Tuesday, March 24, 2015

ঢাকা ছাড়ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ:যুগান্তর

টানা অবরোধ ও হরতালের প্রভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় ভাসমান শ্রমিকদের কাজের সংস্থান কমে গেছে। ফলে ঢাকায় অবস্থান করা অনেক ভাসমান শ্রমিক যেমন কাজ পাচ্ছেন না, তেমনি ঢাকার বাইরে থেকে এসেও অনেকে কাজ পাচ্ছেন না। ফলে কাজ না পেয়ে অনেক শ্রমিক ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এসব কারণে বাইরে থেকেও কাজের সন্ধানে শ্রমিকরা ঢাকায় আসছেন কম। এর প্রভাবে স্বল্পআয়ের মানুষ বসবাস করে এমন সব এলাকার বাসাভাড়া কমে গেছে।
কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় স্বল্পআয়ের মানুষের কষ্ট যেমন বেড়েছে, তেমনি কমে গেছে তাদের জীবনযাত্রার মান। রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, মিরপুর পল্লবীর গার্মেন্ট অঞ্চল, প্রেস ক্লাব, মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকায় অনুসন্ধান করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, প্রায় আড়াই মাস ধরে দেশে চলা টানা অবরোধ ও হরতালের কারণে মানুষের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। কোনো অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়তে পারে না। বরং তা কমে যায়। যেমনটি হয়েছে গত আড়াই মাসে। ওই সময়ে সরকারি কর্মকাণ্ড যেমন স্থবির হয়েছে তেমনি বেসরকারি খাতের উন্নয়ন কাজের গতিও কমেছে। এতে বাজারে টাকার হাতবদল কমেছে। ফলে মানুষের কাজের সংস্থান কমে যাচ্ছে। আর কাজের সংস্থান না হলে মানুষ ঢাকায় থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। মুদ্রা সরবরাহ কমেছে : বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে টাকার প্রবাহে। গত ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমেছে ৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ ছিল ৭ লাখ ৪১ হাজার ২৪৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা। গত জানুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৩৮ হাজার ৫২৬ কোটি ৫০ লাখ টাকায়। ওই এক মাসের ব্যবধানে বাজারে টাকার প্রবাহ কমেছে ২ হাজার ৭২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহও। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে যাওয়ার কারণেই বাজারে ঋণের চাহিদা কমে গেছে। ফলে মানুষের কর্মসংস্থানও কমছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে টাকার হাতবদলও কমে গেছে। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশের শ্রমিকদের বড় একটি অংশই নিম্ন আয়ের। অর্থনীতিতে স্থবিরতা এলে তারাই সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই সময়ে তাদের আয় যেমন কমে, তেমনি কমে কর্মসংস্থান। ফলে তাদের বেঁচে থাকার জন্য জরুরি ভিত্তিতে দরকার হয় বিকল্প কর্মসংস্থানের। কিন্তু বর্তমানে আমরা এমন কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। তিনি আরও বলেন, গত দুই বছর থেকেই রাজনৈতিক কারণে বিনিয়োগে স্থবিরতা চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে টানা অবরোধ ও হরতালে আরও নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা আরও পিছু হটেছেন। বিনিয়োগ না হওয়ায় ঋণপ্রবাহ বাড়ছে না। এতে আর্থিক খাতের অবস্থাও খারাপ হচ্ছে। শ্রমবাজারে নতুন শ্রমশক্তি আসছে, কিন্তু কাজের ক্ষেত্র বাড়ছে না। তিনি রাজনীতিবিদদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের অর্থনীতির যে ক্ষতি হচ্ছে, তাতে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে বাধ্য হবে এবং এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। আপাতত বিষয়টি অতটা অনুধাবন করা যাচ্ছে না। কিন্তু যখন অনুধাবন করা যাবে, তখন অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। গার্মেন্ট বন্ধ : কাজ না থাকায় সাব কনট্রাক্টের ভিত্তিতে কাজ করে এমন ৫ শতাধিক গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এসব কারখানা সরাসরি বিদেশী ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার নিতে পারে না। ফলে বড় গার্মেন্টগুলো ক্রেতাদের কাছ থেকে যে রফতানির আদেশ পায়, তা থেকে সাব কনট্রাক্টের ভিত্তিতে তারা কাজ করে। রাজনৈতিক অস্থিরতার পর থেকে বিদেশী ক্রেতাদের রফতানির আদেশ দেয়ার পরিমাণ কমে যাওয়ায় তাদের কাজও কমে গেছে। ফলে বাধ্য হয়ে তারা কারখানাগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে ওই সব কারখানার হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। এ বিষয়ে মদিনা সোয়েটার্সের জিএম কবির উদ্দিন আহমেদ বলেন, সাধারণত সাব কনট্রাক্টের কারখানাগুলোতে জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু হয়। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে জানুয়ারি থেকেই রফতানির আদেশ কমতে থাকে। ফলে বড় কারখানাগুলো ছোট কারখানাগুলোকে কাজ দিতে পারছে না। গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, বিভিন্ন কারণে এ পর্যন্ত তাদের ২৮০টি গার্মেন্ট বন্ধ হয়েছে। এসব গার্মেন্টের শ্রমিকরা বেকার। তিনি বলেন, বড় গার্মেন্টেই কাজ নেই। সেখানে সাব কনট্রাক্টের কারখানা কীভাবে কাজ করবে। দেশের অর্থনীতির বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, অর্থনীতি গতিশীল হলে বাজারে কাজের ক্ষেত্র বাড়ে। তখন ভাসমান শ্রমিকরা বাছাই করে কাজ করতে পারে। কিন্তু অর্থনীতি গতিশীল না হলে কাজের ক্ষেত্রও বাড়ে না। বিশেষ করে ভাসমান শ্রমিকদের কাজের পরিমাণও কমে যায়। তিনি বলেন, এ অবস্থা বেশি দিন চললে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান আরও কমে যাবে। তখন দেশে দারিদ্র্যের হার যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে অতি দরিদ্রের হার। এতে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক অর্জনগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। ঢাকা ছাড়ছে স্বল্পআয়ের মানুষ : ঢাকায় ভাসমান শ্রমিকদের একটি বড় অংশ কাজ করছে নির্মাণ খাতে। আরও একটি অংশ কাজ করছে ঘাট শ্রমিক হিসেবে। দুই খাতেই এখন কাজের বাজার মন্দা। অর্থনৈতিক মন্দায় বিক্রি কমে যাওয়ায় অবিক্রীত ফ্ল্যাটের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। রিহ্যাবের হিসাবে এখন পর্যন্ত অবিক্রীত ফ্ল্যাটের সংখ্যা প্রায় এক হাজার। রিহ্যাবের নিবন্ধন নেই এমন সব কোম্পানি মিলে এর সংখ্যা আরও বেশি হবে। ফলে নির্মিত ফ্ল্যাট বিক্রি করতে না পেরে তারা এখন নতুন প্রকল্পে হাত দিচ্ছেন না। কমলাপুর রেলস্টেশনে কথা হয় ভাসমান নির্মাণ শ্রমিক হাশেম আলীর সঙ্গে। তিনি নরসিংদী থেকে সপ্তাহে ৬ দিনই সকালের ট্রেনে ঢাকায় কাজ সেরে আবার রাতের ট্রেনে বাড়ি চলে যান। প্রেস ক্লাবের সামনে কোদাল নিয়ে বসে থাকেন। এখান থেকেই এসে মালিকপক্ষ দরদাম করে নিয়ে যায়। তবে গত কয়েক দিন কাজ না পাওয়ায় খালি হাতেই বাড়ি ফিরতে হয়েছে। এভাবে প্রতিদিন শত শত নিম্ন আয়ের শ্রমিক কাজ না পেয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। নারায়ণগঞ্জ ও পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে পাইকারি ব্যবসায়ীদের আড়তগুলোতে শ্রমিকদের কাজ কমে গেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় পণ্যের সরবরাহ কমে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে। ফলে ঘাটগুলো থেকে শ্রমিকরা চলে যাচ্ছে গ্রামে। নারায়ণগঞ্জে ঘাট শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন শরাফত। বাড়ি জামালপুরে। কয়েকদিন তার সঙ্গে কথা হয় কমলাপুর রেলস্টেশনে। তিনি জানান, নারায়ণগঞ্জে সিমেন্টের ঘাটে তিনি কাজ করতেন। এখন সিমেন্টের জাহাজ কম আসায় কাজ কম। এ কারণে তিনি গ্রামে চলে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে আরও ৭ জন শ্রমিককে চলে যেতে দেখা গেছে। তারাও একই ধরনের কথা বলেন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের সবচেয়ে সহজ মাধ্যম লঞ্চ। প্রতিদিন বরিশাল অঞ্চলে ২০টির বেশি লঞ্চ ছেড়ে যায় সদরঘাট থেকে। এ ছাড়া চাঁদপুর ও শরীয়তপুরে বেশ কিছু লঞ্চ ছেড়ে যায়। এসব লঞ্চে প্রতিদিন লক্ষাধিক যাত্রী আসা-যাওয়া করেন। লঞ্চ মালিকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে আসার চেয়ে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার সময় লঞ্চে বেশি ভিড় দেখা যাচ্ছে। এদের বেশিরভাগই গার্মেন্ট কর্মী। সোমবার দুপুরে পারাবত লঞ্চের ফ্লোরে আগেই জায়গা নিয়েছেন বরিশালের মুলাদীর আবু তালেব। পেশায় তিনি একজন গার্মেন্ট কর্মী। সোনালী অ্যাপারেলস নামে একটি কারখানায় কাজ করেন তিনি। তিনি জানান, ফেব্রুয়ারি থেকেই তাদের কোনো কাজ ছিল না। মার্চ থেকে তাদের কারখানা লে-অফ করে দেয়া হয়। তবে ফেব্রুয়ারির বেতন না দিয়ে শুধু ৪ হাজার টাকা করে অগ্রিম দেয়া হয়েছে। মালিক বরিশালের হওয়ায় তাদের এক গ্রাম থেকেই ৪০ জনের বেশি কাজ করতেন সেখানে। আর সবারই একই অবস্থা। বাসাভাড়া কমছে : ভাসমান শ্রমিকদের একটি অংশ চলে যাওয়ায় ঢাকার কিছু এলাকার বাসাভাড়া কমে গেছে। বিশেষ করে স্বল্পআয়ের লোকদের বাসাভাড়াই কিছুটা কমেছে। অন্যত্র এখনও এর প্রভাব পড়েনি। মিরপুর ১২ নম্বরের সি ব্লকের ৪১ নম্বর বাসায় ভাড়া থাকতেন গার্মেন্ট কর্মকর্তা ইকবাল। দুই রুমের বাসা প্রতিমাসে ভাড়া দিতেন ১২ হাজার টাকা। গত একবছর ধরে এই পরিমাণ ভাড়া দিতেন তিনি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাসাভাড়া বাড়ানো হয়নি। উল্টো বাসা ছেড়ে দিতে চাইলে বাড়ির মালিক মার্চ থেকে ভাড়া ১ হাজার টাকা কমিয়ে দেন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গার্মেন্ট পল্লী হিসেবে খ্যাত রাজধানীর মিরপুর-পল্লবীর অধিকাংশ আবাসিক বাড়িতে বাসাবাড়া দেয়ার নোটিশ টানানো হয়েছে।  

No comments:

Post a Comment