বনানীর ২০ বিঘা জমি থেকে সৃষ্ট ৫৫ প্লট মিথ্যা তথ্য দিয়ে বরাদ্দ নেন চারদলীয় জোট সরকারের এমপি-মন্ত্রী, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা। শর্তভঙ্গের অভিযোগ প্রমাণিত হলেও লিজ বাতিল হয়নি বরাদ্দপ্রাপ্তদের। গৃহীত হয়নি কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও। রাজউক কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও বরাদ্দপ্রাপ্তদের অর্থের উৎস অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) উদ্যোগ নিলেও রহস্যজনক কারণে সেটি এগোয়নি। ফলে চারদলীয়
জোট সরকারের শেষ মুহূর্তের এ লুটপাটে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি অনুদ্ঘাটিতই থেকে গেছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এত বড় একটি দুর্নীতির ঘটনা কি অন্ধকারেই রয়ে যাবে? দুদক বলছে, রাজউকের দুর্নীতি অনুসন্ধানে একটি টিম কাজ করছে। রাজউক চেয়ারম্যান বলেছেন, আমরা দুদককে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করছি। দুদক ও রাজউক সূত্র জানায়, ঢাকায় রাজউকের আওতাধীন কোথাও নিজের/স্ত্রী-স্বামী/নির্ভরশীল ছেলে-মেয়ে অথবা পোষ্যের নামে কোনো জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট নেই, মর্মে হলফনামা দিয়ে রাজউক থেকে ৫৫ ব্যক্তি বনানীতে প্লট বরাদ্দ নেন। বরাদ্দপ্রাপ্তরা হলেন- লক্ষ্মীপুরের সাবেক এমপি আবুল খায়ের ভুইয়া, এম ইলিয়াছ আলী এমপি (বর্তমানে নিখোঁজ), একেএম ফজলুল হক মিলন, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মজিবুর রহমান মঞ্জু, মো. কবির হোসেন, শিক্ষক সাবিনা শারমিন, হাফিজ ইব্রাহিম, আবদুল মান্নান ভুইয়া, আবুল হোসেন খান, আবদুল্লাহ আল নোমান, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, জাতীয় পার্টির নেত্রী ড. হামিদা বানু শোভা, সামসুজ্জোহা খান, মশিউর রহমান, সেলিমা রহমান, হাবিবুল ইসলাম হাবিব, সামসুদ্দিন আহমেদ এছাহাক, এম নাসের রহমান, আখতার হামিদ সিদ্দিকী, মফিকুল হাসান তৃপ্তি (ব্যবসা), আলমগীর হায়দার খান, ইমতিয়াজ আহমেদ (ব্যবসা), খায়রুল কবির খোকন, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, মজিবর রহমান সারোয়ার, মো. শহিদুল ইসলাম, মো. ফজলুর রহমান, নাজিম উদ্দিন আলম, আসাদুল আশরাফ (চাকরি), শহিদুল আলম তালুকদার, মহিউদ্দিন খান (ব্যবসা), মেহেদী হাসান (ব্যবসা), শাহজাহান চৌধুরী, মাসুদা একরাম (ব্যবসা), তরিকুল ইসলাম, এসএম হাসান রেজা (ব্যবসা), প্রফেসর মনিরুজ্জামান মিঞা (শিক্ষক), মীর মো. নাসির উদ্দিন, লুৎফর রহমান খান আজাদ, আলমগীর কবির, হাফিজউদ্দিন আহম্মেদ, আ ন ম এহছানুল হক মিলন, মো. আবদুল হাই, মিজানুর রহমান মিনু, মিসেস সুফিয়া খাতুন (পেশা উল্লেখ নেই), নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু, বরকত উল্লাহ বুলু, অ্যাডভোকেট নাদিম মোস্তফা, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু এবং আহসান হাবীব (ব্যবসা)। এদের মধ্যে আবুল খায়ের ভুইয়ার প্লট ছাড়া সবই রাজউক রেজিস্ট্রি করে দখল বুঝিয়ে দিয়েছে। প্লটগুলোতে তারা স্থাপনাও গড়ে তুলেছেন। রাজউককে দেয়া রাজস্ববোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রায় প্রত্যেকেরই নামে-বেনামে ঢাকায় ফ্ল্যাট, প্লট, বাড়ি কিংবা জমি রয়েছে। রাজউক এলাকায় থাকা এসব জমি, প্লট, ফ্ল্যাটের তথ্য তারা নিজেরাই স্বীকার করেছেন আয়কর নথিতে। সে অনুযায়ী তারা আয়করও দিয়েছেন। মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে রাজউকের প্লট গ্রহণ সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত। রাজউক অনুসৃত ‘দ্য টাউন ইমপ্র“ভমেন্ট অ্যাক্ট-১৯৫৩’ ও ‘দ্য ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (অ্যালোটমেন্ট অব ল্যান্ড) রুলস-১৯৬৯’-এর পরিপন্থী। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্লটের লিজ বরাদ্দ বাতিল এবং ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার বিধান রয়েছে। অথচ গুরুতর অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়নি গত ৮ বছরেও। বরং এ অনিয়মের সঙ্গে তৎকালীন সরকার সংশ্লিষ্টদের আড়াল করতে দুদকের অনুসন্ধানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে রাজউকের বিরুদ্ধে। কোনোভাবেই যেন বিরাট এ দুর্নীতির কিনারা না হয় সে লক্ষ্যে জটিলতা সৃষ্টি করে সময়ক্ষেপণ করছেন রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান জিএম জয়নুল আবেদীন ভুইয়া যুগান্তরকে বলেন, আমরা যেকোনো অনুসন্ধানে দুদককে স্বাগত জানাই। অসহযোগিতার অভিযোগ যথার্থ নয়। দুদককে সর্বোত সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত। অনুসন্ধানে জানা যায়, তথ্য গোপন করে বনানীতে ৫৫ প্লট বরাদ্দ নেয়ার অভিযোগ তদন্তে একবার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। এর অংশ হিসেবে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ২০১২ সালের ১২ ফেব্র“য়ারি রাজউককে অভিযোগ তদন্ত করে প্লটের বরাদ্দ বাতিলসহ ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা করার নির্দেশ দেয়। সে অনুযায়ী তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও এখন পর্যন্ত কারও প্লট বরাদ্দ বাতিল হয়নি, মামলাও করেনি রাজউক। বরং ২০১৩ সালের ১০ জুন রাজউক সচিব স্বাক্ষরিত গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিবের কাছে পাঠানো পত্রে এ বিষয়ে সাফাই গাওয়া হয়। বলা হয়, বনানী ২০ বিঘা জমির বিষয়ে ২৯/১১/২০১২ তারিখে রাজস্ব বোর্ডকে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়। রাজস্ববোর্ড থেকে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়নি। এ কার্যক্রমে রাজউকের কোনো গাফিলতি ছিল না। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পালনে রাজউক সব সময় সচেষ্ট আছে। এদিকে বিধিবহির্ভূতভাবে বনানীর ২০ বিঘা জমি বরাদ্দের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদকও। এ প্রক্রিয়ায় দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-১ শাখার উপপরিচালক মো. মাহমুদ হাসান ২০১২ সালের ২৯ জুলাই এ বিষয়ক রেকর্ডপত্র চেয়ে রাজউক চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দেন। এর মধ্যে ছিল ৫৫ জন প্লট গ্রহীতার প্লট বরাদ্দসংক্রান্ত আবেদনপত্র, বরাদ্দপত্র, অঙ্গীকারনামা, লিজ অ্যাগ্রিমেন্টসহ প্লট বরাদ্দসংক্রান্ত নথির ছায়ালিপি, বরাদ্দ নীতিমালার সত্যায়িত কপি, বরাদ্দ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়/রাজউক কর্তৃক গঠিত কমিটিগুলোর তালিকা ও তৎকালীন রাজউক সদস্যদের বর্তমান ঠিকানা। চিঠিতে একই বছর ৮ আগস্টের মধ্যে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহের সময় বেঁধে দেয়া হলেও রাজউক তা দেয়নি। ১২ আগস্ট কিছু তথ্য পাওয়ার পর ৩০ আগস্ট দুদক আরও তথ্য চেয়ে আবারও চিঠি দেয় রাজউককে। কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য না পাওয়ায় সেখানেই থেমে যায় দুদকের অনুসন্ধান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি অনুসন্ধানে আমাদের বেশ কিছু টিম কাজ করছে। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের একটি হিসেবে রাজউকেও টিম কাজ করছে। রাজউকের সহযোগিতা পেলে সব দুর্নীতিই উদ্ঘাটন সম্ভব।
No comments:
Post a Comment