Thursday, August 14, 2014

বড় প্রতিষ্ঠান ও সম্পদশালীদের হিসাবে চোখ এনবিআরের:কালের কন্ঠ

কিছু বড় মাপের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দেশের শীর্ষস্থানীয় সম্পদশালীদের অনেকের আয়-ব্যয় খতিয়ে দেখতে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) গতকাল বুধবার ১৫ সদস্যের ওই কমিটি গঠন করে। এনবিআরের তালিকায় থাকা শীর্র্ষ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবসা করছে। একাধিক করপোরেট হাউসের নামও আছে তালিকায়। কিছু রাজনীতিবিদ, সরকারি ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য, সরকারি আমলা, ব্যবসায়ী
নেতা, বিখ্যাত খেলোয়াড় ও শিল্পীদের অনেকের হিসাবই যাচাই করা হবে। এসব সম্পদশালী ব্যক্তি ও বড় মাপের প্রতিষ্ঠানকে রাজস্ব বোর্ড থেকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে, আবার ক্ষেত্রবিশেষে না জানিয়ে আয়-ব্যয়সহ সব ধরনের সম্পদের হিসাব নেবে টাস্কফোর্স। অর্থপাচারের সঙ্গে তারা কোনোভাবে জড়িত কি না তা বিশেষভাবে তদন্তের সময় খতিয়ে দেখা হবে। এনবিআরের গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) থেকে টাস্কফোর্সের কার্যক্রম পরিচালনা করবে। তবে তদন্তসংক্রান্ত রিপোর্ট বিশেষ গোপনীয়তায় সরাসরি এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোনো তদবির-সুপারিশে সমাজের এসব প্রভাবশালীকে নিয়ে কাজ করতে এনবিআর যাতে বাধার মুখে না পড়ে এ জন্য সৎ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ব্যক্তিগতভাবে এনবিআর কর্মকর্তাদের আশ্বাস দিয়েছেন। এনবিআর থেকে ১১৭টি শীর্ষ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ৪০৯ জন সম্পদশালী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এনবিআর সূত্র জানায়, সম্পদশালী ব্যক্তিদের মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী নেতা আছেন, যাঁদের সঙ্গে সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের ভালো সম্পর্ক আছে। এসব সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীর অনেকে আইনকানুনের তোয়াক্কা না করেই সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। অথচ তাঁরা নিয়মিত রাজস্ব পরিশোধ করছেন না। সরকারি-বিরোধী দলের কিছু প্রভাবশালী সংসদ সদস্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁদের নামে ক্ষমতার অপব্যবহারে সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এসব সংবাদ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে এনবিআর কাজ শুরু করবে। এলাকায় দাপট সৃষ্টিকারী কিছু রাজনীতিবিদ আছে এনবিআরের তালিকায়, যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অবৈধ আয় করছে অথচ রাজস্ব পরিশোধ করছে না। এসব ব্যক্তির কাছে রাজস্ব কর্মকর্তারা বকেয়া আদায়ে যোগাযোগ করলে নানা রকম ভয়ভীতি দিয়ে থাকে। কিছু আমলাও আছেন এনবিআরের তালিকায়। এসব আমলার অনেকেই ঘন ঘন বিদেশ সফর করে থাকেন। তাঁদের বিলাসী জীবনযাত্রার মানও বেতনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এসব সরকারি কর্মকর্তার বেশির ভাগের স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা বিদেশে আছেন। আয় না করলেও তাঁদের নামে একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট, গাড়ি রয়েছে। নামে-বেনামে জমির পরিমাণও কম নয়। এনবিআর থেকে জানা যায়, বিখ্যাত কিছু শিল্পী ও খেলোয়াড়ও রয়েছে এনবিআরের সর্বশেষ তালিকায়। উচ্চ পারিশ্রমিক পেলেও রাজস্ব পরিশোধ করেন নামমাত্র। আবার সময়মতো আয়কর রিটার্নও দাখিল করেন না। রাজউক থেকে এসব শিল্পী ও খেলোয়াড় সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে এনবিআর। বিখ্যাত শিল্পী ও খেলোয়াড়দের বেশির ভাগের দেশের অভিজাত এলাকায় একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে। আবার অনেকেই বিলাসবহুল একাধিক গাড়ির মালিক। শিল্পীদের অনেকেই একাধিক স্টেজ শো, নাটক, সিনেমাসহ নানা সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের অংশ নিয়ে বিপুল টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন। দেশে-বিদেশে একাধিক ব্যাংকে স্বনামে বেনামে অ্যাকাউন্ট (ব্যাংক হিসাব) আছে। তদন্তকালে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে এলসি খুলে যে পরিমাণ পণ্য আমদানির কথা, তা আনা হয়েছে কি না। আবার বন্ড সুবিধায় যে পরিমাণ পণ্য আনা হয়েছে তা কারখানায় ব্যবহার হয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হবে। তালিকায় থাকা বেশির ভাগ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া পাওনার পরিমাণ কোটি টাকার ওপর। বারবার নোটিশ দেওয়ার পরও এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকে নানা অজুহাতে বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ করছে না। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের অনেকের সঙ্গে একাধিকবার এনবিআর চেয়ারম্যান বৈঠক করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তাগাদা দিয়েছেন। বকেয়া পরিশোধে কিস্তির সুবিধা দিয়ে সহজ করে দিয়েছেন রাজস্ব পরিশোধে। কিন্তু বকেয়া বাবদ নামমাত্র কিছু অর্থ এনবিআরের তহবিলে জমা দিয়ে বাকি অর্থ পরিশোধে টালবাহানা করেন। মোবাইল ও সিগারেট খাতের কিছু কম্পানি আছে এ তালিকায়, যাদের কাছে বকেয়ার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। করপোরেট খাত থেকে গত পাঁচ অর্থবছরে এনবিআরের পাওনা গড়ে প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা। নানা রকম আইনি মারপ্যাঁচে বকেয়া আদায় হয় না। বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন দায়িত্ব গ্রহণের পরই একাধিকবার সমাজের এসব প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছ থেকে বকেয়া আদায়ে উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ পাওনা আদায় করতে পারেনি। এসব ব্যক্তির রাজস্বসংক্রান্ত হিসাব খতিয়ে দেখতে গেলে বেশির ভাগ সময়ই সরকারি নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে নানা ধরনের তদবির সুপারিশের সম্মুখীন হন এতে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম থেমে যায়। প্রয়োজনীয় আইনের অভাবে এনবিআরের তদন্তে অর্থপাচার করছে- এমন তথ্য থাকার পরও অনেক সময় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সম্পদশালী ব্যক্তির কাছ থেকে পাচারকৃত অর্থ থেকে হিসাবমতো রাজস্ব আদায় সম্ভব হয় না। বর্তমানে ট্রান্সফার প্রাইসিং আইন কার্যকর থাকায় এনবিআরের তালিকায় থাকা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অর্থপাচারসংক্রান্ত বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে বিশেষ নজরদারিতে। ট্রান্সফার প্রাইসিং আইনে যেকোনো দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা পাবেন টাস্কফোর্সের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির দেশে ও বিদেশে ব্যাংক হিসাবসংক্রান্ত তথ্য জানারও আইনি অধিকার থাকবে ট্রান্সফার প্রাইসিং আইনে। এনবিআরের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, চলতিবার উচ্চ রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন কৌশল নেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে দীর্ঘদিনের কর ফাঁকিবাজদের বিষয়ে এনবিআর কঠোর হয়েছে। এ ছাড়া সম্পদশালীদের প্রতিও নজরদারি বাড়িয়েছে।

No comments:

Post a Comment