Monday, August 4, 2014

মালিকদের অপকৌশলেই ক্ষুণ্ন দেশের সুনাম:কালের কন্ঠ

তোবা গ্রুপের শ্রমিকরা তিন মাস দিনরাত খেটেও অভুক্ত অবস্থায় বেতনের দাবিতে পড়ে আছে অনশনে। কাজ করার পর বেতন পেতে শ্রমিকদের অনশনের এই ঘটনায় বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সুনামহানি হলে এর জন্য শ্রমিকদের কোনোমতেই দায়ী করার সুযোগ নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ জন্য সরকারের ‘বিজিএমইএ-প্রীতি’ ও তোবার এমডি দেলোয়ার হোসেনকে জেল থেকে ছাড়ানোর জন্য মালিকদের কূটকৌশলকেই দায়ী করছেন তাঁরা। এ ক্ষেত্রে দেলোয়ার হোসেনের মুক্ত
ির চেয়ে বহির্বিশ্বে দেশ ও পোশাক খাতের সুনাম রক্ষার বিষয়টি গৌণ মনে হয়েছে বিজিএমইএর কাছে। বিভিন্ন সময় শ্রমিক নির্যাতন ও অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ বিদেশিদের কাছে তুলে ধরে দেশের সুনামহানির অভিযোগ আনা হয়। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরে ইন্ডাস্ট্রি অল বাংলাদেশের নেতা নজরুল ইসলাম খান ও রায় রমেশ চন্দ্র সেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যুক্তরাষ্ট্রে লিখিতভাবে নালিশ করার জন্য। কিন্তু প্রতিনিয়ত মালিকদের খামখেয়ালিপনার কারণে শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের ঘটনার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে কোনো মালিককেই দোষী সাব্যস্ত করে অন্তত সতর্ক করার ঘটনা এ দেশে বেশ বিরল। অথচ বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ ও পোশাক খাতের সুনামহানির বড় অংশের জন্যই মালিক বা তাঁদের মনোনীত কারখানার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দায়ী। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সুনামহানির ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা বাতিলের মধ্য দিয়ে। শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন ও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার না দেওয়ার পাশাপাশি শ্রমিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলে অন্য খাতে পাওয়া জিএসপি বাতিল করেছে দেশটি। এ জন্য মালিকদের ভূমিকাকেই দায়ী করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে ১১২ ও রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩২ শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা না ঘটলে বাংলাদেশকে জিএসপি হারানোর মতো বড় লজ্জার মুখে পড়তে হতো না। আর এ ঘটনার জন্য গার্মেন্ট মালিকদের অতি মুনাফালোভী মনোভাবকেই দায়ী করছেন তাঁরা। তিনি বলেন, জিএসপি সুবিধা বাতিল হওয়ার পর বিশ্ব ক্রেতাদের দুই সংগঠন অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও বিশ্ব শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহায়তায় সুনাম পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্র তৈরি হলেও তোবা গ্রুপের শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন আটকে রেখে মালিক মুক্তির কৌশলে তাতে ফাটল ধরেছে। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বিজিএমইএর একজন সদস্য জানান, কোনো কারখানার মালিকই সরাসরি আর্থিক লেনদেন করেন না। সাধারণত হিসাব শাখার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) বা অন্য কোনো কর্মকর্তা কারখানার আর্থিক লেনদেন করে থাকেন। ফলে এমডি বা চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার হলেই সংশ্লিষ্ট কারখানার শ্রমিকদের বেতন আটকে যাবে- এমন ভ্রান্ত ধারণা কেবল বিজিএমইএর মুখেই শোভা পায়। তোবা গ্রুপের শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধের কাজটি ইচ্ছা করলে দেলোয়ারের স্ত্রী-শাশুড়ি বা অন্য কর্মকর্তাদের পক্ষেই করা সম্ভব। উদাহরণ দিয়ে ওই গার্মেন্ট মালিক বলেন, হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে। তাঁর স্ত্রী জেসমিন ইসলামও দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন। এমডি-চেয়ারম্যান দুজনই একসঙ্গে জেলে থাকলেও হলমার্ক গ্রুপের শ্রমিকদের বেতন বকেয়া পড়েনি। এখন হলমার্ক গ্রুপের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ রয়েছে। কিছু কারখানা চালু রেখে সাব-কন্ট্রাক্টের কাজ করছে গ্রুপটি। তা সত্ত্বেও ঈদের আগে হলমার্ক গ্রুপ জুলাই মাসের বেতন শ্রমিকদের দিয়েছে ঈদের আগেই। আগুনে পুড়ে তাজরীন ফ্যাশনসের ১১২ শ্রমিক হত্যার দায়ে গ্রেপ্তার থাকা দেলোয়ারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতা তোবা গ্রুপের চেয়ারম্যান, আর তাঁর শাশুড়ি ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে কারখানা চালাচ্ছেন। ফেব্রুয়ারিতে দেলোয়ারকে আটক করার পর থেকে তাঁদের সম্মতিতেই ব্যাংকের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন হয়েছে। তাঁদের নির্দেশনা অনুযায়ীই ব্যাংকে ঋণপত্র খুলে কাঁচামাল আমদানি হচ্ছে, তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত শ্রমিকদের বেতনও দেওয়া হয়েছে তাঁদের স্বাক্ষরেই। সে ক্ষেত্রে মে-জুলাই সময়ের বেতনের টাকা তুলতে গ্রেপ্তার থাকা দেলোয়ারের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা অবান্তর। শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতিটি কারখানার মালিকের বছর শেষে মোট মুনাফার ৫ শতাংশ অর্থ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে জমা দেওয়ার কথা। শ্রমিকদের আপৎকালীন বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ওই টাকা ব্যয় করার কথা আছে আইনের মধ্যে। কিন্তু সস্তা শ্রমিকের শ্রমে রপ্তানি করা পোশাক থেকে ১০০ টাকা মুনাফা করার পর সেখান থেকে মাত্র পাঁচ টাকা শ্রমিকদের কল্যাণে দিতেও নারাজ তাঁরা। শ্রম আইন সংশোধন করার সময় এ-সংক্রান্ত ধারাটি বাতিলে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিল বিজিএমইএ। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সিদ্ধান্তে সংশোধিত শ্রম আইনে ধারাটি থাকলেও কোনো মালিককেই তা মানতে বাধ্য করা যায়নি। আবার গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন হলেও বিজিএমইএ সরকারের অনেক ক্ষমতা ভোগ করছে। সরকার কখনো কোনো মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেই মালিককে আড়াল করে সামনে এসে দাঁড়ায় বিজিএমইএ। সংগঠনটিও শ্রমিকদের কল্যাণে বা কোনো সদস্যের অনুপস্থিতি বা কোনো কারখানার আর্থিক সংকটে সহায়তা করার মতো তহবিল গড়ে তোলেনি। ফলে বারবার জিম্মি হয়ে পড়ছে শ্রমিকরাই। তারা কখনো কখনো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেই দেশ ও পোশাক খাতের ভাবমূর্তি বা সুমানহানির ধুয়া তুলে তা দমনে মরিয়া হয়ে ওঠে সংগঠনটি। গার্মেন্ট মালিকরা নিজেদের স্বার্থে যে কেবল শ্রমিকদেরই জিম্মি করেন তা নয়, অনেক সময় সরকারকেও জিম্মি করার অপচেষ্টা চালান। আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে এক ঈদের দিনকয়েক আগে বিজিএমইএর তখনকার সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, পোশাক রপ্তানির ওপর ঘোষিত নগদ সহায়তার অর্থ সরকার ছাড় না করলে মালিকদের পক্ষে শ্রমিকদের বোনাস দেওয়া সম্ভব হবে না। শ্রমিক অধিকার রক্ষায় সোচ্চার রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, আগুনে পুড়ে তাজরীন ফ্যাশনসের ১১২ শ্রমিক নিহত হওয়ার পরও ওই কারখানার মালিক দেলোয়ার হোসেনকে শ্রম আইন মেনে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়নি। নিহত শ্রমিক পরিবারগুলো ক্ষতিপূরণ বলতে যে নগণ্য অর্থ পেয়েছে তার বেশির ভাগই দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে। আর লাশপ্রতি মালিকের যে এক লাখ টাকা করে দেওয়ার কথা, সেটা বিজিএমইএ দিয়েছে অন্য সব কারখানা থেকে দুই হাজার টাকা করে চাঁদা তুলে। মালিকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ক্ষেত্রে দেশের শ্রম আইন কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। বিজিএমইএর বাগড়ায় তখন গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি কারখানার মালিক দেলোয়ারকেও। তিনি বলেন, একই পরিস্থিতি দেখা গেছে রানা প্লাজা ধসে পড়ার ঘটনার পরও। লাশের সারি দীর্ঘ হতে থাকলে পুলিশ গ্রেপ্তারের জন্য ওই ভবনের পাঁচ কারখানার মালিককে কোথাও খুঁজে পায়নি। কয়েক দিন পর বিজিএমইএ সরকারের সঙ্গে আপস করে এই শর্তে যে মালিকদের হেনস্তা করা না হলে তাঁরা আত্মসমর্পণ করবেন। এর পরই পাঁচ কারখানার মালিক বিজিএমইএ ভবনে এসে পুলিশের কাছে ধরা দেন। ওই সময় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন উৎস থেকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা জমা পড়ে। সেখান থেকে ২৩ কোটি টাকা আহত ও নিহত শ্রমিক পরিবারকে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। আর আনুষঙ্গিক কাজে ব্যয় হয়েছে চার কোটি টাকা। বাকি ১০০ কোটি টাকা এখনো প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলেই পড়ে আছে, আর নিহত-আহত পরিবারগুলো ধুঁকছে অভাব-অনটনে। রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩২ শ্রমিক নিহত হলেও শ্রম আইন অনুযায়ী মালিকদের কাছ থেকে লাশপ্রতি এক লাখ টাকা করে আদায়ের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি এখনো। রানা প্লাজা ধসের পর পোপ বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের শ্রমদাসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তাতে ‘মান’ যাওয়ার আশঙ্কা করে প্রতিবাদ জানাতে বিজিএমইএ সদলবলে পোপের কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। তবে প্রধানমন্ত্রীর আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত যায়নি তারা। এ তথ্য উল্লেখ করে একজন শ্রমিক নেতা বলেন, বিজিএমইএ নেতারা দেশের ও পোশাক খাতের ইমেজ রক্ষার নামে বিদেশে গিয়ে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করেন তার একাংশ দিয়েই তোবার শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু মালিক মুক্তির কৌশল নেওয়ায় সে পথে হাঁটার কথা ভাবনাতেই আনেননি তাঁরা। কম সুদের ঋণ, সরকারের নগদ সহায়তা, বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা শ্রমের সুযোগ নিয়ে ফুলে-ফেঁপে উঠছেন পোশাক খাতের মালিকরা। বছরে ২৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করা এ খাতের বেশির ভাগ মালিকই নামমাত্র পুঁজি নিয়ে এ ব্যবসায় আসার পর দুই যুগে বহু টাকার মালিক হয়েছেন। তা সত্ত্বেও সব সময়ই লোকসানে পোশাক খাত ধ্বংস হওয়ার জিকির তোলেন তাঁরা। অথচ ভারত, জাপান, চীনসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের পোশাক খাতে বিনিয়োগ করতে এলে তাদের সামনে পাথরের দেয়ালের মতো বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিজিএমইএ। ছয় বছর আগে বিজিএমইএর সভাপতি থাকাকালে আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ লিখিতভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব জমা দিয়ে রেখেছেন, যাতে পোশাক খাতে বিদেশি কোনো বিনিয়োগ আসার সুযোগ না দেওয়া হয়। তাঁর উত্তরসূরিরাও কোনোমতেই এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আসতে দেওয়ার পক্ষে নন। সম্প্রতি জাপানের সরকারি সংস্থা জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটি থেকে অনেকেই বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতে বিনিয়োগ করতে এসেছেন; কিন্তু বিজিএমইএর বাধার কারণে তাঁদের ফিরে যেতে হয়েছে।

No comments:

Post a Comment