Monday, August 18, 2014

গার্মেন্ট শুধু দর্জির ভূমিকায়:যুগান্তর

তৈরি পোশাক রফতানি আয়ের হিসাবে বড় ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি বিরাজ করছে। বাস্তবে বাংলাদেশে গার্মেন্ট সেক্টর শুধু দর্জির ভূমিকা পালন করলেও এটাকে অর্থনীতিতে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে দেখানো হচ্ছে। অপরদিকে মূল্য সংযোজন (রফতানি আয় থেকে আমদানি ব্যয় বাদের ফলাফল) শূন্যের কোঠায় অবস্থান করলেও দেখানো হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। অথচ এ হিসাবের মধ্যে লুকিয়ে আছে রফতানি আয়ের পাচার করা টাকা, শুল্কমুক্ত কাপড় এনে খোলাবাজারে বিক্
রির মুনাফা, রিটেশন কোটার (ব্যবসায়িক খরচ) সুবিধাসহ নানা ধরনের ছল-চাতুরীর ফায়দা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গার্মেন্ট মালিকদের অনেকে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার সম্পদের বিপরীতে শত শত কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নিয়েছেন। আবার ব্যবসার লাভের বড় অংশ নানা কৌশলে নিয়ে যাচ্ছেন বিদেশে, গড়ে তুলছেন সেকেন্ড হোম। আর এই বিপুল অংকের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকের প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তিরাও রাতারাতি আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বড় আশংকার বিষয় এই যে, এভাবে অনিয়ন্ত্রিত শুভঙ্করের ফাঁকির ঋণ এক সময় সরকারের ঘাড়ে পাহাড়ের মতো বোঝা হয়ে চেপে বসতে পারে। কেননা সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, বিপুল অংকের এ ধরনের ঋণ অনেকেই কোনোদিন পরিশোধ করতে পারবেন না। তারা বিদেশে পালিয়ে গেলেও কারও কিছুই করার থাকবে না। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও ব্যাংকের সাধারণ আমনতকারী। সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমান ২০০৪ সালের ১০ মার্চ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে পোশাক শিল্প সম্পর্কে বলেছিলেন, পোশাক শিল্পের মালিকদের দেশে-বিদেশে অনেক সম্পদ রয়েছে। কিন্তু তারা ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি বা গার্মেন্টের কাঁচামালের জন্য দেশের মধ্যে শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন না। তিনি জানান, কমপক্ষে ২০০ পোশাক শিল্পের মালিক আছেন, যাদের নামে দেশে-বিদেশে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। ওই বক্তৃতায় তিনি এই শিল্পকে ‘দর্জিগিরি’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তার মতে, এই শিল্প থেকে দেশ দর্জির মজুরি ছাড়া আর কিছুই পাচ্ছে না। এদিকে তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, দীর্ঘ ১০ বছর পরেও সাইফুর রহমানের আলোচিত ওই মন্তব্য এখনও সত্য হিসেবে প্রমাণিত। একচুলও এদিক-সেদিক হয়নি। বরং বলতে গেলে এটাই বলতে হবে যে, গার্মেন্ট সেক্টর ক্রমেই আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ছে। এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কয়েকজন যুগান্তরকে জানিয়েছেন, গার্মেন্টের কাঁচামালের সবই এখনও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। এই খাতে মোট বিনিয়োগের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ চলে যাচ্ছে বিদেশে। কিন্তু সরকারের উচিত ছিল, এই আমদানির পরিমাণ ক্রমেই কমিয়ে আনতে দেশের মধ্য থেকে কাঁচামালের চাহিদা মেটানোর উদ্যোগ নেয়া। এজন্য সরকার পজিটিভ পলিসি গ্রহণ করে বেসরকারি বিনিয়োগের দুয়ার খুলে দিতে পারত। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সরকার গুরুত্বপূর্ণ এদিকে ন্যূনতম নজর দেয়নি। বরং সরকার একদিকে গার্মেন্টে ব্যবসার নামে কিছু অসাধু মালিককে বিনাশুল্কে আমদানি করা কাঁচামাল (কাপড়) দেশীয় বাজারে অবৈধভাবে বিক্রি করার সুযোগ করে দিয়েছে, অপরদিকে ভারত থেকে চোরাইপথে কাপড়সহ গার্মেন্টের বিভিন্ন কাঁচামাল ঢোকানোর পথও খোলা রেখেছে। এতে করে গার্মেন্ট সেক্টরে আমদানি কমানোর জন্য বেসরকারি উদ্যোগে যে ক’টি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তাও কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির বহুমুখী ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে। শুভঙ্করের ফাঁকি : গার্মেন্ট মালিকরা দীর্ঘদিন থেকে দাবি করে আসছেন যে, দেশের মোট রফতানি আয়ের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ জোগান দিচ্ছেন তারা। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, গত অর্থবছরে দেশের মোট রফতানি আয় হয় ৩ হাজার ১৯ কোটি ডলার। আর এর মধ্যে গার্মেন্ট সেক্টর রফতানি করে ২ হাজার ৪৪৯ কোটি ডলার। গার্মেন্ট মালিকরা সরাসরি এ রকম তথ্যের ভিতিত্তে মোট রফতানির ৪ ভাগের ৩ ভাগ সাফল্য দাবি করে আসছেন। কিন্তু বাস্তবে এ তথ্য বা দাবির কোনো সত্যতা নেই। কেননা, সংশ্লিষ্ট তিনটি সংস্থার (বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো) এ সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তারা শুধু রফতানি আয়ের তথ্যের ভিত্তিতে এই দাবি করছেন। কিন্তু পোশাক খাতের মোট রফতানি আয় থেকে মোট আমদানি ব্যয় বাদ দেয়া হয় না। এমনকি তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, গত বেশ কয়েক বছর ধরে গার্মেন্ট সেক্টরের আমদানির তথ্য সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো প্রকাশও করে না। বরং গোপন রাখে। এটি রহস্যজনক। তবে পোশাক রফতানি আয় থেকে এ খাতের আমদানি ব্যয় বাদ দিলে প্রকৃত রফতানির পরিমাণ খুবই কম। যেমন- সদ্য বিদায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৪৯ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। এই রফতানির পরিমাণকে প্রধান বেজলাইন ধরে গার্মেন্ট মালিকরা উল্লেখিত সাফল্যের দাবি করে থাকেন। কিন্তু বাস্তবে এবং অর্থনীতির নিয়মানুযায়ী এ হিসাব থেকে আমদানি ব্যয় বাদ দিয়ে নিট রফতানি আয় বের করার কথা। আর এতে দেখা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে গার্মেন্ট খাতে আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৭৮৯ কোটি ডলার। এখন মোট রফতানি থেকে ( ২৪৪৯-১৭৮৯) বাদ দিলে নিট রফতানির পরিমাণ থাকে ৬৬০ কোটি ডলার। প্রাপ্ত এ তথ্য বিশ্লেষণে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, গার্মেন্ট মালিক এবং তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সরকারের যারা এই সেক্টরে বিরাট অংকের রফতানি আয় দাবি করছেন তা একেবারে অসত্য, যাকে শুভঙ্করের ফাঁকি বললেও ভুল বলা হবে না। এদিকে রফতানির তথ্যের মধ্যে গরমিল প্রমাণিত হওয়ায় এ সেক্টরের মূল্য সংযোজনের হিসাবেও বিস্তর শুভঙ্করের ফাঁকি ধরা পড়েছে। যেমন- গার্মেন্ট মালিকদের দাবি অনুযায়ী মূল্য সংযোজন ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ বলা হচ্ছে ১০০ ডলার রফতানি আয় হলে ৭৫ থেকে ৮০ ডলার আমদানি বাবদ চলে যায়। ফলে অবশিষ্ট উল্লেখিত ২০-২৫ ডলার মূল্য সংযোজন। যদিও আগেই বলা হয়েছে যে, আমদানির তথ্য গোপন রাখা হয়। কিন্তু যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৭ শতাংশ সুদে বৈদেশিক মুদ্রায় রফতানি ঋণ পাওয়া, দেশীয় বস্ত্র ব্যবহার বাবদ ৫ শতাংশ নগদ সহায়তা ভোগ করা, শুল্কমুক্ত ভাবে আমদানি করা কাপড় খোলাবাজারে বিক্রি করার বাড়তি লাভসহ এসবের আর্থিক মূল্য বাদ দিলে এ খাতের প্রকৃত সংযোজন থাকছে শূন্যের কোঠায়। যে কারণে তৈরি পোশাক খাতের ভেতরের হিসাব-নিকাশকে অনেকে ‘মাকাল ফল’ এর সঙ্গে তুলনা করেন। যেভাবে পাচার হচ্ছে : তৈরি পোশাকের ১০০ ডলারের একটি এলসির বিপরীতে কাঁচামাল হিসাবে সর্বোচ্চ ৮৫ ডলারের ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলার সুযোগ রয়েছে। তবে রফতানিকারকরা সাধারণত ১০০ ডলারের অর্ডারের বিপরীতে ৭৫ ডলারের ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলেন। বাকি ২৫ ডলার থাকে নিট আয়। এ হিসাবে এই খাতে গড়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নিট আয় হচ্ছে। বাকি ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ এ খাতের আমদানি বাবদ বিদেশে চলে যাচ্ছে। কিন্তু মাস্টার এলসির (সমুদয় কাঁচামাল আমদানির একত্রিত একটি এলসি) মাধ্যমে যে পরিমাণ কাঁচামাল আনার কথা তা যাচাই বা মনিটরিং করার জন্য কাস্টমস ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো তদারকি নেই। যদিও সরকারের বিদ্যমান নিয়মানুযায়ী এটি তদারকি করে দেখার দায়িত্ব এই দুই সংস্থার। সূত্র জানিয়েছে, তদারকি করলে অর্থ পাচার ও কম কাঁচামাল আনার সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে বলে উভয়পক্ষ যোগসাজশের মাধ্যমে এ বিষয়টি গোপন রাখে। এদিকে জানা গেছে, ব্যবসায়িক খরচ মেটানোর নামে রফতানি আয়ের ১০ শতাংশ গার্মেন্ট মালিকরা বিদেশে রাখতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ যদি ১০০ ডলারের পণ্য রফতানির এলসিতে গার্মেন্ট মালিকের ২৫ ডলারের মূল্য সংযোজন থাকে তাহলে এই ২৫ ডলারের ১০ শতাংশ ব্যবসায়িক খরচ হিসেবে বিদেশে রাখা যাবে। অর্থাৎ আড়াই ডলার বিদেশে রাখার সুযোগ আছে। কিন্তু বাস্তবে এই বৈধ হিসেবের বাইরে অবৈধ পন্থায় বিপুল অংকের ডলার বিদেশেই থেকে যাচ্ছে বা পাঠানো হচ্ছে, যাকে আধুনিক অর্থনীতিবিদরা গার্মেন্ট মালিকদের বিদেশে ‘পাচারকৃত অর্থ’ হিসেবে অভিহিত করতে চান। অবৈধ পন্থার রুটের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ যুগান্তরকে বলেন, আমদানি করার সময় এলসিকৃত সমুদয় ডলারের বিপরীতে কাঁচামাল না এনে কিছু ডলার পাচার চ্যানেলে জমা রাখা হয়। একইভাবে রফতানি আয়ের একটি বিরাট অংশও বিদেশে ওই চ্যানেলে চলে যায়। যদিও কাগজপত্রে এর প্রমাণ রাখা হয় না। কিন্তু বাস্তবে বিদেশে অর্থ পাচারের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে প্রতি বছর তৈরি পোশাক খাতের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ (গড় হিসাব) বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। এ হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ১৮০ থেকে ২৭০ কোটি ডলারের রফতানি আয় পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই টাকায় তারা বিদেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, রফতানি আয়ের কত শতাংশ অর্থ দেশে আসে বা বিনিয়োগ হয়, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। তার মতে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে বাইরে চলে যাওয়া অর্থ কোনোভাবেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। ব্যক্তি বা কোনো দল অর্থ পাচার করলে অনেক সময় ফিরিয়ে আনা যায়, কিন্তু ব্যবসায়ী করলে তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। এ অবস্থার জন্য দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অবকাঠামোগত সমস্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সর্বোপরি সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভাবকে দায়ী করে তিনি বলেন, বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত না হলে আইন করে কখনও অর্থ পাচার রোধ করা যাবে না। অসম প্রতিযোগিতা : পোশাক রফতানির প্রতিটি এলসির বিপরীতে গড়ে সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যাক টু ব্যাক সুবিধার আওতায় পণ্য আমদানির সুযোগ রয়েছে, যা শুল্ক ছাড়াই আনা হয়। উপরন্তু, শুল্কমুক্ত সুবিধার এসব কাপড় ও কাঁচামালের একটা বড় অংশ খোলাবাজারেও বেআইনিভাবে বিক্রি হচ্ছে। এতে একদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হচ্ছে। অন্যদিকে বাড়তি মুনাফা চলে যাচ্ছে পোশাক শিল্প মালিকদের পকেটে। এছাড়া ভারত থেকে চোরাইপথে প্রচুর কাপড় আমদানি অব্যাহত আছে। অপরদিকে বাণিজ্যিকভাবে কাপড় আমদানিতে সব মিলে সর্বনিু ৩৭ থেকে সর্বোচ্চ ১০৮ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এ ধরনের ১০০ টাকার কাপড়ে খরচ পড়ে ১৩৭ থেকে ২০৮ টাকা। আর পোশাক খাতের জন্য শুল্কমুক্তভাবে আসা কাপড়ের দাম ১০০ টাকাই পড়ে। ফলে এই কাপড় বাজারে গেলে অসাধু ব্যবসায়ীদের যেমন বেশি লাভ হয়, তেমনি বাড়তি লাভ রফতানিকারকদেরও। বহুমুখী এই লাভের কারণে শুল্কমুক্তভাবে আসা কাপড়ের একটি অংশ চলে যাচ্ছে খোলাবাজারে। কিন্তু শুল্ক দিয়ে যারা বৈধভাবে কাপড় আমদানি করছেন তাদের খরচ বেশি পড়ছে। ফলে বাজারে ওইগুলো ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারছেন না। এতে যেমন বৈধ আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশীয় বস্ত্রশিল্পের মালিকরা। কাপড় ছাড়াও ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় সুতা, বোতাম, রঙ, ডাইস, রেজিম, পেপার, পলিপ্যাকসহ নানা ধরনের পণ্য আমদানি হয়। এগুলোও বেআইনিভাবে চলে যাচ্ছে খোলাবাজারে। সম্পদের চেয়ে ঋণ বেশি : দেশে পোশাক শিল্পের বিকাশ হলেও এগুলো এখনও ব্যাংক ঋণনির্ভরতা কমেনি। একটি রফতানি এলসি পেলেই শত কোটি টাকার ঋণ মিলে যাচ্ছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, অনেকের নিট সম্পদের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বেশি। ফলে একটা সময় ঋণভারে জর্জরিত হয়ে ব্যবসা বন্ধ করে কেউ কেউ পালিয়ে যাচ্ছেন। বেশ কয়েক বছর আগে এভাবে ব্যবসা বন্ধ করে সোনালী ও শিল্প ব্যাংকের ৫ কোটি টাকা মেরে দিয়ে পালিয়ে যান রাজ গার্মেন্টের মালিক। এ রকম আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে। এদিকে ব্যাংকগুলোও এই খাতে মাত্রাতিরিক্ত অর্থায়ন করে বিপাকে পড়েছে। একটি গ্র“প সমস্যায় পড়লে তাদের খেলাপি ঋণ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যাচ্ছে, যা ব্যাংকিং খাতকেও শংকায় ফেলেছে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি আতিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ১০০ ডলারের একটি এলসির বিপরীতে প্রথমেই কাপড়, সুতা, বোতাম, পলিব্যাগ ইত্যাদি আমদানিতে ৭৫ ডলার খরচ হয়ে যায়। অবশিষ্ট থাকে ২৫ ডলার। এটিকেই বলতে পারেন মূল্য সংযোজন। এই ডলার দিয়ে শ্রমিকের বেতন, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ বিল, বাড়ি ভাড়া, ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম, ব্যাংক ঋণের সুদসহ আনুষঙ্গিক খরচ মেটানো হয়। কোনো কারণে পণ্য জাহাজীকরণে দেরি হলে ক্রেতা ধরে রাখতে পণ্য পাঠাতে হয় বিমানে। এতে ভাড়া পড়ে অনেক বেশি। এ হিসাবে ১০০ ডলারের একটি এলসিতে ২ ডলারের বেশি মুনাফা থাকে না। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও যানজটে সরবরাহ ব্যাহত হলে এই ২ ডলার টেকানোও কঠিন হয়ে পড়ে। কাঁচামালে স্বনির্ভরতার উদ্যোগ নেই : সূত্র জানায়, দেশে এখনও পশ্চাৎসংযোগ শিল্পের বিকাশ ঘটেনি। ফলে পোশাক খাতের প্রায় সবটাই এখন আমদানিনির্ভর। এ থেকে শুধু সেলাই করার মজুরিটুকু পাওয়া যাচ্ছে। বাকি সব চলে যাচ্ছে বিদেশে। এ কারণে বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা দাবি করেছেন, পোশাক শিল্পের সব ধরনের কাঁচামালের জোগান দেয়ার শিল্প দেশে গড়ে তুললে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে, তেমনি স্থায়ী কর্মসংস্থানও গড়ে উঠবে। এর জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে বলেন, দেশের পশ্চাৎসংযোগ শিল্প সরকারের সহায়তার অভাবে দাঁড়াতে পারছে না। গ্যাস, বিদ্যুতের সংকট, চড়া ব্যাংক ঋণের সুদ, গলাকাটা সার্ভিস চার্জসহ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এই শিল্পের বিকাশে বড় বাধা। ফলে তৈরি পোশাক খাতে মূল্য সংযোজনের হার বাড়ছে না। তিনি বলেন, বস্ত্র খাতকে সহযোগিতা করলে তৈরি পোশাকের সমুদয় কাঁচামালের জোগান দেশ থেকেই দেয়া সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন অনুযায়ী সরকারের কাছ থেকে কার্যকরভাবে সার্বিক সহযোগিতা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হতে হবে।  

No comments:

Post a Comment