দিকে। চোখে-মুখে বাঁচার তীব্র আকুতি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পদ্মার উত্তাল জলের নিচে তলিয়ে যায় লঞ্চ। গতকাল সোমবার মুন্সীগঞ্জের লৌহজং টার্নিং পয়েন্টে মাওয়া ঘাটের কাছে এভাবেই ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের লঞ্চটি। ঘড়িতে তখন সকাল ১১টা। মাদারীপুরের কাওড়াকান্দি থেকে মাওয়া যাচ্ছিল লঞ্চটি। রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দুজনের লাশ পাওয়া গেছে। জেলা প্রশাসনের দাবি, শতাধিক যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ আছে ১২০ জন। তবে লঞ্চে ঠিক কতজন যাত্রী ছিল তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। সাঁতরে তীরে ওঠা যাত্রীদের দাবি, লঞ্চে যাত্রী ছিল প্রায় ৩০০। গতকাল রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ডুবে যাওয়া লঞ্চটির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। আকাশপথে হেলিকপ্টার ও নদীতে বিভিন্ন ধরনের নৌযানের মাধ্যমে তল্লাশি চলছে। উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা দিয়ে রাত সোয়া ৯টায় ঘটনাস্থলে পৌঁছে। তাদের এত দেরির কারণে নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজন ও স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ। ঘটনার পর নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ কয়েকজন সংসদ সদস্য এবং বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। তবে উদ্ধারকাজে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও নদীর উত্তাল অবস্থাকে উদ্ধারকাজে প্রতিবন্ধকতার জন্য দায়ী করছে প্রশাসন। লঞ্চ উদ্ধারে সর্বাত্মক তৎপরতা চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, “দুর্ঘটনার পরপরই নারায়ণগঞ্জ থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম রওনা হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থলে ঘূর্ণিস্রোত থাকায় ছোট উদ্ধারকারী জাহাজ কুলিয়ে উঠতে পারবে না বলে বিকেলে নারায়ণগঞ্জ থেকে আধুনিক উদ্ধার জাহাজ ‘নির্ভীক’কে তলব করা হয়েছে। তবে স্রোত বেশি থাকায় রাতের বেলায় উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব নাও হতে পারে।” মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদল গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘এ পর্যন্ত দুজনের লাশ পাওয়া গেছে। নিখোঁজ ১২০ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে। শতাধিক যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা গেছে। আমরা সর্বাত্মক উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে লাশ দাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা ও বিআইডাব্লিউটিএ এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা অনুদানের ঘোষণা দিয়েছে। নিহত দুজনের মধ্যে একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তিনি হলেন শরীয়তপুরের কাঁঠালবাড়ীর নূরুল হকের মেয়ে হীরা আক্তার (২০)। অজ্ঞাতপরিচয় আরেক নারীর বয়স পঞ্চাশের মতো। তবে দুজনকেই জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল। পার্শ^বর্তী শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পর হীরার মৃত্যু হয়। আরেকজন মাওয়া লঞ্চঘাটেই মারা যান। তাঁর লাশ মাওয়া নৌপুলিশ ফাঁড়িতে রাখা হয়েছে। হীরার লাশ রাখা হয়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও ঘাট সূত্র জানায়, কাওড়াকান্দি থেকে সকাল সাড়ে ৯টায় ছেড়ে আসে পিনাক-৬। সকাল ১১টার দিকে মাওয়া ঘাটের কাছে লৌহজং টার্নিংয়ে পৌঁছলে ঢেউয়ের তোড়ে লঞ্চটি ডুবে যায়। উদ্ধার পাওয়া যাত্রী মাদারীপুরের দুরাই এলাকার আফজাল হোসেন জানান, নদীতে প্রচণ্ড ঢেউ ছিল। ঢেউয়ের আঘাতে লঞ্চটিতে জানালা দিয়ে পানি উঠছিল। পানি উঠতে উঠতে একসময় লঞ্চটি আধাডুবু হয়ে যায়। এ সময় যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যাত্রীরা এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করলে লঞ্চটি কাত হয়ে পেছনের দিক প্রথমে তলিয়ে যায়। দ্রুত পুরো লঞ্চ ডুবে যায়। তাঁর সঙ্গে তাঁর ভাই মিজান (১৪), বোন ইমা (১৮) ও আফরোজা ছিল। তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের কামরুল হাসান ও তাঁর স্ত্রী তাসলিমা ছিলেন ওই লঞ্চে। গতকাল সন্ধ্যায় মাওয়া লঞ্চঘাটে কামরুল বলেন, লঞ্চটি ছাড়ার সময় বারবার দুলছিল। যাত্রী ছিল বোঝাই। পথে কাঁঠালবাড়ী ঘাট থেকে আরো লোক তোলা হয়। সব মিলিয়ে ডুবে যাওয়ার সময় অন্তত আড়াই শ যাত্রী ছিল। কামরুল বলেন, ‘হঠাৎ করে লঞ্চের পেছন দিক ডুবতে শুরু করে। যাত্রীরা বাঁ দিকে ঝুঁকে পড়লে ওই দিকেই লঞ্চটি ডুবে যায়। আমার এক সিট পরই বসে ছিল আমার স্ত্রী। আমি জানালা দিয়ে কোনো রকম বের হতে পারলেও ও আর বের হয়ে আসতে পারেনি। এখন আমি আমার পাঁচ বছরের বাচ্চাকে কী জবাব দেব।’ ডুবে যাওয়া লঞ্চের পাশ দিয়ে এ সময় মাওয়ায় আসছিল প্রিন্স অব মেদিনী মণ্ডল নামের একটি লঞ্চ। ওই লঞ্চের যাত্রী রুবেল জানান, লঞ্চটি ঢেউয়ের তোড়ে চোখের সামনে ডুবে যায়। পুরো লঞ্চটিই পাঁচ-সাত মিনিটে ডুবে যায়। এ সময় যাত্রীরা যে যেভাবে পেরেছে পদ্মায় লাফিয়ে পড়েছে। রুবেল বলেন, যাত্রীরা যখন নদীতে লাফিয়ে পড়ছিল, তখন আশপাশ দিয়ে যাওয়া লঞ্চ, সিবোট ও ট্রলার তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে। মাওয়া ঘাট থেকেও সঙ্গে সঙ্গেই সিবোট ও লঞ্চগুলো যাত্রীদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে। কিন্তু পদ্মায় যে স্রোত তাতে উদ্ধারের আগেই স্রোতের টানে অনেক যাত্রী দূরে চলে গেছে। লঞ্চের ওপরে-নিচে এমনকি ছাদেও যাত্রী ছিল। গাজীপুরের পরিবহন ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলেসন্তানসহ ঈদ করতে গিয়েছিলেন বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গ্রামের বাড়িতে। গতকাল তাঁরা পাঁচজন কাওড়াকান্দি থেকে লঞ্চে চড়ে মাওয়া হয়ে গাজীপুরের উদ্দেশে রওনা করেছিলেন। মিজানুরের স্ত্রী ও দুই মেয়ে জীবিত উদ্ধার হলেও মিজানুর নিজে ও ছেলে ইমতিয়াজ (১০) নিখোঁজ রয়েছে। মাওয়া ঘাটে আহজারি করছিল মিজানুরের কলেজপড়ুয়া মেয়ে আরিফিন, ‘আমার বাবা আর ভাইটারে আইনা দেন। আমরা আর কিছু চাই না। আমার বাঁইচা গেলাম, বাবা-ভাইরে রাইখা আমরা কেমনে বাড়ি যামু।’ দুর্ঘটনার পরপরই মাওয়া ঘাট থেকে বেশ কয়েকটি সি-বোট, লঞ্চ ও ট্রলার দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে যাত্রীদের উদ্ধারে তৎপরতা চালায়। এরপর খবর পেয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) কর্মকর্তারা ছুটে আসেন। তাঁরাও নিজস্ব বিভিন্ন নৌযান নিয়ে উদ্ধারকাজে অংশ নেন। পাশাপাশি সেনা ও নৌবাহিনী, র্যাব, কোস্টগার্ড, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থা যোগ দেয় উদ্ধার তৎপরতায়। দুটি হেলিকপ্টার ডুবে যাওয়া লঞ্চটির অবস্থান ও নিখোঁজ যাত্রীদের সন্ধান চালায়। বিকেল থেকে বিআইডাব্লিউটিএর ‘তিস্তা’ নামের একটি জাহাজ সাইড স্ক্যান সোনার ও সোলার যন্ত্র ব্যবহার করে লঞ্চটির অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা চলাচ্ছিল। জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান জানান, স্থানীয়ভাবে দুঘর্টনাস্থলে আশপাশে ট্রলার ও স্পিডবোট নিয়ে যাত্রীদের খোঁজা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর কাজ করতে আসা মাওয়ায় অবস্থানরত সেনাসদস্যরাও উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করছেন। দুর্ঘটনার খবর বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে লঞ্চে থাকা যাত্রীদের স্বজনরা বিভিন্ন এলাকা থেকে মাওয়া ও কাওড়াকান্দি ঘাটের কাঁঠালবাড়ী এলাকায় ছুটে আসেন। হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে পদ্মার তীরে। এ সময় স্বজনহারা মানুষের আহাজারিতে পুরো এলাকায় হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দুর্ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি করা হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নূরুর রহমানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি এবং সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার ও শিপ সার্ভেয়ার নাজমুল হককে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, প্রথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, লঞ্চটি পদ্মায় কোনো ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়েই দুর্ঘটনার শিকার হয়। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে এ কমিটি রিপোর্ট দিলেই দুর্ঘটনার মূল কারণ জানা যাবে। প্রসঙ্গত, গত ১৫ মে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে ঢাকা-শরীয়তপুর নৌ পথে মিরাজ-৪ নামের একটি লঞ্চ ডুবে যায়। এ ঘটনায় ৫৮ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। সর্বাত্মক তৎপরতার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর ডুবে যাওয়া লঞ্চ উদ্ধারে সর্বাত্মক তৎপরতা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেনা ও নৌবাহিনী এবং র্যাব, কোস্টগার্ড, ফায়ার ব্রিগেড ও বিআইডাব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ ব্যাপারে কোনো ধরনের অবহেলা না করে দ্রুত কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। উদ্ধারকাজের সার্বক্ষণিক খোঁজখবরও রাখছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল এ কথা জানিয়েছেন। নৌবাহিনীর তৎপরতা : নৌবাহিনী থেকে গত রাত সোয়া ৮টায় জানানো হয়, আধুনিক অনুসন্ধান যন্ত্র ‘সাইড স্ক্যান সোনার’-এর মাধ্যমে বিআইডাব্লিউটিএর সহযোগিতায় নৌবাহিনীর একটি দল অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে নৌবাহিনীর ১২ সদস্যের একটি ডুবুরিদল অনুসন্ধান শুরু করে। পরে আরো দুই সদস্য এ কাজে যোগ দেন। নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে এ অনুসন্ধানকাজ চলছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ থেকে ছয় সদস্যের একটি দল বোট নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। খুলনা থেকেও চার সদস্যের একটি সার্চ টিম উদ্ধার অভিযানে যোগ দিচ্ছে। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে।
Headlines from most popular newspapers of Bangladesh. বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রধান প্রধান দৈনিক পত্রিকার সংবাদ শিরোনামগুলো এক নজরে দেখে নিন।
Tuesday, August 5, 2014
লঞ্চ ডুবে ১২০ মৃত্যুর শঙ্কা:কালের কন্ঠ
দিকে। চোখে-মুখে বাঁচার তীব্র আকুতি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পদ্মার উত্তাল জলের নিচে তলিয়ে যায় লঞ্চ। গতকাল সোমবার মুন্সীগঞ্জের লৌহজং টার্নিং পয়েন্টে মাওয়া ঘাটের কাছে এভাবেই ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের লঞ্চটি। ঘড়িতে তখন সকাল ১১টা। মাদারীপুরের কাওড়াকান্দি থেকে মাওয়া যাচ্ছিল লঞ্চটি। রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দুজনের লাশ পাওয়া গেছে। জেলা প্রশাসনের দাবি, শতাধিক যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ আছে ১২০ জন। তবে লঞ্চে ঠিক কতজন যাত্রী ছিল তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। সাঁতরে তীরে ওঠা যাত্রীদের দাবি, লঞ্চে যাত্রী ছিল প্রায় ৩০০। গতকাল রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ডুবে যাওয়া লঞ্চটির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। আকাশপথে হেলিকপ্টার ও নদীতে বিভিন্ন ধরনের নৌযানের মাধ্যমে তল্লাশি চলছে। উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা দিয়ে রাত সোয়া ৯টায় ঘটনাস্থলে পৌঁছে। তাদের এত দেরির কারণে নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজন ও স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ। ঘটনার পর নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ কয়েকজন সংসদ সদস্য এবং বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। তবে উদ্ধারকাজে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও নদীর উত্তাল অবস্থাকে উদ্ধারকাজে প্রতিবন্ধকতার জন্য দায়ী করছে প্রশাসন। লঞ্চ উদ্ধারে সর্বাত্মক তৎপরতা চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, “দুর্ঘটনার পরপরই নারায়ণগঞ্জ থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম রওনা হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থলে ঘূর্ণিস্রোত থাকায় ছোট উদ্ধারকারী জাহাজ কুলিয়ে উঠতে পারবে না বলে বিকেলে নারায়ণগঞ্জ থেকে আধুনিক উদ্ধার জাহাজ ‘নির্ভীক’কে তলব করা হয়েছে। তবে স্রোত বেশি থাকায় রাতের বেলায় উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব নাও হতে পারে।” মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদল গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘এ পর্যন্ত দুজনের লাশ পাওয়া গেছে। নিখোঁজ ১২০ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে। শতাধিক যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা গেছে। আমরা সর্বাত্মক উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে লাশ দাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা ও বিআইডাব্লিউটিএ এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা অনুদানের ঘোষণা দিয়েছে। নিহত দুজনের মধ্যে একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তিনি হলেন শরীয়তপুরের কাঁঠালবাড়ীর নূরুল হকের মেয়ে হীরা আক্তার (২০)। অজ্ঞাতপরিচয় আরেক নারীর বয়স পঞ্চাশের মতো। তবে দুজনকেই জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল। পার্শ^বর্তী শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পর হীরার মৃত্যু হয়। আরেকজন মাওয়া লঞ্চঘাটেই মারা যান। তাঁর লাশ মাওয়া নৌপুলিশ ফাঁড়িতে রাখা হয়েছে। হীরার লাশ রাখা হয়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও ঘাট সূত্র জানায়, কাওড়াকান্দি থেকে সকাল সাড়ে ৯টায় ছেড়ে আসে পিনাক-৬। সকাল ১১টার দিকে মাওয়া ঘাটের কাছে লৌহজং টার্নিংয়ে পৌঁছলে ঢেউয়ের তোড়ে লঞ্চটি ডুবে যায়। উদ্ধার পাওয়া যাত্রী মাদারীপুরের দুরাই এলাকার আফজাল হোসেন জানান, নদীতে প্রচণ্ড ঢেউ ছিল। ঢেউয়ের আঘাতে লঞ্চটিতে জানালা দিয়ে পানি উঠছিল। পানি উঠতে উঠতে একসময় লঞ্চটি আধাডুবু হয়ে যায়। এ সময় যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যাত্রীরা এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করলে লঞ্চটি কাত হয়ে পেছনের দিক প্রথমে তলিয়ে যায়। দ্রুত পুরো লঞ্চ ডুবে যায়। তাঁর সঙ্গে তাঁর ভাই মিজান (১৪), বোন ইমা (১৮) ও আফরোজা ছিল। তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের কামরুল হাসান ও তাঁর স্ত্রী তাসলিমা ছিলেন ওই লঞ্চে। গতকাল সন্ধ্যায় মাওয়া লঞ্চঘাটে কামরুল বলেন, লঞ্চটি ছাড়ার সময় বারবার দুলছিল। যাত্রী ছিল বোঝাই। পথে কাঁঠালবাড়ী ঘাট থেকে আরো লোক তোলা হয়। সব মিলিয়ে ডুবে যাওয়ার সময় অন্তত আড়াই শ যাত্রী ছিল। কামরুল বলেন, ‘হঠাৎ করে লঞ্চের পেছন দিক ডুবতে শুরু করে। যাত্রীরা বাঁ দিকে ঝুঁকে পড়লে ওই দিকেই লঞ্চটি ডুবে যায়। আমার এক সিট পরই বসে ছিল আমার স্ত্রী। আমি জানালা দিয়ে কোনো রকম বের হতে পারলেও ও আর বের হয়ে আসতে পারেনি। এখন আমি আমার পাঁচ বছরের বাচ্চাকে কী জবাব দেব।’ ডুবে যাওয়া লঞ্চের পাশ দিয়ে এ সময় মাওয়ায় আসছিল প্রিন্স অব মেদিনী মণ্ডল নামের একটি লঞ্চ। ওই লঞ্চের যাত্রী রুবেল জানান, লঞ্চটি ঢেউয়ের তোড়ে চোখের সামনে ডুবে যায়। পুরো লঞ্চটিই পাঁচ-সাত মিনিটে ডুবে যায়। এ সময় যাত্রীরা যে যেভাবে পেরেছে পদ্মায় লাফিয়ে পড়েছে। রুবেল বলেন, যাত্রীরা যখন নদীতে লাফিয়ে পড়ছিল, তখন আশপাশ দিয়ে যাওয়া লঞ্চ, সিবোট ও ট্রলার তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে। মাওয়া ঘাট থেকেও সঙ্গে সঙ্গেই সিবোট ও লঞ্চগুলো যাত্রীদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে। কিন্তু পদ্মায় যে স্রোত তাতে উদ্ধারের আগেই স্রোতের টানে অনেক যাত্রী দূরে চলে গেছে। লঞ্চের ওপরে-নিচে এমনকি ছাদেও যাত্রী ছিল। গাজীপুরের পরিবহন ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলেসন্তানসহ ঈদ করতে গিয়েছিলেন বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গ্রামের বাড়িতে। গতকাল তাঁরা পাঁচজন কাওড়াকান্দি থেকে লঞ্চে চড়ে মাওয়া হয়ে গাজীপুরের উদ্দেশে রওনা করেছিলেন। মিজানুরের স্ত্রী ও দুই মেয়ে জীবিত উদ্ধার হলেও মিজানুর নিজে ও ছেলে ইমতিয়াজ (১০) নিখোঁজ রয়েছে। মাওয়া ঘাটে আহজারি করছিল মিজানুরের কলেজপড়ুয়া মেয়ে আরিফিন, ‘আমার বাবা আর ভাইটারে আইনা দেন। আমরা আর কিছু চাই না। আমার বাঁইচা গেলাম, বাবা-ভাইরে রাইখা আমরা কেমনে বাড়ি যামু।’ দুর্ঘটনার পরপরই মাওয়া ঘাট থেকে বেশ কয়েকটি সি-বোট, লঞ্চ ও ট্রলার দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে যাত্রীদের উদ্ধারে তৎপরতা চালায়। এরপর খবর পেয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) কর্মকর্তারা ছুটে আসেন। তাঁরাও নিজস্ব বিভিন্ন নৌযান নিয়ে উদ্ধারকাজে অংশ নেন। পাশাপাশি সেনা ও নৌবাহিনী, র্যাব, কোস্টগার্ড, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থা যোগ দেয় উদ্ধার তৎপরতায়। দুটি হেলিকপ্টার ডুবে যাওয়া লঞ্চটির অবস্থান ও নিখোঁজ যাত্রীদের সন্ধান চালায়। বিকেল থেকে বিআইডাব্লিউটিএর ‘তিস্তা’ নামের একটি জাহাজ সাইড স্ক্যান সোনার ও সোলার যন্ত্র ব্যবহার করে লঞ্চটির অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা চলাচ্ছিল। জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান জানান, স্থানীয়ভাবে দুঘর্টনাস্থলে আশপাশে ট্রলার ও স্পিডবোট নিয়ে যাত্রীদের খোঁজা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর কাজ করতে আসা মাওয়ায় অবস্থানরত সেনাসদস্যরাও উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করছেন। দুর্ঘটনার খবর বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে লঞ্চে থাকা যাত্রীদের স্বজনরা বিভিন্ন এলাকা থেকে মাওয়া ও কাওড়াকান্দি ঘাটের কাঁঠালবাড়ী এলাকায় ছুটে আসেন। হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে পদ্মার তীরে। এ সময় স্বজনহারা মানুষের আহাজারিতে পুরো এলাকায় হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দুর্ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি করা হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নূরুর রহমানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি এবং সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার ও শিপ সার্ভেয়ার নাজমুল হককে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, প্রথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, লঞ্চটি পদ্মায় কোনো ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়েই দুর্ঘটনার শিকার হয়। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে এ কমিটি রিপোর্ট দিলেই দুর্ঘটনার মূল কারণ জানা যাবে। প্রসঙ্গত, গত ১৫ মে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে ঢাকা-শরীয়তপুর নৌ পথে মিরাজ-৪ নামের একটি লঞ্চ ডুবে যায়। এ ঘটনায় ৫৮ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। সর্বাত্মক তৎপরতার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর ডুবে যাওয়া লঞ্চ উদ্ধারে সর্বাত্মক তৎপরতা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেনা ও নৌবাহিনী এবং র্যাব, কোস্টগার্ড, ফায়ার ব্রিগেড ও বিআইডাব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ ব্যাপারে কোনো ধরনের অবহেলা না করে দ্রুত কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। উদ্ধারকাজের সার্বক্ষণিক খোঁজখবরও রাখছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল এ কথা জানিয়েছেন। নৌবাহিনীর তৎপরতা : নৌবাহিনী থেকে গত রাত সোয়া ৮টায় জানানো হয়, আধুনিক অনুসন্ধান যন্ত্র ‘সাইড স্ক্যান সোনার’-এর মাধ্যমে বিআইডাব্লিউটিএর সহযোগিতায় নৌবাহিনীর একটি দল অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে নৌবাহিনীর ১২ সদস্যের একটি ডুবুরিদল অনুসন্ধান শুরু করে। পরে আরো দুই সদস্য এ কাজে যোগ দেন। নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে এ অনুসন্ধানকাজ চলছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ থেকে ছয় সদস্যের একটি দল বোট নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। খুলনা থেকেও চার সদস্যের একটি সার্চ টিম উদ্ধার অভিযানে যোগ দিচ্ছে। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment