Saturday, August 9, 2014

তিন দশকে ৪৬৬ কোটি টাকা লোপাট:যুগান্তর

চৌত্রিশ বছরে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নামে সরকারের কমপক্ষে ৪৬৬ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এর মধ্যে ৫ বছরেই গেছে অন্তত ৮৩ কোটি টাকা। এ অর্থের সবই এমপিও খাতের- যা সরকার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা হিসেবে দিয়ে থাকে। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এসংক্রান্ত প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটির কাছে পেশ করা হয়। অবৈধভ
াবে নিয়োগ পেয়ে এমপিও গ্রহণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকের মৃত্যুর পরও তার নামে বেতন উত্তোলন করে আত্মসাৎ, শিক্ষক নিয়োগ না দিয়েই এমপিও গ্রহণ, প্যাটার্নবহির্ভূত শিক্ষক নিয়োগসহ নানাভাবে ওই অর্থ লোপাট করা হয়েছে। এভাবে অর্থ লুটপাট ঠেকাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাঠ পর্যায়ে প্রতি জেলা-উপজেলায় দু’টি করে কমিটি গঠনের চিন্তাভাবনা করছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিআইএ পরিচালক মফিজ উদ্দিন আহমদ ভূইয়া জানান, পরিদর্শন থেকে অর্থ লোপাটের যে চিত্র তারা পেয়েছেন তা সবই ফেরতযোগ্য। এসব অর্থ আদায়ের জন্য তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠিয়েছেন। এছাড়া স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিষয়গুলো প্রতিবেদন আকারে জমা দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, ১৯৮১-১৯৮২ সাল থেকে ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে মোট ৪৯ হাজার ১৫৬টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা হয়। এতে বিধিবহির্ভূতভাবে ৪৬৫ কোটি ৬২ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ টাকা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে অবৈধভাবে গ্রহণের তথ্য উদ্ঘাটিত হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ডিআইএ মোট ৬ হাজার ৮৯১টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে। এরমধ্যে ৩৫৫টি প্রতিষ্ঠান বিশেষভাবে পরিদর্শন করা হয়। এ সময়ে ৮৩ কোটি ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৬ টাকা অবৈধভাবে গ্রহণের তথ্য পাওয়া যায়। সূত্র জানিয়েছে, এমপিওর অর্থ লুটপাটের এই চিত্র এর আগে গত সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক অনুসন্ধানেও ধরা পড়ে। এ ব্যাপারে তারা একটি সাব-কমিটি গঠন করে দিয়েছিল। তৎকালীন সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ শাহ আলমের নেতৃত্বে ওই সাব-কমিটি সারা দেশে সমীক্ষা চালায়। এরপর তারা যে প্রতিবেদন দাখিল করে, তাতে ৪৪০ কোটি টাকা লোপাটের চিত্র পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে অধ্যক্ষ শাহ আলম এমপি যুগান্তরকে জানান, তাদের অনুসন্ধানে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ৪৪০ কোটি টাকা অতিরিক্ত গ্রহণের প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা ডিআইএ তাদের গত ৩১ বছরের তদন্তে চিহ্নিত করেছে। তবে প্রকৃত চিত্র আরও করুণ। কেননা, ডিআইএ’র যারা স্কুল-কলেজে পরিদর্শনে যায়, তাদের অনেকে নানাভাবে ম্যানেজ হয়ে দুর্নীতির প্রকৃত তথ্য রিপোর্টে লেখেন না। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ নিয়ে দুর্নীতির চিত্র গোপন করে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাহিদা মতো অর্থ না পেলে মিথ্যা তথ্য রিপোর্টে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ফাঁসিয়ে দেয়ার ঘটনাও রয়েছে। অর্থ লুটপাটের এটি প্রকৃত চিত্র নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, প্রকৃত চিত্র আরও করুণ। সারা দেশের মোট স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শন প্রতিবেদনের চিত্র এটা। সব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দিক নিরীক্ষা করা হলে অর্থ লুটপাটের ক্ষেত্রে আরও ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে আসবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এভাবে এমপিওর অর্থ লুটপাটের কারণে সরকার এবার মাঠপর্যায়ে তদারকি ও পরিদর্শন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পৃথকভাবে একটি করে মোট দুটি কমিটি গঠন করা হবে। প্রত্যেক কমিটি মাসে ২ থেকে ৩টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করবে। এ ব্যাপারে একটি ফাইল অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানা গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিল ‘পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর’ (ডিআইএ)। এ সংস্থাটিই সারা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করে থাকে। সরকারি এ অর্থ লোপাটের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) এবং দুর্নীতি ধরার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান ডিআইএ’র একশ্রেণীর কর্মকর্তারা সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে এই চক্রটি একদিকে অবৈধ এমপিও ছাড়ে সহায়তা করে। দুর্নীতির মাধ্যমে এমপিও দেয়ার কাজ করে এমন একটি চক্র সম্প্রতি মাউশিতে ধরাও পড়েছে, যাদের ব্যাপারে বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে। অনেক ক্ষেত্রে রহস্যজনক কারণে দুষ্কৃতকারীরা পার পেয়ে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে দুর্নীতির দায়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও মন্ত্রণালয়, মাউশি এবং ডিআইএ কর্মকর্তারা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর যদিও মাঝে-মধ্যে সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানের কেউ দুর্নীতিতে মদদ দেয়ার দায়ে ধরা পড়েন, তাহলেও তাদের বদলি বা ওএসডির মধ্যেই শাস্তি সীমিত রাখা হয়। এখানেই শেষ নয়, কিছুদিন পর আবার এসব ওএসডি বা বদলি হওয়া কর্মকর্তাকে অপেক্ষাকৃত ভালো পদে পদায়নের ঘটনাও রয়েছে। এ ব্যাপারে ডিআইএ’র সাবেক পরিচালক অধ্যাপক খান হাবিবুর রহমান বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি গত অক্টোবরে ডিআইএ’র ওপর একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করে। তাতে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা রয়েছে। বিশেষ করে কমিটি ১৪টি সুপারিশ করেছিল। বিভিন্ন সুপারিশের মধ্যে ভালো ও সৎ ব্যক্তিদের ডিআইএতে পদায়ন আর দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্তদের বারবার পদায়ন না করার সুপারিশ রয়েছে। জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব রঞ্জিত কুমার সেন যুগান্তরকে বলেন, ডিআইএ’র অভ্যন্তরীণ অনেক সমস্যা ও কর্মকর্তাদের ব্যাপারে অভিযোগ পুরনো। তবে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটছে। তিনি বলেন, সৎ ব্যক্তিদের পদায়ন করলে পরিস্থিতির আরও উত্তরণ ঘটবে।  

No comments:

Post a Comment