোন মাত্রার ফরমালিন থাকলে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে সেটা নির্ধারণ না করেই ‘ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৪’ চূড়ান্ত করেছে মন্ত্রিসভা। ফরমালিনের অপপ্রয়োগের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হয়েছে। কারাদণ্ডের পাশাপাশি ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধানও রয়েছে খসড়া আইনে। এ ছাড়া লাইসেন্স ছাড়া ফরমালিন আমদানি, উৎপাদন, পরিবহন, মজুদ, বিক্রি ও ব্যবহার করা যাবে না। গত ৩০ জুন তড়িঘড়ি করে এ আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিসভায় ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়া অনুমোদনের পর বিবৃতি দিয়েছে সিটিজেন রাইটস মুভমেন্ট। তারা বলেছে, ফরমালিন-সংক্রান্ত আইন করা হচ্ছে খাবারে অবাধে ফরমালিন মেশানো বন্ধে। এখানে যে বিষয়টি মূল তা হচ্ছে খাবারে ফরমালিন ব্যবহার। কিছু খাবার আছে সেগুলোতে ফরমালিন ব্যবহার না করলে তা পচে যাবে। কিন্তু সেই খাবারে কী পরিমাণ ফরমালিন ব্যবহার করা যাবে তা আইনে বলা নেই। সরকারের তরফে বলা হচ্ছে এটা বিধিমালায় থাকবে। যে বিষয়টি নিয়ে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে সেখানে না রেখে বিধিমালায় রাখা হবে তা কোন ভরসায় বিশ্বাস করি। কারণ বাংলাদেশের অসংখ্য আইন রয়েছে যেগুলো বিধিমালার অভাবে কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। সিটিজেন রাইটস মুভমেন্টের মহাসচিব তুষার রেহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি শুধু ফরমালিনের মাধ্যমেই নয়, সব ধরনের রাসায়নিক থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে। সরকারের মনোযোগ শুধু ফরমালিনে। প্রক্রিয়াজাত খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃত্রিম রংসহ নানা ধরনের রাসায়নিক। মাঠপর্যায় থেকেই এসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন কম্পানি কৃষকদের মধ্যে এগুলো অবাধে বিক্রি করে। এসব বন্ধে মাঠপর্যায়ে সরকারের তদারকি বেশ নাজুক। ফরমালিন আইন করতে হবে- কোন খাবারে কোন মাত্রার ফরমালিন গ্রহণযোগ্য তা উল্লেখ করে। সেই সঙ্গে অন্যান্য রাসায়নিক ব্যবহারেও সরকারকে আইন করতে হবে। শুধু ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ করলেই চলবে না। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ইপিজেড) শ্রমিক সংগঠন করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে শ্রমিকরা পাচ্ছে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষি বা সিবিএ করার সুযোগ। এসব বিধান রেখে গত ৭ জুলাই ‘বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন-২০১৪’-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় মন্ত্রীদের মধ্যে স্পষ্ট দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে। বৈঠকে কয়েকজন মন্ত্রী এ বিষয়ে আরো চিন্তাভাবনা করার পরামর্শ দিয়েছেন। রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় শ্রমিক সংগঠন করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন। শ্রম মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ইপিজেডগুলোতে শ্রমিকদের সংগঠন করার সুযোগ দিতে দীর্ঘদিন ধরে তাগাদা ছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ক্রেতা দেশগুলোর। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের। গত বছরের জুন মাসে বাংলাদেশের অবাধ বাণিজ্য সুবিধা বা জিএসপি স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। এই সুবিধা ফিরে পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ১৩ দফা ফরমায়েশ দেয়। গত এক বছরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রায় সব দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এই ১৩ দফা ফরমায়েশ পালন করার তাগিদ দেওয়া হয়। ১৩ দফার সাত নম্বরে বলা হয়েছে, ইপিজেড কারখানার শ্রমিকরা যাতে দেশের অন্যান্য স্থানের শ্রমিকদের মতো সংগঠন ও দরকষাকষির অধিকার পায় সে জন্য দ্রুত আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ইপিজেড আইন প্রণয়নের অঙ্গীকার করতে হবে বা বর্তমান আইন বাতিল করতে হবে। ইপিজেড আইন বাতিল বা যুগোপযোগী করার জন্য আইএলওর সঙ্গে সমন্বয় করে ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করতে হবে। ওই কর্মকর্তা আরো জানান, যখন ইপিজেড করা হয় তখন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বলা হয়েছিল- ইপিজেডে কোনো ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়া হবে না। তাঁদের এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে এ দেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করা হয়। এখন ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়া হলে তাঁরা মনঃক্ষুণ্ন হবেন এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়ার আগে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে পরামর্শ করার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
No comments:
Post a Comment