Monday, August 4, 2014

পিছু হটল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়:যুগান্তর

দেশের পাঁচ শতাধিক চিকিৎসককে শূন্য পদের বিপরীতে বদলি করে বিপাকে পড়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। রাজনৈতিক চাপে বদলির আদেশ বাতিল বা বহাল কোনোটাই করতে পারছে না। এ অবস্থায় নতুন পদে যোগদান না করার অফিস নির্দেশনা জারির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ইনসিটু’র আদেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। ফলে বদলির নির্দেশ কার্যকর না হলেও বহাল থাকছে চলতি দায়িত্বের আদেশ। বদলির পর এক কর্মদিবসের মধ্যেই সব ঘটনা ঘটেছে। জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসচিব এমএ
ম নিয়াজ উদ্দিন রোববার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, যারা রিলিজ নিয়ে নতুন কর্মস্থলে চলে গেছেন বা পথে আছেন তাদের ফিরে আসতে হবে। তবে চলতি দায়িত্বের আদেশ বহাল থাকবে। পাল্টাপাল্টি সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সচিব বলেন, এ মুহূর্তে বিপুলসংখ্যক ডাক্তার একসঙ্গে বদলি হলে হাসপাতালগুলোতে স্বাভাবিক কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটবে এ বিবেচনায় স্থিতাবস্থা দেয়া হয়েছে। বদলি পদায়ন নিয়ে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত হবে। বিপরীতমুখী আদেশের কারণে ডাক্তারদের হয়রানিতে পড়া সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। ২৭ জুলাই বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্তব্যরত ৫১৭ মেডিকেল অফিসার ও সমমর্যাদা পদের কর্মকর্তাকে জুনিয়র কনসালট্যান্টের চলতি দায়িত্ব দিয়ে বদলি করা হয়। মেডিকেল অফিসার ও সমমর্যাদার পদে কর্মরতদের পদোন্নতি না হওয়ায় তাদের শূন্য পদে চলতি দায়িত্ব দিয়ে বদলি করা হয়। কিন্ত এক সঙ্গে এত চিকিৎসক বদলি করায় হাসাপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের নিরবচ্ছিন্ন সেবা বিঘ্নিত হওয়ার আশংকা দেখা দেয়। একই সঙ্গে ঢাকার বাইরে বদলি করায় আসে রাজনৈতিক চাপ। প্রশ্ন উঠে একসঙ্গে পাঁচ শতাধিক চিকিৎসক কেন বদলি করা হল। অবস্থা বেগতিক দেখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বদলির আদেশ বাতিল না করেই নতুন পদে যোগদান না করার নির্দেশনা জারি করে ৩ আগস্ট। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ইনসিটুর আদেশ দেয়। এভাবে ইনসিটু দেয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ শূন্য পদের বিপরীতে পদোন্নতি বা চলতি দায়িত্ব দেয়ার পর ইনসিটু কার্যকর করা যায় না। এভাবে ইনসিটু পদ্ধতি ব্যবহার বিধিবহির্ভূত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দাফতরিক আদেশ পর্যালোচনা, জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ, মাঠপর্যায়ের চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। বিভিন্ন সূত্রের অভিযোগ, আওয়ামীপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাচিপ নেতাদের চাপে ঢাকার বাইরে ডাক্তারদের বদলি আদেশ দিয়েও পিছু হটেছে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, বদলিকৃতদের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি চিকিৎসককে ঢাকা থেকে অন্যত্র পদায়ন করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট, মিটফোর্ড হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকেও অনেক ডাক্তারকে বদলি করা হয়েছিল। বদলি আদেশ আটকে পড়ায় এখন এই চিকিৎসকরা ঢাকায়ই বসে থাকবেন। কেউ যাবেন না নতুন কর্মস্থলে। ঢাকা থেকে বদলিকৃত অনেক চিকিৎসক স্বাচিপের রাজনীতিতে যুক্ত। ঈদের ছুটি শুরুর আগেরদিন শেষ কর্মদিবসের শেষ বেলায় ৫১৭ জন মেডিকেল অফিসার অথবা সমমর্যাদার চিকিৎসককে জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদে চলতি দায়িত্ব দিয়ে বদলি আদেশ জারি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপন নং ৪৮২। রোববার সকালে হঠাৎ করে ইনসিটু বিষয়ক আদেশ জারি করা হয়। উভয় প্রজ্ঞাপন নিয়ে স্বাস্থ্য খাতে শোরগোল পড়ে যায়। বদলি আদেশ জারির পর থেকে শুরু হয় ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ ও তদবির। লবিং চলে ঈদের ছুটির সময়েও। বদলিকৃতদের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত নিরীহ ধাঁচের চিকিৎসক ও সক্রিয় রাজনীতি করেন না তারা বর্তমান কর্মস্থল থেকে রিলিজ নিয়েছেন। অনেকে নতুন কর্মস্থলে যোগদানও করেছেন বলে জানিয়েছে সূত্র। বদলি আদেশ পরিবর্তনে এদের সবাই হয়রানিতে পড়েছেন। রোববার নতুন কর্মস্থলের উদ্দেশে যাত্রা করে মাঝপথে মন্ত্রণালয়ের নতুন সিদ্ধান্তের খবর শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন চিকিৎসকরা। মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, আর কয়েকদিন পরই বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত ছয় সহস্রাধিক ডাক্তার সরকারি চাকরিতে যোগ দেবেন। এদের তৃণমূলে পদায়ন করার কথা রয়েছে। এজন্য এন্ট্রি পদ ফাঁকা করতে চলতি দায়িত্বে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। রোববার মন্ত্রণালয়ে উপস্থিত কয়েকজন চিকিৎসক অবশ্য বলেন, নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের তো ঢাকায় পদায়ন দেয়ার কথা নয়। তাহলে ঢাকার চিকিৎসকদের বদলি আদেশের যুক্তি কি ? কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ১৩টি শাখার মোট ৫১৭ জন চিকিৎসককে চলতি দায়িত্বে জুনিয়র কনসালট্যান্ট করে বদলি আদেশ জারি করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে গাইনি চিকিৎসক ৮৪ জন, মেডিসিনের ৫৫ জন, সার্জারির ৪৪ জন, অ্যানেসথেসিয়ার ১৯ জন, অর্থো-সার্জারির ৪১ জন, চক্ষু শাখার ২৫ জন, কার্ডিওলজির ৬০ জন, শিশু শাখার ১০৮ জন, ইএনটির ২২ জন, চর্ম ও যৌন শাখার ৮ জন, রেডিওলজির ৩০ জন, প্যাথোলজির ৮ জন এবং বক্ষব্যাধি শাখার ২১ জন চিকিৎসক রয়েছেন। প্রধানত ঢাকার বাইরে পদায়নকৃত এই চিকিৎসকরা নতুন কর্মস্থলে যাওয়া থেকে আপাতত রেহাই পেয়ে গেছেন। এতে গ্রামাঞ্চলে সেবা সমৃদ্ধ করার বিষয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন কাজ বিঘ্নিত হবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেছেন, অবিবেচনাপ্রসূত এসব সিদ্ধান্ত (বদলি আদেশ ও বাতিল করা) নেয়াই উচিত হয়নি। এগুলো মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তাদের মতে, একসঙ্গে ঢালাও বদলির কারণে তদবির বেশি হয়েছে। একসঙ্গে বদলির প্রভাব সম্পর্কে আগেই ভাবা উচিত ছিল। সূত্রগুলো যুগান্তরকে বলেছে, পূর্ববর্তী আদেশ ও নতুন আদেশ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বিভক্ত মতামত দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার ঈদের ছুটির পর প্রথম কর্মদিবসে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। ঈদের আগে শেষ কর্মদিবসে তড়িঘড়ি করে বদলি ও পদায়নের প্রজ্ঞাপনটি জারির পর থেকে চিকিৎসক নেতারাও তদবির, লবিং করেছেন। এর ফলে রোববার সকালে মন্ত্রণালয়ের পার-৩ অধিশাখা থেকে জারিকৃত আদেশে পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত পদায়নকৃত কর্মকর্তাদের বর্তমান কর্মস্থল থেকে অব্যাহতি প্রদান না করে ইনসিটু রাখার কথা জানানো হয়। স্বাস্থ্যসচিব অবশ্য দাবি করেছেন, ‘স্বাচিপ বা অন্য কোনো পক্ষের চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়নি। এগুলো প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিষয়।’ রোববার সকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দেখা যায়, করিডোরে স্বাচিপ নেতাদের পদচারণা। মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য বিষয়বস্তুর সঙ্গে ডাক্তারদের বদলি-পদায়ন নিয়েও দফায় দফায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কক্ষে বৈঠক হয়েছে। স্বাস্থ্যসচিব এমএম নিয়াজ উদ্দিন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মোঃ নুরুল হক, স্বাচিপ ও বিএমএ মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলানসহ আরও কয়েকজন দীর্ঘক্ষণ মন্ত্রীর কক্ষে বৈঠক করেন। তবে বৈঠক থেকে বেরিয়েই স্বাচিপ নেতারা কার্যত আড়ালে চলে যান। স্বাচিপ মহাসচিবের মুঠোফোনে কল দিলে একবার রিং বাজে। এরপর থেকে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। বন্ধ ছিল অন্য শীর্ষ নেতাদের মুঠোফোনও। ফলে স্বাচিপের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অধিদফতরের মহাপরিচালকের (ডিজি) মোবাইলে কল দিলে তিনিও সাড়া দেননি। মহাপরিচালকের দফতরে যোগাযোগ করে জানা গেছে, তিনি (ডিজি) প্রায়শই গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলেন।  

No comments:

Post a Comment