Friday, August 8, 2014

নাকে কাপড় চেপে স্বজনের খোঁজ:প্রথম অালো

দুর্ঘটনার চার দিন পার হলেও পদ্মা নদীতে ডুবে যাওয়া লঞ্চটি শনাক্ত হলো না। গতকাল বৃহস্পতিবার ১০ জাহাজ পদ্মা চষে বেড়িয়েও কোনো ফল লাভ করতে পারেনি। সে তুলনায় কয়েকজন স্বজনকে সৌভাগ্যবান বলতে হবে। তাঁরা প্রিয়জনের পচা লাশ হলেও পেয়েছেন। ভাটির বিভিন্ন জায়গা থেকে গতকাল উদ্ধার হয়েছে এমন আরও ১২ লাশ। সব মিলে চার দিনে উদ্ধার হয়েছে ৩৩টি মৃতদেহ। গতকাল স্বজনদের সব মনোযোগ ছিল মাদারীপুরের শিবচরের পাঁচ্চর প্রাথমিক
বিদ্যালয়ের মাঠে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় সবার মুখে গামছা বাঁধা, কারও মুখে মুখোশ (মাস্ক)। শ খানেক মানুষ এভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এখানেই জড়ো করা হচ্ছে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় ডুবে যাওয়া লঞ্চ পিনাক-৬-এর নিহত যাত্রীদের লাশ। লাশের গন্ধ ছড়িয়েছে চারদিকে। কেউ সুগন্ধির (এয়ার ফ্রেশনার) ক্যান হাতে নিয়ে ছিটাচ্ছেন। তবু যাচ্ছে না গন্ধ। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে এই বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষে রাখা ছিল ১৩টি শনাক্ত না হওয়া লাশ। মাদারীপুর জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, এখান থেকে গত দুই দিনে মোট ১০টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া, আরও তিনটি লাশ ভোলা ও মুন্সিগঞ্জ থেকে নিয়ে গেছেন স্বজনেরা। গতকাল বিকেলে ভোলা থেকে আরও পাঁচটি লাশ উদ্ধারের তথ্য জানানো হয়েছে। ওই লাশগুলো পাঁচ্চর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া, বিভিন্ন জায়গায় লাশ উদ্ধার হলে সেগুলোও এই বিদ্যালয়ের মাঠে আনা হবে। সব লাশই এখন নদীর ভাটির দিকে মিলছে। গতকালও দিনভর খোঁজাখুঁজি করে ডুবে যাওয়া লঞ্চের সন্ধান মেলেনি। জরিপ জাহাজ কান্ডারি-২ দিনভর তল্লাশি চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। কর্মকর্তারা জানান, গতকাল ১০টি জাহাজ তল্লাশিতে অংশ নেয়। এর মধ্যে পাঁচটিতে উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্র দিয়ে খোঁজ চলেছে। আর পাঁচটিতে প্রথাগতভাবে খোঁজা হয়েছে। কিছুই মেলেনি। অভিযানের দায়িত্বে থাকা নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, কান্ডারি জাহাজে সাব বটম প্রোফাইলার নামে উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। শব্দতরঙ্গ (অনেকটা আল্ট্রা সাউন্ডের মতো) ব্যবহার করে এই জাহাজ নদীর তলদেশে ১৮ থেকে ৭০ ফুট পর্যন্ত তথ্য দিতে পারে। তবে গতকালও ডুবে যাওয়া লঞ্চর সন্ধান মেলেনি। লঞ্চের আশা বাদ দিয়ে স্বজনেরা এখন ছুটছেন লাশ খুঁজতে। প্রচুর স্বজন মাওয়া থেকে মাদারীপুরের শিবচরের পাঁচ্চরে চলে এসেছেন। ফলে মাওয়া ঘাটে গতকাল আর আগের মতো স্বজনদের উপস্থিতি ছিল না। মাদারীপুর জেলা প্রশাসন আজ শুক্রবার জুমার নামাজের পর অশনাক্ত লাশগুলো শিবচর পৌর কবরস্থানে দাফনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার আগে অশনাক্ত লাশগুলোর ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে। গতকাল বিকেলে পাঁচ্চর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে একটি সমন্বিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জেলা প্রশাসক জি এস এম জাফর উল্লাহ, পুলিশ সুপার ফরিদুল ইসলামসহ স্থানীয় গণ্যমান্যরা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের বলেন, নিহতদের স্বজনেরা সরকার ঘোষিত এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা ও দাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা এই স্কুলের মাঠ থেকেই দেওয়া হবে। আর কত: ঢাকা সিটি করপোরেশনের গাড়িচালক নাসির শেখ স্ত্রী স্বপ্না বেগম আর তিন বছরের ছেলে আবদুল্লাহকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। দুই দিন ধরে পাঁচ্চরে রয়েছেন। এর মধ্যেই ২৫টি লাশ উল্টেপাল্টে দেখেছেন। কিন্তু পাননি নিজের স্বজনদের। নাসির বললেন, ‘ছেলেটা আমার বয়সের চেয়ে বাড়ছে বেশি। তিন বছরেই আমার কোমরসমান হইছে। কফি কালারের শার্ট আর প্যান্ট পরে ছিল ও। লঞ্চে ওঠার পরেও ওর মারে কইলাম ওরে দেইখো। ওর মাও গেলো। এহন মা পোলার পচা মুখ দেইখা আমি সইতে পারবো কি না জানি না। তবু বউ-পোলার লাশটা পাইলে কখনো কখনো কবরে তো যাইতে পারুম।’ বিকেল চারটার দিকে শরীয়তপুরের নড়িয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্সে আসে একটি লাশ। দূর থেকে সাইরেন শুনেই রাস্তার পাশে মুখের গামছা শক্ত করে বেঁধে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যান মানুষগুলো। গাড়িটি বিদ্যালয়ের মাঠে থামতেই ছুটে গেলেন স্বজনেরা। রেড ক্রিসেন্টের কর্মীরা বডি ব্যাগে ভরা লাশটি ধরে বিদ্যালয়ের বারান্দায় নিয়ে গেলেন। ব্যাগ খুলতেই দেখা গেল পরনে লাল জামা সাত থেকে আট বছরের এক মেয়েশিশু। নাকে আঁচল চাপা দিয়ে কয়েকজন নারীও লাশটি শনাক্তের জন্য এগিয়ে গেলেন। দেখে সহ্য করতে পারলেন না কয়েকজন। দৌড়ালেন টিউবওয়েলের দিকে। এ রকম বিকৃত মুখ সহ্য করা কঠিন। বাবা কাজী আনোয়ার উল্লাহর (৬৭) খোঁজে এসেছেন ছেলে ইয়াকুব নিজামী। ইয়াকুব জানান, তাঁদের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। তাঁর বাবাসহ জেলার কমলনগর থানার ফজু মিয়ার হাট এলাকার ১৬ জন ইসলাম প্রচারে (তাবলিগের সঙ্গে) ৪০ দিনের (চিল্লায়) জন্য নড়াইলে গিয়েছিলেন পবিত্র রমজানের আগেই। চিল্লা শেষে ওই দিন তাঁরা ১৬ জন রাজধানীর কাকরাইলে তাবলিগের কেন্দ্রীয় মসজিদে যাচ্ছিলেন। লঞ্চডুবির পরে ১৬ জনের মধ্যে ১১ জন বেঁচে গেছেন। পরে একজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। বাকি তিনজন এখনো নিখোঁজ। ইয়াকুব বলেন, ‘আব্বার মুখ ভরা দাড়ি ছিল। পচে গলে আব্বার এই মুখ আমি কীভাবে দেখব।’ তবু নাক-মুখ গামছায় চেপে ধরে একের পর এক লাশ দেখে চলেছেন ইয়াকুব। দুই রাত ধরে পাঁচ্চরের স্থানীয় মসজিদের বারান্দায় আছেন তিনিসহ কয়েকজন। এর আগে মাওয়ায় এক রাত দাঁড়িয়ে কাটিয়েছেন। বরিশাল, ভোলা ও লক্ষ্মীপুরে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও আটটি লাশ উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার ফজরগঞ্জ এলাকার নতুনহাটে তেঁতুলিয়া নদী থেকে গতকাল সকাল নয়টার দিকে একটি লাশ উদ্ধার করা হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে জানা যায়, তাঁর নাম জাকির হোসেন (৪০)। বাকেরগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণকাঠী গ্রামের আবদুল হামিদ হাওলাদারের ছেলে তিনি। পুলিশ লাশটি পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে। মেহেন্দিগঞ্জ থানার ওসি উজ্জ্বল কুমার দে জানান, মুন্সিগঞ্জে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণকক্ষে যোগাযোগ করে জানা গেছে, সেখানে নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকায় জাকির হোসেনের নাম আছে। হিজলা উপজেলার হিজলা-গৌরবদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম জানান, তাঁর ইউনিয়নসংলগ্ন মেঘনা নদীতে গতকাল দুপুরে দুটি লাশ ভাসতে দেখা যায়। পরে লাশগুলো ভেসে মুলাদী এলাকায় চলে যাওয়ায় মুলাদী থানাকে সংবাদ দেওয়া হয়। মুলাদী থানা লাশ দুটি উদ্ধার করে। মুলাদী থানার ওসি মো. আলাউদ্দিন জানান, লাশ দুটি মাওয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের কাঠির মাথা মেঘনায় গতকাল সকাল সাড়ে নয়টার দিকে এক নারীর লাশ ভেসে ওঠে। তাঁর আনুমানিক বয়স ৩০ বছর। পরনে সবুজ সালোয়ার-কামিজ। বেলা দুইটার দিকে একই উপজেলার পূর্ব ইলিশা ইসলামীয়া মডেল কলেজের পেছনে ভেসে ওঠে সাত-আট বছর বয়সী একটি মেয়েশিশুর লাশ। তার পরনে রয়েছে মখমলের প্যান্ট ও ফ্রক। লালমোহন উপজেলার ধলীগৌর নগর বাত্তিরখাল মাছঘাট এলাকার মেঘনা নদীতে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে এক যুবকের লাশ ভেসে ওঠে। তাঁর পরনে নীল প্যান্ট ও লাল শার্ট। প্রায় একই সময় মনপুরা উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়নের চর ফয়জুদ্দিনের জংলার খাল আনসার চেয়ারম্যানের ঘাটে ভেসে ওঠে একজন নারীর লাশ। তিনি কালো বোরকা পরা। তাঁর পরনে রয়েছে কালো সালোয়ার ও কালো-সাদা কামিজ। ভোলার সহকারী পুলিশ সুপার রামানন্দ সরকার জানান, লাশগুলোর চেহারা প্রায় বিকৃত হয়ে গেছে। এগুলো মাদারীপুরের শিবচরে পাঠানো হয়েছে। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার সাহেবেরহাট ইউনিয়নের মাতাব্বরনগর এলাকায় মেঘনা নদী থেকে বুধবার রাত নয়টার দিকে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর (২৫) লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। কমলনগর থানার ওসি মো. হুমায়ূন কবির জানান, সন্ধ্যায় নদীতে দুটি লাশ ভাসতে দেখে স্থানীয়রা থানায় খবর দেন। পুলিশ রাতে গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে। তীব্র স্রোতে ভেসে যাওয়ায় অপর লাশটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। উদ্ধার করা লাশটি শিবচরে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বরিশাল ও ভোলা অফিস এবং রামগতি (লক্ষ্মীপুর) প্রতিনিধি

No comments:

Post a Comment