দিগন্তজোড়া তিস্তার কূল ছাপিয়ে আসা ঘোলা পানি। কোথাও কোথাও সবুজের ছোপ, কোথাও একটু আভাস। পানির ওপর মাথা তুলে আছে রোপা আমনের কয়েকটি তীক্ষ্ণ ডগা। লালমনিরহাট জেলার তিস্তার কূলঘেঁষা খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের খোলাহাটি গ্রামের কৃষক রাশেদুল ইসলাম সেদিকে আঙুলের ইশারা করে বললেন, ‘মোর পাঁচ দোন আমনের জমি। সব ডুবি গেইছে।’ বন্যায় এবার লালমনিরহাটে রোপা আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে দুই দিন থেকে জেলায় বন্যার পানি
নামতে শুরু করেছে। আবার নতুন করে উজান থেকে ঢল বা প্রবল বৃষ্টি যদি না নামে, তবে এই অঞ্চলের বন্যাকবলিত কিছু কিছু জমির ফসল টিকেও যেতে পারে বলে মনে করছেন জেলার কৃষি বিভাগের কর্তারা। উজানে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও প্রবল বৃষ্টিতে ১৪ আগস্ট থেকে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে জেলার ৪৫ ইউনিয়নের মধ্যে ১৫টি প্লাবিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে লালমনিরহাট সদর উপজেলার রাজপুর ও খুনিয়াগাছ, আদিতমারীর মহিষখোচা ও দুর্গাপুর, কালীগঞ্জের ভোটমারী, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, ডাউয়াবাড়ী, পাটিকাপাড়া, ফকিরপাড়া, বড়খাতা ও সিন্দুরনা এবং পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা। গত শনিবার রাজপুর, খুনিয়াগাছের গ্রামগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, পানি নামতে শুরু করেছে। এবারের বন্যায় এই এলাকায় বসতবাড়িতে তেমন পানি ঢোকেনি। দূরে দূরে সবুজ দ্বীপের মতো গাছগাছালিঘেরা বসতবাড়িগুলো ঘোলা পানির ভেতর উঁচু হয়ে আছে। তলিয়ে গেছে আমনের জমি। কোথাও কোথাও হাঁটুপানির নিচে ডুবে আছে আমনের চারা। কোথাও আবার কোনোমতে মাথা জাগিয়ে রেখেছে। এই বন্যায় জীবনযাত্রার তেমন দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়নি, আমন ফসলের ক্ষতিটাই প্রবল। তবে দুর্ভোগ হয়েছে গবাদিপশুর। মাঠ ডুবে আছে। চরে বেড়ানোর জায়গা নেই। রাস্তার দুপাশে শত শত গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া খুঁটিতে বাঁধা। তাদের খাদ্যাভাব প্রচণ্ড। রাজপুরের রতিপুর গ্রামের ময়নাল হক, কুইশ্যামারী গ্রামের বিমল বর্মণ, তাজপুরের সবুজ মিয়াসহ অনেকের সঙ্গে কথা হলো বন্যাকবলিত এলাকায়। তাঁদের কেউ এক দোন, কেউ পাঁচ দোন, কেউ ১২ দোন পর্যন্ত জমিতে রোপা আমন চাষ করেছেন। এখানে জমির হিসাব ২৭ শতাংশে এক দোন। এবার বৃষ্টি আর বন্যা যেন নিষ্ঠুর পরিহাস করেছে তাঁদের সঙ্গে। আমন চাষ যখন শুরু হয়, শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহে মোটেই বৃষ্টি ছিল না। দোনপ্রতি দেড় থেকে দুই হাজার টাকার চুক্তিতে পানি সেচ দিয়ে তাঁরা এবার রোপা আমন চাষ করেন। এখন সেই রোপা ধানের শিষ বের হওয়ার সময়। এমন সময় শুরু হলো প্রবল বৃষ্টি আর উজানের ঢলে বন্যা। গতকাল পর্যন্ত টানা ১০ দিন ধরে রোপা আমনের মাঠ তলিয়ে আছে। যদিও বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে, তবু তলিয়ে যাওয়া মাঠের রোপা আমনে আর ফলন হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই বলেই এসব চাষিদের ধারণা। রোদ পড়লে বানে ডোবা এসব রোপার চারা পচে যাবে। বন্যায় আমনের তো ক্ষতি হলোই উপরন্তু সেচের খরচের অতিরিক্ত টাকাও এবার আক্ষরিক অর্থেই পানিতে গেল তাঁদের। লালমনিরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাফায়েত হোসেন জানান, বন্যায় জেলার পাঁচ উপজেলার প্রায় ৯৭৫ হেক্টর জমির রোপা আমনখেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে লালমনিরহাটে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে বন্যা হওয়ায় (ফ্লাশ ফ্লাড) জলাবদ্ধতা সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বন্যাকবলিত এলাকা থেকে গত দুই দিন থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। যদি আবার উজানি ঢল বা অতিবৃষ্টি না হয়, তবে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। সে ক্ষেত্রে নিমজ্জিত ৯৭৫ হেক্টর রোপা আমন ধানের খেতের একটা বড় অংশ টিকে যেতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, শনিবার দুপুরে তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় তিস্তা ব্যারাজে ছিল ৫২ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার। এখানে বিপৎসীমা ৫২ দশমিক ৪০। তবে কাউনিয়ায় প্রবাহ বিপৎসীমার নিচে নেমে এসেছে। কাল এখান প্রবাহ ছিল ২৮ দশমিক ৪৪ সেন্টিমিটার, এখানকার বিপৎসীমা ৩০ সেন্টিমিটার। এ ছাড়া লালমনিরহাটে ধরলা নদীর পানিপ্রবাহও কাল বিপৎসীমার নিচে নেমে এসেছে। প্রবাহ ছিল ২৬ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার, বিপৎসীমা ২৬ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার। এদিকে বন্যার পাশাপাশি তিস্তার বিভিন্ন অংশে ভাঙনও শুরু হয়েছে। এর মধ্যেই প্রায় সাত শ পরিবার ভাঙনকবলিত হয়েছে। বন্যার পরে ভাঙনের তীব্রতা বাড়তে পারে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের আশঙ্কা।
No comments:
Post a Comment