Wednesday, August 6, 2014

শোকে কাতর ৮০ পরিবার:প্রথম অালো

মাদারীপুর ৪৫ জন, ফরিদপুর ৩২ জন, গোপালগঞ্জ ২০ জন, নারায়ণগঞ্জ ৭ জন, বরিশাল ৬ জন, শরীয়তপুর ৪ জন, ঢাকা ৪ জন, লক্ষ্মীপুর ৩ জন, বাগেরহাট ২ জন, এ ছাড়া নরসিংদী ঝালকাঠি, চাঁদপুর ও কুমিল্লার একজন করে নিখোঁজ রয়েছে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ঘাটের অদূরে পদ্মা নদীতে লঞ্চডুবির ৩৬ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। কিন্তু নিখোঁজ যাত্রীদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। উদ্ধার তৎপরতা খাবি খাচ্ছে সেই শুরু থেকে। ডুবে যাওয়া লঞ্চের অবস্থানই শ
নাক্ত করা সম্ভব হয়নি। আগের দিন দুজনের লাশ উদ্ধারের পর গতকাল মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনে আর কারও মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। সরকারি হিসাবে ডুবে যাওয়া লঞ্চ পিনাক-৬-এর ১৩২ জন যাত্রী এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের করা তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই নিখোঁজেরা অন্তত ৮০টি পরিবারের সদস্য। পরিবারগুলোর একজন থেকে সর্বোচ্চ সাতজন সদস্য নিখোঁজ রয়েছেন। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান গতকাল রাতে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ওই লঞ্চের ১২৯ জন যাত্রীর কেউ বেঁচে নেই বলে আশঙ্কা করছেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, লঞ্চটির ধারণক্ষমতা ছিল ৮৫ জন যাত্রীর। কিন্তু তারা অনেক বেশি যাত্রী তুলেছে। প্রথমে কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে ১৫০ জন যাত্রী তুলেছে। সেখান থেকে সাত কিলোমিটার দূরের আরেকটি ঘাট থেকে আরও ৮০-৮৫ জন যাত্রী তুলেছে। মন্ত্রী ১২৯ জন (দুপুর পর্যন্ত হিসাব) বললেও রাত আটটায় জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণকক্ষ সূত্র নিখোঁজের সংখ্যা ১৩২ জন বলে জানিয়েছে। সময় যত যাচ্ছে, এ তালিকায় আরও নাম যুক্ত হচ্ছে। তবে প্রথম আলো ১২৭ জনের নামের তালিকা সংগ্রহ করতে পেরেছে। এরা অন্তত ৮০টি পরিবারের সদস্য। এ তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে মাদারীপুর জেলার আছেন সর্বোচ্চ ৪৫ জন। এর মধ্যে ২৯ জনই শিবচর উপজেলার। এ উপজেলার কাওড়াকান্দি ঘাট থেকেই গত সোমবার সকাল সাড়ে নয়টায় লঞ্চটি মাওয়া ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে আসে। মাওয়া ঘাট থেকে একটু দূরে থাকতেই উঁচু ঢেউ ও প্রবল স্রোতের টানে অতিরিক্ত যাত্রীবাহী ছোট দোতলা লঞ্চটি ডুবে যায়। ৮০ থেকে ৯০ জন যাত্রীকে স্পিডবোটের চালকেরা উদ্ধার করতে সক্ষম হন। এ দুর্ঘটনায় ফরিদপুরের নিখোঁজ রয়েছেন ৩২ জন। এ জেলার সদরপুর উপজেলার এক পরিবারের সাতজন নিখোঁজ আছেন। এ ছাড়া, গোপালগঞ্জের ২০ জন, নারায়ণগঞ্জের সাতজন, বরিশালের ছয়জন, ঢাকা ও শরীয়তপুরের চারজন করে, লক্ষ্মীপুরের তিনজন, বাগেরহাটের দুজন এবং কুমিল্লা, চাঁদপুর, নরসিংদী, ঝালকাঠির একজন করে নিখোঁজ আছেন। মাদারীপুরের শিবচর ঘুরে এসে আমাদের প্রতিনিধি জানান, সেখানে ঘরে ঘরে মাতম চলছে। স্ত্রী, মেয়ে, ছেলেসহ উপজেলার বন্দর খোলা এলাকার মিজানুর রহমান (৩৫) নিখোঁজ আছেন। দুই মেয়েসহ নিখোঁজ আছেন বয়রাতলা গ্রামের আমেনা (৩০)। ফরিদপুর থেকে প্রতিনিধি জানান, ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলায় একই পরিবারের সাতজন, ভাঙ্গায় একই পরিবারের পাঁচজন এবং সালথা উপজেলায় একই পরিবারের তিনজন নিখোঁজ আছেন। এক পরিবারের সাত সদস্য হলেন সদরপুর উপজেলার সাতরশি গ্রামের শিমুল পারভিন (৪০), তাঁর স্বামী ফখরুল ইসলাম রুবেল, দুই মেয়ে ফাইজা (৭), ফাতিহা (৩), ভাই সোবহান (৪২), ভাইয়ের স্ত্রী ইতি বেগম (৩০) ও ছেলে ইভান (৮)। সদরপুর উপজেলার স্থানীয় ৪ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য শাহাদত হোসেন জানান, বৃদ্ধ মোহাম্মদ আলী মাতুব্বর স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের নিজ বাড়িতেই বসবাস করতেন। মেয়ে শিমুল ঢাকার একটি হাসপাতালে ও ছেলে সোবহান মাতুব্বর একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। ঈদ করার জন্য তাঁরা একত্রে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। আত্মীয়স্বজন তাঁদের সন্ধানে মাওয়া ঘাটে অবস্থান করছেন। মাওয়া ঘাটেই দেখা পাওয়া গেল ওই পরিবারের স্বজন সাতরশি এলাকার ইউপি সদস্য রেখা বেগমের। তিনি নিখোঁজ শিমুল পারভীনের বোন। বললেন, ‘আমরা আর কিছু চাই না, নিখোঁজ স্বজনের লাশ ফেরত চাই।’ দুই হাতে বুক চাপড়ে তিনি বলছিলেন, ‘দুই দিন পার হতে চলল। লঞ্চটাই নাকি এহনও খুইজ্যাই পাইল না। নৌমন্ত্রী এহানে থাইক্যা কী করে।’ ভাঙ্গা উপজেলার হামিরদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোল্লা মো. ফারুক হোসেন জানান, তাঁর ইউনিয়নের ভীমেরকান্দা গ্রামের ইসমাইল মিয়ার পরিবারের পাঁচজন নিখোঁজ আছেন। এঁরা হলেন স্ত্রী চাঁদনী আক্তার (৪৫), তিন মেয়ে সাহিদা (১২), সুমনা (১০), রোমানা (৮ মাস) ও ইসমাইলের বোন তাছলিমা বেগম (৬০)। কাউলীবেড়া ইউনিয়নের খাটরা গ্রামের লোকমান মিয়ার পরিবারের তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন। কাউলীবেড়া ইউনিয়নের পল্লীবেড়া গ্রামের মোতালেব মাতুব্বর জানান, তাঁর ভাতিজা মোস্তফা মাতুব্বরের ছেলে রেজাউল মাতুব্বরসহ (২৮) আরও পাঁচজন মিলে একত্রে ওই লঞ্চে নদী পাড়ি দিচ্ছিলেন। লঞ্চটি ডুবে গেলে অন্য পাঁচজন তীরে উঠতে পারলেও তাঁর ভাতিজা উঠতে পারেননি। তিনি কিশোরগঞ্জের একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তবে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক সরদার শরাফত আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সংবাদ আসেনি বা আমি পাইনি। তবে যদি জেলার কোনো পরিবার বা কেউ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকে, তাহলে তাদের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকায় ৬ নম্বরে আছে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার পলির (২৮) নাম। তালিকায় তাঁর সন্ধানপ্রার্থীর নাম লেখা আছে চাচা নাজমুল, সম্পর্কে চাচা। সেখানে তাঁর মুঠোফোন নম্বরও দেওয়া আছে। সেই নম্বরে ফোন করলে নাজমুল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাতিজিকে গতকাল পর্যন্ত খুঁজে পাননি। তালিকার ৮৭ নম্বর নিখোঁজের স্বজন ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার রায়নগরের শামীমের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমার ভাবি আছমা বেগমকে (২৮) খুঁজে পাওয়া যায়নি। আপনার ফোন পেয়ে মনে হয়েছিল খবর পাওয়া গেছে। দুদিন ধরে আমরা পরিবারের চারজন মাওয়া ও কাওড়াকান্দি ঘাটে ভাবির খোঁজে অবস্থান করছি।’ নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বিবিসিকে বলেছেন, তাঁরা ঈদের আগে ৩৩টি ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চকে চিহ্নিত করেছিলেন। সে তালিকায় এই লঞ্চও ছিল। এগুলো বন্ধের জন্য তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেও মালিক সমিতি এর প্রতিবাদে ধর্মঘট করে। পরে গায়ের জোরে তারা ওই লঞ্চগুলো চালু করেছে। মন্ত্রী দাবি করেন, জনবল-সংকটের কারণে তাঁরা তদারকি ঠিকমতো করতে পারেননি। তিনি বলেন, ঈদের শুরুতে তদারকি অনেক ভালো থাকলেও ঈদের ছুটির শেষ দিকে তা কিছুটা কম হয়েছে।

No comments:

Post a Comment