Monday, August 18, 2014

মালয়েশিয়ার ধীরগতি, হতাশ বাংলাদেশ:প্রথম অালো

বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণের আশা নিয়ে সরকারিভাবে মালয়েশিয়া যেতে নাম নিবন্ধন করেছিলেন সাড়ে ১৪ লাখ মানুষ। এঁদের মধ্যে প্রথম দফায় যাওয়ার জন্য লটারিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন ১১ হাজার ৫৩৮ জন। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার খোকা তালুকদার তাঁদের একজন। তখন তাঁর আশা ও উৎসাহের শেষ ছিল না। কিন্তু গত দেড় বছরেও মালয়েশিয়া যেতে না পারায় তাঁর সেই আশা রূপ নিয়েছে হতাশায়। হতাশ কণ্ঠে খোকা তালুকদার গতকাল রোববার
প্রথম আলোকে বলেন, ‘লটারিতে নাম ওঠার পর আমাদের বলা হয়েছিল যেকোনো সময় মালয়েশিয়া চলে যাব। সেভাবে প্রস্তুতিও নিয়েছি। কিন্তু দেড় বছরেও যেতে পারিনি। আমরা কি আদৌ মালয়েশিয়া যেতে পারব?’ একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন বরিশালের কামাল হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খন্দকার সোহাগ, সুনামগঞ্জের ফকর উদ্দিন, চট্টগ্রামের মোবারক আলী, খুলনার টুকু বিশ্বাসসহ নাম নিবন্ধনকারীরা। চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০১২ সালের নভেম্বরে মালয়েশিয়া আবার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার বিষয়ে সমঝোতা করে। তবে এবার সরকারিভাবে (জিটুজি) কর্মী নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দুই দেশ। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বছরে অন্তত এক লাখ লোক মালয়েশিয়া যাবে। পাঁচ বছরে যাবে পাঁচ লাখ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত দেড় বছরে মাত্র চার হাজার ৫৩০ জন কর্মী মালয়েশিয়া গেছেন। এই ধীরগতিতে হতাশ সবাই। হতাশ সরকারও। অন্যদিকে গত কয়েক বছরে সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার হিড়িক পড়েছে। গত দেড় বছরে হাজার দেড়েক মানুষ অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে আটক হয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী রিচার্ড রায়ত জায়েমের নেতৃত্বে নয় সদস্যের প্রতিনিধিদল তিন দিনের সফরে আজ সোমবার ঢাকা আসছে। মালয়েশিয়ার মন্ত্রী এ সফরকালে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এ ছাড়া তিনি জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি) গিয়ে কর্মী নিবন্ধন, যাচাই, প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য বিষয় দেখবেন। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালয়েশিয়া শুরুতেই বলেছিল ৫০ হাজার লোক নেবে। ১০ হাজারের চাহিদাপত্রও পাঠিয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচ হাজার লোক নিয়েছে। এতে আমরা হতাশ। যারা নাম নিবন্ধন করেছিল, প্রথম দফায় যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছিল—সবাই হতাশ। মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনায় আমরা এই ধীরগতির ব্যাখ্যা চাইব।’ বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘ কূটনৈতিক যোগাযোগের পর এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে দেশটি। ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর দুই দেশের সরকারের মধ্যে সরকারিভাবে লোক নিতে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সেখান থেকে ফিরে ২ ডিসেম্বর ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলেছিলেন, জনশক্তি রপ্তানির ইতিহাসে এটি একটি মাইলফলক। এর ২৯ দিন পর ৩১ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, ‘নতুন বছরে দেশবাসীকে একটি সুখবর দিতে চাই। মালয়েশিয়া বনায়ন (প্লান্টেশন) খাতে কর্মী নিতে ১০ হাজার চাহিদাপত্র পাঠিয়েছে। তারা এই খাতে মোট ৩০ হাজার কর্মী নিতে চায়। এ জন্য ৩৫ হাজার কর্মীর একটি তথ্যভান্ডার করা হবে। ১৩ জানুয়ারি থেকে আগ্রহীদের নিবন্ধন সারা দেশে শুরু হবে।’ মাত্র ৩৩ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ নিতে সারা দেশে সাড়া পড়ে। গত বছরের ১৩ জানুয়ারি থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ১৪ লাখ ৪২ হাজার ৭৭৬ জন নাম নিবন্ধন করেন। নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে খচর হয় প্রায় সাত কোটি টাকা। নিবন্ধনকারীদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে ৩৬ হাজার ৩৮ জনকে নির্বাচিত করা হয়। ২৩ জানুয়ারি তাঁদের মধ্য থেকে প্রথম দফায় পাঠানোর জন্য লটারিতে ১১ হাজার ৭৫৮ জনকে নির্বাচিত করা হয়। ১৭ জুলাই আরও ১১ হাজার ৭০৪ জনকে নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু এই ২৩ হাজার কর্মীর মধ্যে এখন পর্যন্ত চার হাজার ৫৩০ জন কর্মী গেছেন। যাওয়ার প্রক্রিয়ায় আছেন ৪১৮ জন। সরকার বলেছিল, বনায়ন খাত ছাড়াও মালয়েশিয়া কৃষি, উৎপাদন, নির্মাণ ও সেবা খাতে লোক নেবে। চাহিদাপত্র এলে এসব খাতের জন্যও নিবন্ধন করা হবে। তবে এই খাতগুলোর চাহিদাপত্র এখনো আসেনি। বেসরকারি খাতের জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়েছে। অথচ ২০০৭ ও ২০০৮ সালে বেসরকারিভাবে চার লাখ লোক মালয়েশিয়ায় গিয়েছিল। এখনো তাঁদের মাধ্যমে লোক পাঠাতে দিলে তাঁরা বছরে এক লাখ লোক পাঠাতে পারতেন। তবে দ্বিতীয় মেয়াদে খন্দকার মোশাররফ প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী হওয়ার পর বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) নেতারা প্রকাশ্যে এ নিয়ে মন্তব্য করছেন না। তবে মন্ত্রী এখনো ব্যবসায়ীদের দায়ী করছেন। গতকালও তিনি বলেন, সরকারিভাবে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া ব্যর্থ করতে একটি চক্র কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে। অবশ্য বায়রার সভাপতি আবুল বাসার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেকোনো শ্রমবাজারের বিষয়েই আমরা সরকারের সঙ্গে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করতে চাই। তাতে দেশের মঙ্গল।’ প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ায় সরকারিভাবে কর্মী যাওয়ার ধীরগতিতে সরকারও হতাশ। চলতি বছরের জুলাই মাসে প্রবাসীকল্যাণসচিব খোন্দকার শওকত হোসেনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের প্রতিনিধিদল মালয়েশিয়ায় গিয়ে ধীরগতির বিষয়টি জানিয়ে এসেছে। খোন্দকার শওকত হোসেন গতকাল বলেন, ‘আমাদের লোক প্রস্তুত। কিন্তু তারা যেতে পারছে না। আমরা মালয়েশিয়ায় গিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, কেন তারা এত কম লোক নিচ্ছে। তারা বলেছে, বিষয়টি দেখবে। মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর ঢাকা সফরে এই বিষয়টি নিয়েই প্রধানত আলোচনা হবে।’ তিনি জানান, ‘বৈঠকে বনায়ন খাতের বাইরে নির্মাণ, কৃষি, সেবা ও উৎপাদন খাতে মালয়েশিয়া যেন কর্মী নেয় তা নিয়েও আলোচনা হবে। বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশটি। সেখানে এর আগে নারীকর্মী যায়নি। কাজেই কর্মপরিবেশসহ সবকিছু যাচাই করে সিদ্ধান্ত হবে। আশা করছি, এই বৈঠকের পর বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি পাঠানোর হার অনেক বাড়বে।’

No comments:

Post a Comment