গ্রাহকদের কাছ থেকে বেপরোয়া সার্ভিস চার্জ আদায় করছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্য দিয়ে ‘গলাটাকা’ ব্যবসা করছে তারা। এ ব্যবসা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মাত্রাতিরিক্ত চার্জ আদায়ের দায়ে এখন পর্যন্ত ৭টি ব্যাংককে সতর্ক করেছে। তিনটি ব্যাংকের গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করা অতিরিক্ত চার্জ ফেরত দিতে বাধ্য করেছে। আরও কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। বেআইনিভাবে মাত্রাতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ আদায় করলে সং
শ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে এর আগে ব্যাংকের এমডিদের সতর্ক করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপরও চার্জ আদায় কমেনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আরও বেড়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন মাত্রাতিরিক্ত চার্জ আদায় করলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে আর্থিক জরিমানাসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া বিভিন্ন ধরনের অনুমোদন আটকে দেয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে। ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন শাখা খোলা, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসা, ইসলামী ব্যাংকিং ইউনিট চালু, মোবাইল ব্যাংকিং ও শাখা স্থানান্তরে অনুমতি নিতে হয়। বেশি সার্ভিস চার্জ আদায় করলে এসব কাজ আটকে দেয়া হবে। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করে মাত্রাতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ নেয়ার দায়ে বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রাইম ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংকের গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা বাড়তি চার্জ ফেরত দিতে বাধ্য করেছে। ব্যাংকগুলোর মাত্রাতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ আদায়ের বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ও জানে। কোন কোন ব্যাংক কত ধরনের চার্ভিস চার্জ আদায় করছে সেগুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। এ বিষয়ে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ বিষয়ে পর্যালোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তফসিলি ব্যাংকে বিভিন্ন সেবার বিপরীতে অত্যধিক চার্জ আদায়ে ক্ষুব্ধ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গ্রাহকের ওপর অস্বাভাবিক চার্জ যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে সম্প্রতি নির্দেশ দেন তিনি। ওই নির্দেশ পেয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ উল্লিখিত উদ্যোগ নেয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকিং বিভাগের সচিবের কাছে লেখা নোটে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, যেখানে সর্বমোট চার্জ ৪শ’ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়, সেখানে বর্তমানে এক হাজার টাকা পর্যন্ত চার্জ আরোপ করা হচ্ছে। এ বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যাংকিং বিভাগকে তৎপর হতে হবে। জানতে চাইলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিব ড. এম আসলাম আলম যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন মিডিয়ার রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী ব্যাংকগুলোর সার্ভিস দেখতে বলেছেন। আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছি ব্যাংকগুলো সার্ভিস চার্জ অযৌক্তিকভাবে আদায় করছে কিনা। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। বিষয়টি এখন বাংলাদেশ ব্যাংকও মনিটরিং করছে। সার্ভিস চার্জ পরিশোধ করতে গিয়ে বেশির ভাগ গ্রাহকেরই হিসাবের মূল টাকা কমে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে ব্যবসা খরচ। এ কারণে ব্যবসায়ীরা তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছেন। সাধারণ গ্রাহকরাও ব্যাংকে টাকা রেখে মুনাফা পাওয়া তো দূরের কথা উল্টো ফতুর হচ্ছেন। ব্যাংকগুলো আগে ঋণের সুদ থেকেই মূল আয় করত। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক জালিয়াতির কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ আদায় করতে পারছে না। ওইগুলো খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এর বিপরীতে প্রভিশন রাখতে গিয়ে ব্যাংকের তহবিল আটকে যাচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলো এখন নিজেদের দুর্নীতি ও ব্যর্থতার দায় চাপাচ্ছে গ্রাহকদের ওপর। তাদের কাছ থেকে গলাকাটা সার্ভিস চার্জ আদায় করে মুনাফা বাড়াচ্ছে। এই মুনাফা দিয়ে দুর্নীতির দায় শোধ করছে। সার্ভিস চার্জ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী ব্যাংকের হিসাবের বিবরণী গ্রাহককে বছরে দুটি ফ্রি দিতে হবে। এর বেশি নিলে তার ওপর চার্জ আরোপ করা যাবে। কিন্তু ব্যাংকগুলো সব হিসাব বিবরণী দেয়ার ক্ষেত্রেই ফি নিচ্ছে। এ ফি ভ্যাটসহ ১১৫ টাকা থেকে সাড়ে ১১শ’ টাকা। আগে হিসাব বিবরণী দেয়ার ক্ষেত্রে এইচএসবিসি ব্যাংক সাড়ে ১১শ’ টাকা ফি নিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে সম্প্রতি এটি তারা কমাতে বাধ্য হয়েছে। ডাচ্-বাংলা ও ব্র্যাক ব্যাংক গ্রাহকদের কোনো হিসাব বিবরণী ফ্রি দিচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ অনুযায়ী গ্রাহকের কাছে চিঠি পাঠানো বা কাগজপত্র ফটোকপি বাবদ প্রকৃত খরচ নিতে হবে। কোনোক্রমেই বেশি নেয়া যাবে না। কিন্তু ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে বেশি ফি আদায় করছে। ইসলামী ব্যাংক আগে এলসির তথ্য গ্রাহককে জানাতে ফি নিত ১১শ’ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে তারা এটি কমাতে বাধ্য হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে প্রতি বছর একটি হিসাবের বিপরীতে একজন গ্রাহকের সার্ভিস চার্জ বাবদ ব্যয় হচ্ছে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। এর মধ্যে হিসাব পরিচালন ফি ৫০০ টাকা ও এটিএম কার্ড ফি ৫০০ টাকা। বিভিন্ন সময় ব্যাংকটি এসএমএস পাঠানো ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের জন্যও বছরে ৫৭৫ টাকা কেটে রাখছে। কোনো গ্রাহক এসএমএস পেতে আগ্রহী না হলেও এই চার্জ নেয়া হচ্ছে। ইন্টারনেট ব্যাংকিং সুবিধা না দিলেও গ্রাহকের কাছ থেকে গণহারে এই ফি নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কিছু ক্ষেত্রে তফসিলি ব্যাংকের বিভিন্ন সেবার সর্বোচ্চ চার্জ আদায়ের সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক এই সীমার বাইরে গিয়ে তাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে দেশে পরিচালিত বিদেশী ব্যাংকগুলো। তারা বিভিন্ন সেবার বিনিময়ে ‘গলাকাটা’ অর্থ গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এসএম মনিরুজ্জামান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, নির্ধারিত সার্ভিস চার্জের বাইরে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত অর্থ গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করছে কিনা এটি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর মনিটরিং করা হচ্ছে। যেসব ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ বেঁধে দেয়া হয়েছে সেগুলোও মনিটরিং করা হচ্ছে। যেসব খাতে সার্ভিস চার্জ বেঁধে দেয়া হয়নি সেগুলোতে ব্যাংকগুলো মাত্রাতিরিক্ত চার্জ আদায় করছে বলে আমরা অভিযোগ পাচ্ছি। এই বিষয়গুলো খতিয়া দেখা হচ্ছে নিয়মিতভাবে। সময় সময় নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন ব্যবস্থা। গ্রাহকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ব্র্যাক ব্যাংকে তদন্ত চালায়। ১১টি শাখা পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখতে পায়, সার্ভিস চার্জের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্ত টাকা আদায় করে গলাকাটা ব্যবসা করছে ব্যাংকটি। জানা যায়, ব্র্যাক ব্যাংক এসএমই ঋণ ছাড়ের শুরুতে জীবন বীমা, অগ্নিবীমা, প্রসেসিং ফি, ঝুঁকি ব্যবস্থা, উচ্চ ঝুঁকি এসব বাবদ ঋণের টাকা থেকে একটি অংশ কেটে রাখে। ফলে গ্রাহক ঋণের পুরো টাকা পাচ্ছে না। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ রয়েছে ঋণের টাকা পুরোটাই গ্রাহককে দিতে হবে। ফি আলাদাভাবে কেটে রাখতে হবে। এই নিয়ম ব্যাংক মানছে না। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে এসব অযৌক্তিক সার্ভিস চার্জ আদায় বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্র্যাক ব্যাংকের এমডির কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে দেখা গেছে, ব্র্যাক ব্যাংকের নবাবপুর শাখার সিদ্দিকবাজার এসএমই ইউনিট থেকে পাঁচ লাখ টাকা এসএমই ঋণের বিপরীতে গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যাংক জীবন বীমা, অগ্নিবীমা, প্রসেসিং ফিসহ নানা ফি বাবদ ২৭ হাজার ৪৫০ টাকা কেটে নিয়ে গ্রাহককে দিয়েছে ৪ লাখ ৭২ হাজার ৫৫০ টাকা। পরে গ্রাহক আরও সাড়ে ৭ লাখ টাকা ঋণ নিলে ওই টাকা থেকে আগের ঋণের কিস্তি বাবদ ৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা কেটে রাখে। গ্রাহককে দেয়া হয় ৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। ব্যাক টু ব্যাক এলসির বিপরীতে শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ কমিশন নেয়ার কথা থাকলেও একাধিক ব্যাংক নিচ্ছে শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ কমিশন। এছাড়া লোন প্রসেসিং ফি, ডকুমেন্ট হ্যান্ডেলিং চার্জ, ইন্স্যুরেন্স ফি ইত্যাদি নামে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী ফরেন করেসপন্ডেন্ট চার্জ (স্থানীয় অংশ), ডাটা ম্যাক্স, হ্যান্ডলিং চার্জ, কপি ডকুমেন্ট এনডোর্সমেন্ট চার্জ, এলসি বাতিল এসব ক্ষেত্রে কোনো চার্জ আদায় করা যাবে না। কিন্তু ব্যাংকগুলো চড়া চার্জ আদায় করছে। রফতানি বিল নেগোসিয়েশন কমিশন ও রফতানি বিল কালেকশন কমিশন সর্বোচ্চ দশমিক ১৫ শতাংশ নির্ধারিত আছে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি আদায় করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে প্রাইম ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা বেআইনিভাবে গ্রাহকের হিসাব থেকে ২৩ কোটি টাকা কেটে রাখার প্রমাণ পেলে সেগুলো গ্রাহকদের ফেরত দিতে বাধ্য করা হয়। একইভাবে সার্ভিস চার্জের নামে ব্যাংক এশিয়ার টঙ্গী শাখায় তিনজন গ্রাহক থেকে ২০ হাজার টাকা কেটে নেয়ার বিষয়টিও পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে ফেরত দেয়া হয়েছে। শাহজালাল ব্যাংকের উত্তরা শাখার একজন গ্রাহকের হিসাব থেকে অতিরিক্ত চার্জ কেটে রাখলে পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে তা ফেরত দেয়া হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস চার্জের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ কর্তন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তেও তার প্রমাণ মিলছে, যা উদ্বেগজনক। এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোকে ঘোষিত চার্জের বাইরে অন্য কোনো চার্জ আদায় না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
No comments:
Post a Comment