ঢাকাকে পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রণীত ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সরকারই মানছে না। ড্যাপ অনুযায়ী, বন্যাপ্রবাহ এলাকা, জলাশয় ও কৃষিজমিতে আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া নিষিদ্ধ হলেও এখন তা দেওয়া হচ্ছে। গত সোমবার এক দিনেই এ ধরনের নিষিদ্ধ এলাকায় ৪৭টি প্রকল্প বা প্লটের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ নিয়ে মোট ৮৬টি প্রকল্পের অনুমোদন দিল ড্যাপ পর্যালোচনার জন্য গঠিত
মন্ত্রিসভা কমিটি। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান ড্যাপ আইনগতভাবে পরিবর্তন না করে, এই ড্যাপের সুপারিশ লঙ্ঘন করে প্রকল্প অনুমোদন করা দুঃখজনক। তিনি ড্যাপ চূড়ান্তকরণের সুপারিশ প্রণয়নের জন্য সরকারের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং মাঠপর্যায়ে সরাসরি ড্যাপ বাস্তবায়নকারী সংস্থা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ড্যাপে যা-ই থাকুক, ভূমি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আগের মতোই চলবে। বর্তমানে যেভাবে আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, সেই আলোকেই ড্যাপ পর্যালোচনা ও পরিবর্তন করা হবে। বিশিষ্ট নগরবিদ, সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের কর্ণধার অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ড্যাপের সুপারিশের বাইরে এভাবে প্রকল্প অনুমোদনের সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাবের মুখোমুখি হতে হবে মহানগর ঢাকাকে। তিনি বলেন, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রীর মতে, ড্যাপ অনেক ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ড্যাপ তো সরকারই করেছে। সরকারের পরিকল্পনা যদি সরকারের জন্য ঝামেলার হয়, তাহলে তো বলার কিছু থাকে না। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ৮৬টি আবেদন আমলে নিয়ে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে ড্যাপ পর্যালোচনায় গঠিত মন্ত্রিসভা কমিটি। এমন আবেদন রয়েছে সহস্রাধিক। কমিটির পাঁচটি সভা হওয়ার পর ড্যাপের বিদ্যমান অবস্থা পর্যালোচনা করতে আবার তিনটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গত সোমবার কমিটির পঞ্চম সভায় এই তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ড্যাপ এলাকা ভাগ করে পর্যালোচনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ড্যাপ কার্যকর থাকা অবস্থায় এটি পর্যালোচনার সুযোগ নেই। ড্যাপে যে পর্যালোচনা কমিটির সুযোগ রাখা ছিল, তা ছোটখাটো ত্রুটি দেখভালের জন্য। এভাবে বন্যাপ্রবাহ এলাকা, জলাশয় বা নিচু এলাকার জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কমিটি করা হয়নি। তা ছাড়া, সরকারি প্রজ্ঞাপন কার্যকর থাকা অবস্থায় এভাবে শ্রেণি পরিবর্তনের সুযোগ নেই। তিনটি গ্রুপে ড্যাপ এলাকার বিদ্যমান অবস্থা পর্যালোচনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) ও দ্য সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্র্যাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিদ্যমান ড্যাপ অকার্যকর করার পাশাপাশি নতুন ড্যাপ প্রণয়নের লক্ষ্যে নতুন কাঠামো পরিকল্পনা (স্ট্রাকচারাল প্ল্যান) প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়েছে। এই পরিকল্পনা হচ্ছে ড্যাপের ভিত্তি। বর্তমান ড্যাপের মেয়াদ ২০১৫ সাল পর্যন্ত। এরপর নতুন ড্যাপ কার্যকর হবে। সেই ড্যাপ তৈরির জন্য যে কাঠামো পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তাতে ভূমিদস্যুদের স্বার্থে বর্তমান ড্যাপের অনেক মৌলিক বিষয় বদলে দেওয়া হবে। এ কারণে সরকার এখন পর্যন্ত ড্যাপের কোনো মৌলিক বিষয় বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়নি। ড্যাপ অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি যেসব স্থাপনা সরিয়ে নিতে ও যে প্রকল্পগুলো প্রত্যাহার করার কথা ছিল, তার একটিও সরিয়ে নেওয়া বা প্রত্যাহার করা হয়নি। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ড্যাপ পর্যালোচনায় গঠিত মন্ত্রিসভা কমিটির পাঁচটি সভার মধ্যে প্রথম দুটি অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সভাপতিত্বে। ওই দুই সভায় গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তৃতীয় সভা থেকে সভাপতির দায়িত্ব পান মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন। তাঁর সভাপতিত্বে ১৮ মার্চ প্রথম সভাতেই ড্যাপ সংশোধন করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর পর থেকে বড় কয়েকটি ভূমি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানকে কৌশলে, ড্যাপের শর্ত শিথিল করে বা শর্ত মানবে, এমন অঙ্গীকারের ভিত্তিতে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইস্টওয়েস্ট প্রপার্টি লিমিটেডের (বসুন্ধরা গ্রুপ) তিনটি প্রকল্প, ইস্টার্ন হাউজিংয়ের তিনটি প্রকল্প, বিডিজির দুটি প্রকল্প, ঢাকার খিলক্ষেত পুলিশ অফিসার্স হাউজিং, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সেনা কর্মকর্তাদের জলসিঁড়ি প্রকল্প, গাজীপুরের টঙ্গীতে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৪০০ কর্মকর্তার প্রত্যাশা প্রকল্প ইত্যাদি। কেরানীগঞ্জ থানায় অবস্থিত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির একটি প্রকল্প শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ-সংক্রান্ত আলোচনায় বলা হয়, সেখানে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের একটি প্রকল্প আগেই অনুমোদন পেয়েছে। তাই একই এলাকায় অন্য প্রকল্প আটকে রাখার যুক্তি নেই। বন্যাপ্রবাহ এলাকা ও জলাশয় ভরাট করে আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন কতটা যৌক্তিক, জানতে চাইলে গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, পানি ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকলে কেন বাড়ি করা যাবে না? বিশ্বের অনেক দেশে সমুদ্র ভরাট করেও বাড়িঘর হয়। ড্যাপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা ঢাকা শহরের এমন কোনো উপকারে এসেছে বলে মনে হয় না। তাই মন্ত্রিসভা কমিটি ড্যাপের বিদ্যমান অবস্থা পর্যালোচনা করে দুই মাসের মধ্যে সমন্বিত প্রতিবেদন দেবে। তার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমুদ্র ভরাট করা আর একটা নগরের মধ্যকার খাল, জলাশয় ও বন্যাপ্রবাহ এলাকা বিলীন করে দেওয়ার পার্থক্য কী, এর প্রতিক্রিয়াই বা কী, তা মন্ত্রী বোঝেন না। মন্ত্রীর কথা শুনে মনে হচ্ছে, তিনি ঢাকাকে ধ্বংস করার মিশন নিয়ে নেমেছেন। যে ড্যাপ বাস্তবায়িত হয়নি, সে ড্যাপ কীভাবে উপকারে আসবে!’ ড্যাপ পর্যালোচনার নামে কার্যত তা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে নয়টি পরিবেশবাদী ও উন্নয়ন সংগঠন গত ২৩ জুন স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি দেয়। ড্যাপ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও ড্যাপ লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানায় তারা। এই সংগঠনগুলো হচ্ছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, এএলআরডি, বেলা, বাপা, ব্লাস্ট, পবা, সিএসইউ, নিজেরা করি ও টিআইবি। সরকার এদের বক্তব্য বিবেচনায় নেয়নি। এ রকম দুটি সংগঠনের কয়েকজন প্রতিনিধি প্রথম আলোকে বলেন, ড্যাপ অনুমোদন করে সরকার যে গেজেট প্রকাশ করেছে, তা এখনো বহাল আছে। তা বাতিল করে নতুন গেজেট প্রকাশ করা ছাড়া ড্যাপ পর্যালোচনার নামে সংশোধন করে সরকার আইন ভঙ্গ করেছে। তাঁরা এর প্রতিবাদে রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
No comments:
Post a Comment