Tuesday, August 5, 2014

মুক্তিযোদ্ধা সনদ চেয়ে ৯৫ হাজার আবেদন:কালের কন্ঠ

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কারা সনদ পাবেন- গত ৪৩ বছরেও তার নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে লতায়-পাতায় সম্পর্ক জড়িয়ে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য আবেদন করছেন। বিশেষ করে সরকারিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নানা সুবিধা ঘোষণা দেওয়ার পর আবেদন করা বেড়ে গেছে। গত বছরের ৬ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত নতুন করে সনদের জন্য আবেদন করেছেন ৯৫ হাজার জন। কর্তৃপক্ষ বলছে, সংজ্ঞা নির্ধারণের পর প্রক
ৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই শুরু হবে। এ পর্যন্ত যাঁরা সনদ নিয়েছেন তাঁদের সবাইকে যাচাইয়ের আওতায় আনা হবে। এর মাধ্যমে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে তাঁদের সনদ বাতিল করা হবে। থাকবে শাস্তির ব্যবস্থাও। ইতিমধ্যে যাঁদের বিরুদ্ধে জালিয়াতি করে সনদ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁদের যাচাইয়ের আওতায় আনা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সনদ বাতিল করা হচ্ছে। গত রবিবার ৩৫ জনের সনদ ও গেজেট বাতিল করেছে সরকার। এর মধ্যে একজন উপসচিব ও রেলের একজন অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপকসহ ৩০ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এর আগে বর্তমান সরকারের আমলেই বাতিল করা হয়েছে আরো ৩৯ জন সরকারি চাকরিজীবীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ অনলাইন ডেটাবেইসে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দুই লাখ ৩০ হাজার জনের তথ্য সংযুক্ত করা হয়েছে। যাঁরা সনদ পেয়েছেন এবং যাঁদের নামে প্রজ্ঞাপন (গেজেট) জারি করা হয়েছে তাঁদের প্রত্যেককে এ ডেটাবেইসে যুক্ত করা হয়েছে। গত বছরের ৬ অক্টোবর থেকে অনলাইনে মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য আবেদন নেওয়া হচ্ছে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) এসব আবেদন গ্রহণ ও যাচাই-বাছাই করে। জামুকার মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) এ কে এম খায়রুল আলম গত সোমবার জানান, গত ৯ মাসে সনদের জন্য অনলাইনে ৮০ হাজার আবেদন জমা পড়েছে। এর বাইরে সরাসরি কাগজপত্রসহ আবেদন জমা পড়েছে আরো প্রায় ১৫ হাজার। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব আবেদন যাচাই-বাছাই শুরু হবে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা সনদধারী সরকারি চাকরিজীবীদের চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়। এ ছাড়া সরকারি চাকরিতে নিয়োগ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার উত্তরাধিকারদের কোটার পরিধি আগের চেয়ে বাড়ানো হয়। এসব সুবিধার কারণে মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহের হিড়িক পড়ে যায়। ইতিমধ্যে কয়েক হাজার সরকারি চাকরিজীবী মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করে চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার মোট ১১ হাজার ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। লোভে পড়ে সরকারি চাকরিজীবীদের অনেকেই মিথ্যা তথ্য দিয়ে সনদ সংগ্রহ করছেন। যাচাই-বাছাইয়ের পর অনেকের সনদ বাতিল করা হয়ে হচ্ছে। এই মুহূর্তে কারো বিরুদ্ধে জালিয়াতি করে সনদ নেওয়ার অভিযোগ উঠলে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা- এনএসআইয়ের মাধ্যমে তদন্তের উদ্যোগ নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হলে সেগুলোও তদন্ত করে মতামত দেয় মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন, এ রকম তদন্তে কয়েক শ ভুয়া সনদধারীকে সম্প্রতি চিহ্নিত করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এদের সনদ ও গেজেট বাতিল করা হবে। তালিকায় কয়েকজন সচিবও রয়েছেন বলে জানা গেছে। তাঁদের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনও তদন্ত করছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী জানান, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করতে সনদ যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। এ পর্যন্ত যাঁরা সনদ নিয়েছেন তাঁদের সবাইকে এর আওতায় আনা হবে। এমনকি যাঁদের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের সনদও যাচাই করা হবে। এ জন্য উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হবে। গত কয়েক বছরে যত সরকারি গেজেট প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখবে কমিটি। তদন্তে অসত্য তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়া ব্যক্তি সরকারি কর্মকর্তা হলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবসরে গিয়ে থাকলে নেওয়া হবে ফৌজদারি ব্যবস্থা। বেসরকারি পেশায় নিয়োজিত কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁদের বিষয়টি স্থানীয় পর্যায়ে খতিয়ে দেখা হবে। অসত্য তথ্য দিয়ে যাঁরা সনদ নিয়েছেন, যাচাই-বাছাই শুরু হওয়ার আগে তাঁদের সনদ সমর্পণের সুযোগ দেওয়া হবে।  মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক কালের কণ্ঠকে জানান, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট না থাকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবিদারের সংখ্যা বাড়ছে। গেরিলা যোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে যাঁরা সহযোগিতা দিয়েছেন তাঁরাও এখন মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য আবেদন করছেন। তাই মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা এবং কারা এ সনদ ধারণ করার যোগ্য তা সুনির্দিষ্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ঈদের পরই এ-সংক্রান্ত বৈঠক হবে। সংজ্ঞা নির্ধারণের পরই শুরু হবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করার যাচাই-বাছাইয়ের কাজ। ২০১৪ সালের পর ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি আর থাকবে না। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি : প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তি রয়েছে। এ পর্যন্ত যেসব তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তাতে ক্রমাগতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। স্বাধীনতার পর ভারত থেকে যে কাগজপত্র দেওয়া হয়েছে তাতে ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে গণবাহিনীর ছিলেন ৫১ হাজার ৫২২ জন, অন্যরা ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর। এ তালিকায় অবশ্য মুজিব বাহিনীসহ অন্য স্বতন্ত্র বাহিনীর যোদ্ধাদের নাম যুক্ত ছিল না। ১৯৮৮ সালে এরশাদের আমলে তৈরি তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন। ১৯৯৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরির কাজ শুরু করলে আবেদন ফরম জমা পড়ে চার লাখ ৯০ হাজার। যাচাই-বাছাই শেষে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রকাশনা মুক্তিবার্তায় (লাল বই) ছাপা হয় এক লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে গেজেটে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ ৯৯ হাজার ৭৪৫ জন। সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনলাইন ডেটাবেইসে গত ৩০ মার্চ পর্যন্ত সংযুক্ত হয়েছে দুই লাখ ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তথ্য। যদিও গত বছরের ১০ জুন জাতীয় সংসদে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, সারা দেশে দুই লাখ পাঁচ হাজার ৪৮২ জন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন।

No comments:

Post a Comment