পদ্মায় যাত্রীবাহী লঞ্চ পিনাক-৬ ডুবে যাওয়ার দু’দিন কেটে গেছে। কিন্তু এখনও খোঁজ মেলেনি ১৩২ যাত্রীর। তাদের খোঁজে উদ্বেগাকুল স্বজনের বুকফাটা কান্না আর আহাজারিতে এখনও ভারি পদ্মাতীর। উদ্ধারের দেরিতে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে কখনও কখনও এ কান্না পরিণত হয়েছে বিক্ষোভ-অবরোধে। কেউ কেউ এমনকি নেমেও পড়ছেন উত্তাল পদ্মায়। ট্রলার আর স্পিডবোট নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন নদী। প্রিয় মানুষগুলোকে জীবিত না হোক, অন্তত লাশ চান তারা। কিন্
তু মঙ্গলবার রাত ৯টা পর্যন্ত ডুবে যাওয়া লঞ্চটির হদিসই করতে পারেনি উদ্ধারকারী দল। প্রতিকূল আবহাওয়া, উত্তাল ঢেউ, ঘোলা পানি আর তীব্র সে াতে প্রযুক্তিও কাজে লাগছে না ঠিকমতো। সোমবারের পর মাওয়া থেকে উদ্ধার হয়নি কোনো লাশও। তবে বেশ দূরে চাঁদপুরের হাইমচরে মেঘনায় মিলেছে দুই লাশ। তারা পিনাক ৬-এর হতভাগ্য যাত্রী ছিলেন কিনা তা নিয়ে চলছে নিরীক্ষা। আগের দিন পদ্মায় লাশ মিলেছিল পাঁচজনের। সোমবার প্রায় তিনশ’ যাত্রী নিয়ে শরীয়তপুরের কাওড়াকান্দি থেকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়াঘাটে আসার পথে ডুবে যায় ফিটনেসবিহীন লঞ্চ পিনাক-৬। ১২৫-এর মতো যাত্রী বেঁচে আসতে পারলেও এখনও নিখোঁজ অনেকেই। মুন্সীগঞ্জের পুলিশ প্রশাসন এদের ১৩২ জনের যে তালিকা তৈরি করেছে তার মধ্যে ৩৬ জনই শিশু। ৬৯ জন মহিলা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, তাদের কেউ আর বেঁচে নেই। এখন শুধু লাশের অপেক্ষা। কিন্তু বারবার উদ্ধারকাজ ব্যাহত হওয়ায় কেবলই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে তা। ডুবে যাওয়া লঞ্চটি শনাক্ত ও নিহতদের লাশের সন্ধানে মঙ্গলবার বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসি, র্যাব, নৌ-পুলিশ, থানা পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদস্যরা যৌথভাবে তৎপরতা চালিয়েও আশানুরূপ ফল পায়নি। লঞ্চটি উদ্ধারের জন্য নৌবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল কাজ করছে। উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা, রুস্তম, সন্ধানী, তিস্তাসহ আরও কয়েকটি ছোট-বড় জাহাজে করে লঞ্চটির সন্ধান চলছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা উদ্ধারকারী জাহাজ ‘নির্ভীক’ মঙ্গলবার সকাল ১০টা নাগাদ উদ্ধার অভিযানে যোগ দেয়। চট্টগ্রাম থেকে রওনা হয় ‘জরিপ-১১’ নামের একটি আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন জাহাজ। কিন্তু ১৬ কিলোমিটার আসার পর বিকল হয়ে পড়ে তা। পরে ‘জরিপ-১০’ নামে অনুরূপ জাহাজ পাঠানো হয়েছে। জাহাজাটি মধ্যরাত নাগাদ মাওয়ায় এসে উদ্ধার অভিযানে যোগ দিতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। সকালে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে চট্টগ্রাম থেকে লঞ্চ শনাক্তকারী জাহাজ ‘জরিপ-১০’ মাওয়ার উদ্দেশে রওনা হয়েছে।’ তিনি সমন্বয় সভা করে জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্টদের উদ্ধারকাজের বিভিন্ন নির্দেশনাও দিয়েছেন। নৌমন্ত্রী আরও বলেন, ‘লঞ্চটিতে কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে দেড়শ’ বা ১৬০ জন যাত্রী ওঠে। যদি ওই যাত্রী নিয়ে আসত, তাহলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটত না। কাঁঠালবাড়ী ঘাটে এসে আবার ৮০ থেকে ১০০ জন যাত্রী লঞ্চে উঠানো হয়। এই অতিরিক্ত যাত্রীই লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার কারণ। সব মিলিয়ে ২৫০ জনের মতো যাত্রী ছিল ওই লঞ্চে। এর মধ্যে নিখোঁজ যাত্রীর সংখ্যা ১২৫, উদ্ধার হয়েছে ১১০ জন।’ নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান আরও বলেন, ‘ভবিষ্যতে কেউ যাতে এভাবে মানুষের জীবন নিয়ে খেলতে না পারে সেজন্য সরকারও আরও কঠোর হবে। একটা মামলা আমরা করতে বলেছি লঞ্চের মালিক, শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনায় যারা ছিল তাদের আসামি করে।’ পিনাক-৬ এর মালিকসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে রাতে লৌহজং থানায় মামলা হয়েছে। সেনাবাহিনী ও র্যাব জড়িতদের গ্রেফতারে যৌথ অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল এ প্রতিবেদন লেখার সময় (রাত ৯টা) পর্যন্ত। নৌবাহিনীর একটি বিশেষ জাহাজ থেকে স্ক্যান করে নিমজ্জিত লঞ্চটির সন্ধান চালানো হচ্ছে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে ১০ কিলোমিটার ভাটি পর্যন্ত প্রতিবারে ১৫০ মিটার এলাকা ভাগ ভাগ করে স্ক্যান করছে জাহাজটি। কিন্তু এতেও আশানুরূপ ফল আসেনি। পদ্মায় ডুবে যাওয়া পিনাক-৬ লঞ্চ উদ্ধারে মঙ্গলবার নৌবাহিনীর জনবল দ্বিগুণ করা হয়েছে। উদ্ধারকারী দলের এক সদস্য জানান, জোয়ার-ভাটার টানে লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার স্থান থেকে যে কোনো দিকে সরে যেতে পারে কিংবা এটি নদীর কোনো খাদে পড়ে তার ওপর বালুচাপা পড়তে পারে। তাই লঞ্চটির অবস্থান শনাক্তকরণ দুরূহ হয়ে পড়েছে। নৌবাহিনীর ২৪ ডুবুরি কাজ করছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে অত্যাধুনিক ‘সাইট স্ক্যানার সোনার’ সরঞ্জাম টিম। উদ্ধার তৎপরতা জোরদার করতে মংলা থেকে নৌবাহিনীর চার সদস্যের হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে (জলসম্পদ বিষয়ক জরিপ) বিশেষজ্ঞ দলও ঘটনাস্থলে এসেছে। তারা সাইট স্ক্যানার সোনার ও হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে দিয়ে লঞ্চটির অনুসন্ধান করছেন। নৌবাহিনীর পরিচালক (গোয়েন্দা) কমোডর রাশেদ আলী জানান, তীব্র স্রোত ও ঘোলা পানির কারণে স্ক্যানার ভালোভাবে কাজ করছে না। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক (অপারেশন) ভরত চন্দ বিশ্বাস যুগান্তরকে জানান, ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলসহ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও চাঁদপুর ইউনিটের ৮০ জনের বেশি সদস্য কাজ করছেন। তাদের ডুবুরিদের তিনটি দল লঞ্চটির অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। লঞ্চ উদ্ধারের পাশাপাশি নিখোঁজদের লাশ উদ্ধারেও কাজ করছেন তারা। তাদের ডুবুরি দল বেশ কিছু ব্যাগ উদ্ধার করে। প্রমাণ দিয়ে স্বজনরা অনেকগুলো ব্যাগ ইতিমধ্যে নিয়ে গেছেন। উদ্ধারকাজে সেনাবাহিনীর ৫৮ বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিপুলসংখ্যক সদস্য যোগ দিয়েছেন। ক্যাপ্টেন ফয়সাল জানান, সেনাবাহিনী নদীতে লাশ সন্ধানের পাশাপাশি তীরে যানজট নিয়ন্ত্রণ ও সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় কাজ করছে। সেনাবাহিনীর প্রায় ৮০ জন সদস্য উদ্ধার অভিযানে রয়েছেন। মাওয়ায় সাব-কন্ট্রোল রুম খুলেছে মুন্সীগঞ্জ জেলা পুলিশ প্রশাসন। তারা নিখোঁজদের তালিকা তৈরি, উদ্ধারকৃতদের লাশ হস্তান্তরসহ আইনশৃংখলা রক্ষায় কাজ করছেন। সেখানে লৌহজং, শ্রীনগর, সিরাজদিখান ও মুন্সীগঞ্জ সদর থানার পুলিশ সদস্যরা কাজ করছে। মুন্সীগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়, লৌহজং ও শ্রীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরাও আহতদের সেবা দেয়া, নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনের সাময়িক চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। তদন্ত কমিটি আসেনি : ঘটনার তদন্তে সরকার ২টি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছে। তাদের ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কমিটির কেউ ঘটনাস্থলে আসেননি। লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ খালেকুজ্জামান যুগান্তরকে জানান, সন্ধ্যা পর্যন্ত তদন্ত কমিটির কেউ ঘটনাস্থলে এসেছেন বলে জানতে পারেনি তারা। লাশের খোঁজে পদ্মায় : উদ্ধারকারী দল লঞ্চ ও লাশ খুঁজে না পাওয়ায় স্বজনহারা মানুষ নিজেরাই ট্রলার ও স্পিডবোট ভাড়া করে লাশের খোঁজে পদ্মার বুক চষে বেড়াচ্ছেন। শিবচরের হাবীবুর রহমান জানান, তার প্রতিবেশী ফাতেমা আক্তার স্বর্ণা ও লাকি নিখোঁজ। তিনিসহ আরও কয়েকজন ৫ হাজার টাকায় একটি স্পিডবোট ভাড়া করে শরীয়তপুরের সুরেশ্বর পর্যন্ত খুঁজে এসেছেন। কিন্তু লাশ পাননি। তার মতোই আলমগীর, হেলাল, রাকিব, রাসেলসহ অনেকে গেছেন ট্রলার নিয়ে। কিন্তু সবাই বিফল হয়ে ফিরে এসেছেন। তারা জানান, কাল (আজ বুধবার) কিছু লাশ ভেসে উঠতে পারে। তখন হয়তো স্বজনদের লাশও পাওয়া যাবে। তাই তারা উদ্ধারকারী দলের পাশাপাশি নিজেরা আবারও খুঁজতে বের হবেন। সড়ক অবরোধ : বিভিন্ন গণমাধ্যমে লাশ উদ্ধারের বিভ্রান্তিকর তথ্যপ্রচার ও ভুল নাম-ঠিকানা আসায় সড়ক অবরোধ করেন নিখোঁজদের স্বজনরা। এ সময় বিক্ষুব্ধরা সেখানে সংবাদ সংগ্রহরত বাংলাভিশনের দুই সংবাদকর্মীকে মারধর করেন। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন তারা। পরে পুলিশ প্রশাসন তাদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলে অবরোধ তুলে নেন তারা। এরপর যানজট ও পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। আর আগের রাতেই দুয়েকটি স্থানে বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয়রা। স্বজনহারাদের যত অভিযোগ : ‘ভাই সরকারকে একটু বলেন না আমরা যাতে লাশটা পাই, আর কতক্ষণ এখানে থাকমু। আরেকটা অনুরোধ সরকারকে বলেন, আমার দুই বছরের মাইয়া সারার লাশটার পেট কেটে যেন নদীতে ফেলে না দেয়।’ দুঃখভরা হƒদয়ে কথাগুলো বলেন নারায়ণগঞ্জের শহীদুল ইসলাম। উদ্ধারকাজে ধীরগতিতে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। বললেন, ‘কেন লঞ্চ খুইজ্যা পাইব না, এত বড় বড় জাহাজ, এতকিছু, এই নদী থেকে লঞ্চ খুইজা না পাইলে সাগরে ডুলে কি হইত। স্ত্রী সায়মা, মেয়ে সারা আর ভাতিজী রোজিনাকে হারানো শহীদুল এভাবেই ক্ষোভ জানান। ফরিদপুরের ভাঙ্গার জিয়াদ বলেন, দেশে কি আসলে কোনো সরকার আছে? থাকলে একটি লঞ্চ দুদিনে খুঁইজা পাবে না- এটা কেমন কথা। চাচা রেজাউলের খোঁজে এসেছেন তিনি। চাচার ব্যাগটি পেয়েছেন। কিন্তু চাচার সন্ধান পাননি। গোপালগঞ্জের মোকসেদপুর দীঘিরপাড় গ্রামের নাজমুল এসেছেন তার ভাতিজি পলি বেগম ও পলির ছয় বছরের মেয়ে মেঘলার খোঁজে। চোখের পানি মুছতে মুছতে তিনি বলেন, আর কতক্ষণ পর আমরা জানতে পারব, তাদের লাশ পাওয়া গেছে। হামজা-রুস্তম এত জাহাজ কিন্তু কেউ লঞ্চটি খুঁজে পেল না কেন? সিদ্ধিরগঞ্জের রিপন মিয়া খুঁজছেন তার ছয় মাস বয়সী মেয়ে জান্নাতের লাশ। বললেন ‘হায়রে কপাল আমার। এই ছোট্ট মাইয়াটারেও বাঁচাইতে পারলাম না। এখন তার লাশটাও পাই না। এই দেশে কি অইবো। আর্মিসহ এত মানুষ একটা লঞ্চ খুঁইজ্যা বাইর করতে পারে না।’ ফরিদপুরের আটরশি ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা কাউন্সিলর রেখা বেগমের ভাই, ভাবী, ভাতিজাসহ মোট ৭ আত্মীয় নিখোঁজ। তিনি বলেন, কিসের উদ্ধার অভিযান? ৩৫ ঘণ্টা চলে গেছে এখনও লঞ্চই শনাক্ত করতে পারা যায়নি। এত আস্তে আস্তে উদ্ধার অভিযান চললে প্রবল স্রোতে লঞ্চের অস্তিত্বই থাকবে না। লাশগুলো বালুর নিচে চলে যাবে। শিবচরের সাইফুল ইসলাম এসেছে তার মামা কফিল উদ্দিন সর্দার ও মামাতো বোন কল্পনার খোঁজে। তিনি বলেন, ‘যাতে ক্ষতিপূরণ না দিতে হয় তার জন্যই সরকার লঞ্চ উদ্ধারে টালবাহানা করছে।’ নৌমন্ত্রীর দুই ভাতিজি নিখোঁজ : মাওয়ায় ডুবে যাওয়া লঞ্চ পিনাক-৬-এ নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের তিন ভাগ্নি ছিলেন। তাদের মধ্যে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। অন্য দুজন এখনও নিখোঁজ। মঙ্গলবার মাওয়াঘাটে স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে মন্ত্রী এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, আমার খালাতো বোনের তিন মেয়েও লঞ্চে ছিল। এর মধ্যে একজন ইশরাত জাহান হীরা শিকদার মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। আরেকজন লাকি আরেকটি মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। অন্যজন স্বর্ণা কলেজে লেখাপড়া করত। মেঘনায় দুই লাশ : চাঁদপুর প্রতিনিধি ইকরাম চৌধুরী জানান, চাঁদপুরের হাইমচরে মেঘনা নদী থেকে অজ্ঞাত দুটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, যার একটি মুন্সীগঞ্জের লঞ্চডুবিতে নিহত কারও হয়ে থাকতে পারে বলে স্থানীয় পুলিশের ধারণা। হাইমচর থানার ওসি মোঃ মনিরুজ্জামান মোবাইল ফোনে জানান, উপজেলার নীলকমল ইউনিয়নের মধ্যচর এলাকার মেঘনা নদীতে সকালে দুটি লাশ ভাসতে দেখে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দেয়। পরে লাশ দুটি উদ্ধার করা হয়। দুটি মৃতদেহের মধ্যে একটি আনুমানিক ২২ থেকে ২৫ বছর বয়সী এক নারীর, অন্যটি আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী পুরুষের। ওসি বলেন, ‘পুরুষের লাশটি গলিত। সেটি কয়েক দিন আগের। তবে যে মহিলার লাশটি পাওয়া গেছে, সেটি মুন্সীগঞ্জের লঞ্চডুবির ঘটনার হতে পারে। চাঁদপুরের পুলিশ সুপার মোঃ আমির জাফর বলেন, ‘লাশ দুটির বিষয়ে পুলিশি তদন্ত চলছে। তবে তাদের নাম বা পরিচয় জানা যায়নি।’ নিখোঁজ যাত্রীদের লাশ যাতে স্রোতে সমুদ্রের পারি দিতে না পারে সে জন্য চাঁদপুর নৌবন্দরকে নির্দেশ দিয়ে এলার্ট জারি করেছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। বিআইডব্লিউটিএর চাঁদপুর বন্দর কর্মকর্তা মোঃ মোবারক হোসেন জানান, নৌ মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তারা পদ্মা-মেঘনায় নিখোঁজ যাত্রীদের সন্ধানে নেমে পড়েন এবং এ সন্ধান অব্যাহত থাকবে বলে জানান। চাঁদপুরের পুলিশ সুপার মোঃ আমির জাফর জানিয়েছেন, লঞ্চের নিখোঁজ যাত্রীদের সন্ধানে পুলিশ বাহিনীও সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। আপু হাত ছাড়িস না : ‘আপু আমার হাত ছাড়িস না। ছাড়লে মরে যাব। পিনাক-৬ ডোবার আগে বড় বোন ফালানীকে জড়িয়ে ধরে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন ছোট বোন দীপা। দীপা বেঁচে গেছেন। কিন্তু খোঁজ নেই ফালানীর। দীপা মাওয়াঘাটে শুধু মাতম করছেন। জানান, বোন ফালানী ভাই রুবেল, ভাগ্নি সাদিয়া, রত্না, সামিরা সবাই মিলে মাঝিরহাট থেকে রওনা দিয়েছিলেন গাজীপুরের উদ্দেশে। লঞ্চডুবিতে হারিয়ে যান বোন ফালানী ও ভাগ্নি সাদিয়া। তাদের বাড়ি মাদারীপুরের শিবচরের মানিকপুর এলাকায় বাড়ি হালানীর। কখনও ঢাকায় যাননি। ছোট ভাই রুবেল দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুরে থাকেন। বেড়ানোর উদ্দেশে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে তিন মেয়ে রত্না, সামিরা, সাদিয়া ও ছোট বোন দীপাকে নিয়ে ঢাকা যাচ্ছিলেন। লঞ্চটি ডুবার উপক্রম দেখে মোহাম্মদ সাদিক তার দুই শিশু ছেলেকে দুই হাতে শক্ত করে ধরেছিলেন। আর স্ত্রীকে বলেছিলেন তার প্যান্টের পকেট যেন শক্ত করে ধরে রাখে। একটি বেসরকারি কোম্পানির উচ্চপদস্থ এ কর্মকর্তা এভাবেই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার হাত থেকে ছুটে যায় দুই ছেলে আরাফ (৮) ও আনাম (৪)। স্ত্রী শেফালীও আর তাকে ধরে রাখেননি! মঙ্গলবার সকালেও মাওয়া ঘাটে স্ত্রী ও ছেলেকে পাওয়ার আশায় বিলাপ করে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলতে থাকেন, আমি এত বড় পাষণ্ড! আমি দুই হাতে আমার শিশুদের জলাঞ্জলি দিলাম। স্ত্রীকেও নদীতে রেখে এলাম। আমার বাজানের লাশটা দাও : ‘তোমরা আমার বাজানের লাশটা ফেরত দাও। আমার বাজানরে আমি একটু মনডা ভইরা দেহি। আমি টেকা চাই না আমার বাজানের লাশটা ফেরত চাই।’ একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে এ বিলাপ করছিলেন মধ্যবয়সী নারী ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার মধুখালি গ্রামের বাসিন্দা হাজেরা বেগম (৫৫)। দুদিন ধরে সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় এই মার চোখে এখন আর কোনো কান্না নেই। আধপাগল অবস্থায় চিৎকার করছে আর লোকজন দেখলে ছুটে যাচ্ছে তার ছেলের লাশের কোনো সন্ধান মিলেছে কিনা জানতে। হাজেরা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, সব কষ্ট কি গরিবের লেইগা, সুখ কি আমাগো কপালে নাই? স্বজনদের আজাহারি : মাওয়াঘাটে স্বজনদের আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। স্থানে বসে কেউ দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছেন আর এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছেন। স্বজনহারা মানুষগুলোর চেহারার দিকে তাকানো যায় না। কাঁদতে কাঁদতে তাদের চোখ ফুলে গেছে। গলা ভেঙে গেছে। এরপরও কাঁদছেন। শিবচরের ৫৫ বছরের সুমী বেগম কাঁদছেন তার মেয়ের জন্য। প্রধানমন্ত্রীর শোক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা নদীর লৌহজং চ্যানেলে মর্মান্তিক লঞ্চডুবিতে প্রাণহানির ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। মঙ্গলবার এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। এর আগে সোমবার শেখ হাসিনা যাত্রীবাহী লঞ্চটি উদ্ধারে সর্বাত্মক অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। থেমে নেই লঞ্চ চলাচল : দুদিন ধরে নিুচাপ থাকায় এবং নদী উত্তাল থাকায় ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত থাকা এবং একটি লঞ্চডুবির পরও থেমে থাকেনি মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটে লঞ্চ চলাচল। আইনের তোয়াক্কা না করে এসব লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক রেখেছে কর্তৃপক্ষ।
No comments:
Post a Comment