Monday, August 4, 2014

হতভাগ্য ইগলছানা:প্রথম অালো

দুর্লভ ও বিরল পাখি হালতি ও রাঙা হালতির সন্ধানে গত বছরের জুলাই মাসে পাখি বিশেষজ্ঞ শরীফ খানের সঙ্গে গিয়েছিলাম ফকিরহাটের সাতশৈয়া গ্রামে। সেখানেই খবর পেলাম বাগেরহাটের যাত্রাপুরে পোষা ইগলছানাটির। যাত্রাপুরে এসেই খুঁজে বের করলাম ব্যবসায়ী শেখ সিরাজুল ইসলামকে, যিনি নানা জাতের পায়রাও পুষে থাকেন। তিনি জানালেন, কাঠ চেরাইয়ের জন্য একটি গাছ কিনেছিলেন। ওই গাছেই একটি পাখির ছানা পেয়েছিলেন। মুরগির বাচ্চা আকারের অস
হায় ছানাটির প্রতি তাঁর বেশ মায়া পড়ে যায়। নিয়ে আসেন বাড়িতে। পরম যত্নে ওকে প্রায় সাত মাস পুষে বড় করে তুললেন। ওকে তিনি ছেড়ে দিয়েই পালন করতেন। ডাকলেই তার কাছে চলে আসত। কিন্তু শিকারি পাখি বিচরণের জন্য যতটা বড় ও খোলা জায়গার প্রয়োজন, তা না থাকায় তার বাড়ি থেকে খানিক দূরে অবস্থিত একটি মাছের ঘেরের উৎসাহী কর্মচারী জামালকে ওর লালন-পালনের ভার দিলেন। আমরা যখন ঘেরে পৌঁছালাম, তখন পাখিটি একটি গাছে বসে ছিল। জামাল একটি ব্যাঙ হাতে নিয়ে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে ও নিচে নেমে এল এবং চমৎকার ভঙ্গিমায় ব্যাঙটিকে ছোঁ মেরে নিয়ে গাছের ডালে গিয়ে বসল। জামালের কাছেই শুনলাম যে এটি একটি মেয়ে পাখি। সম্প্রতি একটি বুনো ছেলে পাখির সঙ্গে ওর বেশ ভাব হয়েছে। পরিত্যক্ত একটি পাখির ছানা কিছু মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসায় শুধু বেঁচেই ওঠেনি, বড় হয়ে প্রজনন প্রক্রিয়ায়ও চলে এসেছে, ব্যাপারটি আমাদের বেশ ভালো লাগল। ঢাকায় ফেরার পরও নিয়মিত পাখিটির খবর পাচ্ছিলাম। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বুনো ছেলেটির সঙ্গে জোড় বেঁধে বাসা বানিয়েছিল। কদিন বাদেই হয়তো ডিম পাড়ত। কিন্তু বিধি বাম। গত ১১ নভেম্বর শরীফ খানের কাছে একটি সংবাদ শুনে দুঃখে মনটা বিষিয়ে গেল। পাখিটি মূল আবাসস্থল থেকে কিছুটা দূরে অন্য এক মাছের ঘেরে গিয়ে মাছ খাওয়ার অপরাধে (?) ঘেরের মালিকের বন্দুকের গুলিতে নিহত হয়েছে। এ খবরে যেকোনো পাখিপ্রেমিক দুঃখ পাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, বৃহত্তর ফরিদপুর এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে, যেখানে বর্তমানে ঘেরে মাছের চাষ হচ্ছে সেখানে, গুলি করে শিকারি পাখি মারাটা যেন স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে মারা পড়ছে নিরীহ পাখিগুলো। প্রকৃতি হচ্ছে বিপন্ন। এভাবে গুলি করে পাখি মারা বন্ধ না হলে দুর্লভ এই পাখিগুলোর বিলুপ্তির খাতায় নাম লেখাতে খুব বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না। যা হোক, এতক্ষণ যে ইগলছানাটির কথা বললাম, সে এ দেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি ‘বহুরূপী ইগল’ (Changeable Hawk-eagle)। ‘শিখাযুক্ত ইগল’ (Crested Hawk-eagle) নামেও পরিচিত। দেশব্যাপী বিস্তৃত অ্যাকসিপিট্রিডি পরিবারের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Spizaetus cirrhatus. বহুরূপী ঈগল লম্বায় ৭০ সেন্টিমিটার এবং ওজনে ১.৩ থেকে ১.৯ কেজি হয়ে থাকে। বছরে চার-পাঁচবার পালকের রং বদলায় বলে একেক সময় একেক রকম দেখায়। তাই এর নাম বহুরূপী ইগল। তবে দেহের রঙে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হালকা ও গাঢ় এ দুটি পর্বের প্রাধান্য দেখা যায়। হালকা পর্বে পিঠের রং বাদামি; বুক-পেট সাদাটে এবং তাতে লম্বা লম্বা দাগ থাকে। গাঢ় পর্বে একনজরে পাখিটিকে কালচে দেখায়; আসলে রং ঘন কালচে-বাদামি। হলুদ রঙের পা দুটি বেশ লম্বা। আর দেহও লম্বাটে। তবে ঠোঁট কালো। ছেলেমেয়ে দেখতে একই রকম। এরা খোলা বনভূমি, বনের কাছাকাছি আবাদি জমি ও বিল-জলাধারের আশপাশে বিচরণ করে। একাকি বা জোড়ায় থাকে। খাদ্যের তালিকায় রয়েছে ইঁদুর, তক্ষক, ব্যাঙ, ছোট সাপ, মাছ ইত্যাদি। এরা ‘কি-কি-কি-কি-কিউ’ স্বরে ডাকে। জানুয়ারি-এপ্রিল প্রজননকাল। উঁচু গাছের মাথায় ডালপালা ও সবুজ পাতা দিয়ে বাসা গড়ে। স্ত্রী বহুরূপী ইগল মৌসুমে ডিম পাড়ে মোটে একটি। সাদা রঙের এই ডিম ফোটে ২৭-৩০ দিনে।

No comments:

Post a Comment