ডুবে থাকা লঞ্চটির কোনো খোঁজই নেই। তবুও মাওয়া ঘাটে দিনভর হাজারো মানুষ উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছেন পদ্মার দিকে। তাঁরা কখনো কাঁদছেন, কখনো বিলাপ করছেন, আবার কখনো ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মার ২০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা তাঁরা চষে ফেলেছেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। প্রায় ৩০০ যাত্রী নিয়ে ডুবে যাওয়া এমএল পিনাক-৬ লঞ্চটির কোনো খোঁজই মেলেনি গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত। ‘লাশ চাই’ স্লো
গান নিয়ে কাল মাওয়া ঘাটে বিক্ষোভ করেছেন নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজনেরা। মাদারীপুরের কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ঘাটে আসার পথে গত সোমবার বেলা ১১টার দিকে ডুবে যায় লঞ্চটি। ঈদের ছুটি কাটিয়ে ঢাকামুখী মানুষের চাপে লঞ্চটিতে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করা হয়েছিল। মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, গতকাল পর্যন্ত মাত্র তিনটি লাশ উদ্ধার হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে সোমবার দুটি ও গতকাল সকালে চাঁদপুরের হাইমচর থেকে একটি লাশ উদ্ধার হয়। আর মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন গতকাল পর্যন্ত ১৩২ জন নিখোঁজের তালিকা করেছে। স্বজনেরা এখন আর কারও জীবিত ফেরার আশা করছেন না। লাশ চাই স্লোগান নিয়ে কাল সকালে মাওয়া ঘাটের পথ আটকে বিক্ষোভ করেছেন তাঁরা। কথা বলতে গেলেই তাঁরা নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন, ক্ষোভ দেখিয়েছেন কেউ কেউ। ক্ষোভের বশে তাঁরা চড়াও হয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীদের ওপরও। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), নৌবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস লঞ্চটির খোঁজে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে। খোঁজ পেলে শুরু হবে উদ্ধারকাজ। এ জন্য মাওয়া ঘাটের পূর্ব পাশে উদ্ধার জাহাজ রুস্তম ও নির্ভীক নোঙর করে অপেক্ষায় আছে। লাশ উদ্ধারের অপেক্ষায় বসে রয়েছেন নৌবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা। লাশ উদ্ধার হলে মাদারীপুরের পাঁচ্চড় সরকরি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে নিয়ে রাখা হবে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তল্লাশি অভিযান: লঞ্চটির খোঁজে নৌবাহিনীর দুটি দল, বিআইডব্লিউটিএর একটি ও ফায়ার সার্ভিসের দুটি দল তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে। নৌবাহিনী ও বিআইডব্লিউটিএ তল্লাশির জন্য তিনটি সাইড স্ক্যানার সোনার (সাউন্ড নেভিগেশন অ্যান্ড রেঞ্জিং) ব্যবহার করছে। সোনার বিশেষ কম্পাঙ্কের শব্দ তরঙ্গ নদীর তলদেশে পাঠায়, এরপর ফেরত আসা প্রতিধ্বনির মাধ্যমে তলদেশে থাকা বস্তু শনাক্ত করে (অনেকটা চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত আলট্রাসনোগ্রামের মতো)। এই সোনারগুলো কেব্লের মাধ্যমে নদীতে ফেলে ধীরে ধীরে জাহাজ চালানো হয়। সোনারগুলো দুই পাশে ২০০ মিটার পর্যন্ত এলাকার বস্তু শনাক্ত করতে পারে। উদ্ধার অভিযানের সমন্বয়কারী নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলাম বলেন, সোমবার রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিএ সোনার দিয়ে নদীর তলদেশে তল্লাশি চালিয়েছে। গতকাল সকাল সাতটা থেকে নৌবাহিনীর দুটি দল দুটি সোনার নিয়ে তল্লাশি শুরু করেছে। তিনি বলেন, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ফেরি কেতকির চালক (মাস্টার) হাসান ইমামের দেখানো মতে একটি ঘটনাস্থল চিহ্নিত করে তার দুই কিলোমিটার উজান আর পাঁচ কিলোমিটার ভাটির দিকে তল্লাশি চালানো হয়েছে। কিন্তু কিছুই মেলেনি। এভাবে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর দেখানো মতে ১৫টির মতো স্পট শনাক্ত করে এগুলোর আগে-পিছে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান শামসুদ্দোহা খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতকাল চাঁদপুরের হাইমচরে একটি লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ থেকে আমাদের ধারণা হয়েছে, প্রচণ্ড স্রোতে ডুবে যাওয়া লঞ্চটি ভাটির দিকে সরে গেছে। এ জন্য তল্লাশি এলাকা বাড়ানো হয়েছে। এখন পদ্মার ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে তল্লাশি চালানো হয়েছে।’ রাত নয়টা থেকে সমন্বিত অভিযান শুরু করার কথা জানান তিনি। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সাংবাদিকদের বলেন, সোনার দিয়ে নদীর তলদেশে খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু লঞ্চটি পাওয়া যাচ্ছে না। লঞ্চটি পলি দিয়ে ঢেকে যেতে পারে। এ অবস্থায় অনুসন্ধানের জন্য চট্টগ্রাম থেকে জরিপ-১১ নামের একটি জরিপ জাহাজ মাওয়ার দিকে রওনা দিয়েছে। এটি মাটির কয়েক ফুট গভীর পর্যন্ত তল্লাশি চালাতে সক্ষম। স্বজনদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ: মাওয়া ঘাটে কথা হয় জাহিদ মাতবরের সঙ্গে। জাহিদের ভাইবোনসহ পরিবারের সাতজন নিখোঁজ। লঞ্চডুবির পর থেকে তাঁর পরিবারের কয়েকজন মাওয়া ঘাটে অবস্থান করছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তাঁর স্বজনেরা ফরিদপুরে সদরপুরের সাতরশি থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন। ডুবে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরও লঞ্চ উদ্ধার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন জাহিদ। তিনি বলেন, অন্তত লাশটা তো দেবে! মাদারীপুরের অলি শেখের খোঁজে এসেছেন বাবা শেখ সাফি ও বোন খাদিজা। কথা বলতে গেলে, ‘প্রশাসনের লোক’ ভেবে শেখ সাফি এই প্রতিবেদকের হাত ধরে কেঁদে ফেলেন। বলতে থাকেন, ‘বাবা আমরা ট্যাহা চাই না। আমার পোলাডার লাশ আইন্না দেন। ওর তিনডা পোলাপাইন। লাশ না পাইলে আমি বাইত্যে গিয়া কী কমু ওগো। নদীতে অনেক স্রোত। নৌকা নিয়া যাওয়া যায় না। এহন আমরা কই গিয়া লাশ খুঁজমু।’ ভাইয়ের খোঁজে এসে হয়রান খাদিজা ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলেন, ‘আমাগোরে কেউ কিছু কয় না। মিডিয়া-সাম্বাদিক আইসা খালি জিগায় কে হারাইছে। কেউ কয় না কহন লঞ্চ উদ্ধার হইবো, লাশ পামু কহন।’ ফাতেমাতুজ্জোহরা স্বর্ণা, জান্নাতুল নাঈম লাকী ও নুসরাত জাহান হীরার খোঁজে এসেছেন স্বজনেরা। শিকদার মেডিকেলের ছাত্রী হীরার লাশ সোমবারই পাওয়া গেছে। লাকী আর স্বর্ণার লাশ মেলেনি। লাকী চীনে চিকিৎসাবিদ্যায় পড়াশোনা করছিলেন বলে জানান তাঁর চাচা এস এম জাকির। লাশ চাই স্লোগান নিয়ে গতকাল সকাল সাড়ে আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত মাওয়া ঘাটে ঢোকার মুখে চৌরাস্তায় বিক্ষোভ করেন স্বজনেরা। এ সময় সেখানে বাংলা ভিশনে কর্মরত দুই সাংবাদিকের ওপর চড়াও হন তাঁরা। একই সময়ে তাঁরা বিআইডব্লিউটিএর জাহাজ তিস্তায় হামলা চালিয়ে কিছু ভাঙচুর করেন। পরে পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তারা এসে দ্রুত লঞ্চ উদ্ধারের আশ্বাস দিয়ে তাঁদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেন। পালিয়েছে মালিক, খোঁজ নেই চালকের: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমএল পিনাক-৬ লঞ্চটি চালাচ্ছিলেন নবী নামের একজন। নবীর বিষয়ে গতকাল লঞ্চঘাটে তেমন কোনো তথ্য মেলেনি। ঘাটে কয়েকজন লঞ্চমালিকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, লঞ্চডুবির পর থেকে নবীর ফোন বন্ধ। নবী ডুবে গেছেন, না পালিয়ে আছেন জানা যায়নি। তবে লঞ্চমালিক আবু বকর সিদ্দিক ওরফে কালু মিয়া বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। আগামী শুক্রবার তাঁর বড় ছেলের বিয়ে হওয়ার কথা। গতকাল লৌহজংয়ের মেদিনীমণ্ডলের বাড়িতে গিয়ে তাঁর খোঁজ মেলেনি। এ ঘটনায় লঞ্চের মালিককে প্রধান আসামি করে এর মাস্টার (চালক), সারেং ও সুকানিসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে গতকাল সন্ধ্যায় মামলা হয়েছে। বেপরোয়া লঞ্চ চলাচল, অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই ও অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে মামলাটি করেছেন বিআইডব্লিউটিএর মাওয়া ঘাটের পরিবহন পরিদর্শক জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।
No comments:
Post a Comment