ঢাকার পাশে সাভার ও কেরানীগঞ্জে ২৪, টাঙ্গাইলে ৫৯, মানিকগঞ্জে ২৭, নারায়ণগঞ্জে ৩৯, নরসিংদীতে ৫১, মুন্সিগঞ্জে ১০ ও ময়মনসিংহে ৮৯ জনকে ওএসডি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে সরকারের অনুমোদিত পদের চেয়ে অতিরিক্তি প্রায় দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগ করার কারণে এখন রেকর্ডসংখ্যক চিকিৎসককে কর্মজীবন শুরু করতে হচ্ছে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি হিসেবে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তের কারণে এখন
এক হাজার ৬৪৭ জন চিকিৎসককে বসিয়ে রেখে বছরে ৩৫ কোটি টাকারও বেশি বেতন গুনতে হবে সরকারকে। ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটছে। উপরন্তু পদায়নে প্রতিশ্রুত নীতিমালাও মানেনি সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ছুটি, প্রেষণ, উচ্চশিক্ষাজনিত ছুটির কারণে ক্যাডার সার্ভিসে কর্মকর্তাদের ওএসডি করা হয়। কখনো কখনো এ পদ শাস্তিমূলক। তবে সরকার চাইলে মোট কর্মকর্তার ১০ শতাংশ পর্যন্ত ওএসডি রাখতে পারে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেন এবং কীভাবে পদের অতিরিক্ত প্রায় দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিল, সে সম্পর্কে কেউ কিছু বলছে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দোষ চাপাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওপর। আর অধিদপ্তর দুষছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে। তবে কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ওএসডি হিসেবে এত এত নিয়োগ দিয়ে ‘স্বাস্থ্য সার্ভিসে কর্মরত কর্মকর্তাদের বদলি/পদায়ন নীতিমালা, ২০০৮’ ভেঙেছে সরকার নিজেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বাংলাদেশে চিকিৎসা কর্মকর্তা বা সহকারী সার্জনের চার হাজার পদ শূন্য ছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে ছয় হাজারের বেশি চিকিৎসকের চাহিদা দিয়ে পাঠিয়েছিল। এখন আর শূন্য পদ খুঁজে পাচ্ছে না। পদায়ন নিয়ে সমালোচনার মধ্যেই আবার নতুন করে আগে অ্যাডহক চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন, এবার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন এমন ২৪০ কর্মকর্তাকে ২৫ আগস্ট ওএসডি করা হয়েছে। এবারই প্রথম চিকিৎসা কর্মকর্তা বা সহকারী সার্জনদের পদায়নের কাজটি করেছে মন্ত্রণালয়। সরকারের শীর্ষ একটি সূত্র বলছে, মন্ত্রণালয় যুক্তি দিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার প্রতিফলন হচ্ছে কি না, মন্ত্রী সেটি নজরদারি করতে পারবেন, যদি পুরো প্রক্রিয়াটি মন্ত্রণালয়ে হয়। ওই সূত্রটি এ-ও বলেছে, ঢাকার ভেতরে ওএসডি হিসেবে কী করে পদায়ন হলো, তা তারা কেউই বুঝতে পারছে না। তাদের আশঙ্কা, মন্ত্রণালয় যেহেতু এবার এককভাবে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মন্ত্রণালয়েরই ঊর্ধ্বতন এক বা একাধিক কর্মকর্তা এ ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকতে পারেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে একাধিকবার জোরালোভাবে বলেছেন, গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্যই চিকিৎসকদের নিয়োগ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় পদায়নের কাজ করেছে। সেখানে এমন অসংগতি খুবই হতাশাব্যঞ্জক। স্বার্থানেষী যে মহলটি শুভ উদ্যোগ নষ্ট করার কাজ করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা দরকার। এখনই খতিয়ে দেখা দরকার ঢাকা ও এর আশপাশের জেলা ও বড় শহরগুলোয় পদায়ন করার কাজটি কে করেছে। জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসচিব এম নিয়াজউদ্দীন ২৪ আগস্ট রাতে বলেন, ‘পদের চেয়ে বেশি চিকিৎসক, সে কারণে ওএসডি করতে হয়েছে। কিন্তু তাঁদের আমরা বিভিন্ন উপজেলায় যোগদানের নির্দেশ দিয়েছি।’ আবার ২৫ আগস্ট সকালে তিনি এই প্রতিবেদককে মুঠোফোনে বলেন, ‘কত চিকিৎসক প্রয়োজন, তার হিসাব করেছে অধিদপ্তর। তবে পদের চেয়ে বেশি হয়নি।’ আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. ইহতেশামুল হক বলেছেন, ‘কাকে কোথায় কীভাবে পদায়ন করা হবে, এ বিষয়ে অধিদপ্তর কিছু জানে না। এবার সবকিছু করেছে মন্ত্রণালয় |’ তবে যা-ই হোক না কেন, এ ঘটনাকে ‘নজিরবিহীন’, ‘অরাজক’ বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক জনপ্রশাসনসচিব আলী ইমাম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা নজিরবিহীন। পদোন্নতির ক্ষেত্রে শূন্য পদ না থাকলে কখনো কখনো কাউকে কাউকে ওএসডি পদে থাকতে হয়। কিন্তু ওএসডি হিসেবে হাজারো ডাক্তারের নিয়োগ একটা অদ্ভুত ঘটনা।’ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব এম ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘এই পদায়নের কারণে সরকার বিব্রত। চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট সবাই বিব্রত।’ কেমন হলো পদায়ন: ৭ আগস্ট স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে ছয় হাজার ২২১ জন চিকিৎসকের হাতে যোগদানপত্র তুলে দেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের শিকড় গ্রামে পোঁতা। আমরা চাই, তোমরা মায়ের কোলে, বাবার স্নেহে পিতৃপুরুষের ভিটায় থেকে মানুষকে সেবা দাও। কাউকে শহরে রাখা হবে না।’ কিন্তু পদায়নের যে তালিকা গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দেখা গেছে যে খোদ রাজধানীর ভেতরে, ঢাকা জেলার সাভার ও কেরানীগঞ্জ এবং এর আশপাশের জেলায় চিকিৎসকদের ওএসডি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। কোথাও কোথাও আবার লুকোচুরির আশ্রয় নিয়েছে মন্ত্রণালয়। রাজধানীর ভেতরে তেজগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পদায়ন করেও ওয়েবসাইটে তার উল্লেখ করেনি। এর আগে গত ২৭ জুলাই স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য সার্ভিসে কর্মরত কর্মকর্তাদের বদলি/পদায়ন নীতিমালা, ২০০৮-এর নবনিয়োগপ্রাপ্ত চিবিৎসকদের পদায়ন-সম্পর্কিত অংশটি সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই সংশোধিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, নতুন নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকদের উপজেলা বা এর নিচের পর্যায়ের শূন্য পদে পদায়ন করা হবে। চিকিৎসকদের মেধা অনুসারে তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক স্থানে পদায়ন করার বিষয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিচেনা করা হবে। পদায়নের ক্ষেত্রে মেধাক্রম অনুসরণ না করার ভূরি ভূরি উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় তালিকাগুলো যাচাই-বাছাই করলে। মুখে গ্রামের কথা বললেও, মেধাতালিকায় ৫৪১৯ এম এম নাসিরউদ্দিনকে ওএসডি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হাসপাতালে। ওই একই হাসপাতালে ওএসডি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে মেধাক্রমে ৩০৫৮ ও ৩২০৭ থাকা দুজন চিকিৎসককে। ঢাকার ভেতরে তেজগাঁও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের পদায়নের খবর নিশ্চিত করেছেন কমপ্লেক্সের কর্মকর্তারা। ঢাকার কাছে সাভার ও কেরানীগঞ্জে ওএসডি হিসেবে পদায়ন পেয়েছেন ২৪ জন চিকিৎসক। ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ২৭ জন, নারায়ণগঞ্জে ৩৯ জন, নরসিংদীতে ৫১ জন, মুন্সিগঞ্জে ১০ জন, টাঙ্গাইলে ৫৯ জন ও ময়মনসিংহে ৮৯ জনকে ওএসডি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। ময়মনসিংহের জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এম এ হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর জেলায় ৫৭টি পদ ফাঁকা ছিল। তিনি জানতে পেরেছেন যে শূন্য পদের বিপরীতে চিকিৎসক দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে ৮৯ জন অতিরিক্ত চিকিৎসক পাঠালে কোথায় রাখবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এক রুমে তিন-চারজন বসাব। ম্যানেজ তো করতে হবে।’ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি সরকার: প্রত্যেককে নিজ জেলার উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে পদায়ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কথা রাখেনি সরকার। একজন নারী চিকিৎসকের স্বজন জানান, তাঁদের বাড়ি কুমিল্লায়। মেধাক্রমে তাঁর বোনের চেয়ে তিন হাজার জন পিছিয়ে থাকা একজন পুরুষ চিকিৎসককে কুমিল্লা সদরে পদায়ন করা হযেছে। আর তাঁর বোনকে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভর উপজেলার বাদাঘাটি ইউনিয়নে পাঠানো হয়েছে। সংক্ষুব্ধ চিকিৎসকেরা এরই মধ্যে ফেসবুকে একটি পেইজ খুলেছেন। এতে প্রায় ১০০ চিকিৎসক তাঁদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। ময়মনসিংহে বাড়ি এমন চিকিৎসককে ভোলার চরফ্যাশনে, স্বামী-স্ত্রীকে আলাদা জেলায় দেওয়ার উদাহরণ আছে।
No comments:
Post a Comment