Saturday, August 9, 2014

অপেক্ষার শেষ নেই:যুগান্তর

৫ দিনের টানা অনুসন্ধানের পরও খোঁজ মেলেনি পদ্মার লৌহজং চ্যানেলে ডুবে যাওয়া পিনাক-৬ লঞ্চটির। নৌপরিবহনমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও লঞ্চটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যে কোনো মুহূর্তে উদ্ধার কাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। শুক্রবার আরও ছয়টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এনিয়ে উদ্ধারকৃত লাশের সংখ্যা দাঁড়াল ৪০। এছাড়া শুক্রবার স
ন্ধ্যা পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন ১২৬ জন। এদের মধ্যে ৩৩ শিশু, ৪৪ পুরুষ ও ৪৯ জন মহিলা রয়েছেন বলে মুন্সীগঞ্জ জেলা পুলিশের সাব কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে। পদ্মা-মেঘনার দুই তীরেই এখনও মাতম করে ফিরছেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা। লাশের অপেক্ষায় রয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। শুক্রবার বিকালে মাওয়ার পদ্মা রেস্ট হাউসে নৌপরিবহনমন্ত্রীর সঙ্গে এক জরুরি বৈঠক হয় উদ্ধারসংশ্লিষ্ট সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের। এই বৈঠক শেষে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সাংবাদিকদের বলেন, আপাতত আমরা উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করছি না। যতক্ষণ ডুবে যাওয়া লঞ্চটি না পাওয়া যাবে ততক্ষণ আমরা চেষ্টা অব্যাহত রাখব। তিনি আরও বলেন, ভাটির জেলাগুলোতে সার্চ কমিটি করা হয়েছে। তারা নদীতে টহল দিচ্ছে। লাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো উদ্ধার করে মাওয়ায় পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফেরি ডুবে গেলে সেটি খুঁজে বের করার জন্য ব্ল্যাক বক্স জাতীয় কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন- না, আমাদের কোনো ফেরিতে এরকম ব্যবস্থা নেই। তেমনি পিনাক-৬ লঞ্চটিতেও সিগন্যাল পাওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তিনি জানান, মালয়েশিয়ার বোয়িং ৭৭৭ বিমান নিখোঁজ হওয়ার পর সাগরের তলদেশে খোঁজার জন্য যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে আমরাও সেই প্রযুক্তি প্রয়োগ করেছি। এটাই বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে আধুনিক প্রযুক্তি। তার পদত্যাগ প্রসঙ্গে বলেন, দায় আছে বলেই তো সরকার উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি আমলে লঞ্চ দুর্ঘটনা ছিল ৩১টি। আমাদের সময়ে হয়েছে মাত্র ১৬টি। বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চেয়ারম্যান প্রথম থেকে এই পর্যন্ত সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাকে পাওয়া যায় না বা তিনি নিষ্ক্রিয় একথা সঠিক নয়। মন্ত্রী নিজের বা বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবি অমূলক। এর আগে মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাইফুল হাসান বাদল যুগান্তরকে বলেন, যেসব লাশ পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো আর শনাক্ত করা হচ্ছে না। কারণ লাশগুলো বিকৃত হয়ে গেছে। আর অনেক আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করেও লঞ্চটি শনাক্ত করা যাচ্ছে না। ফলে তারা উদ্ধার অভিযান পরিত্যক্তের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবেন। মন্ত্রীকে সব বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। তিনি পরবর্তী সিদ্ধান্ত দেবেন। এদিকে শুক্রবার পর্যন্ত ৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। যার সবক’টিই নদীর ভাটিতে ভেসে উঠেছে। শুক্রবার বরিশাল পুলিশ ৩টি ও শরীয়তপুরের জাজিরার কাছে একটি লাশ উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। এ নিয়ে মোট উদ্ধারকৃত লাশের সংখ্যা ৪০। এরমধ্যে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুর লাশ ৭ এবং মহিলার লাশ ৫টি। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৭ জনের লাশ শনাক্ত ও পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শুক্রবার আরও ৬ জনের পরিচয় শনাক্ত ও পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা হলেন- ফরিদপুরের সালথার শেপালী (৩৮), শিবচরের বাখরকান্দি গ্রামের নূরে আলম (১৪), গোপালগঞ্জের মোকসেদপুরের বড়দিয়া গ্রামের ইমা (৫), বরিশালের গৌরনদীর ভুইয়াকাঠির আল আমিন (২৫), নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার উত্তর মাছিমপুরের জাহানারা (৪৫) ও লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের চরপাগলা গ্রামের আনোয়ার উল্লাহ (৬৫)। মুন্সিগঞ্জ জেলা পুলিশের সাব-কন্ট্রোলরুম সূত্র জানায়, শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১২৬ জন নিখোঁজ রয়েছে। এদের মধ্যে ৩৩ শিশু, ৪৪ পুরুষ ও ৪৯ জন মহিলা। এদিকে শিবচরের পাঁচচরে জানাজা শেষে ১২ জনের লাশ গণকবরে দাফন করা হয়েছে। দাফনের আগে তাদের শরীরের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। অপর লাশগুলোও শনাক্ত না হলে আজ দাফন করা হবে। ৫ দিনের অনুসন্ধান : টানা ৫ দিন ধরে লঞ্চটি খুঁজে পদ্মার বুকে তল্লাশি চালাচ্ছে উদ্ধারকারী সংস্থাগুলো। বিশ্বের সর্বাধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করেও সফলতা পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের জাহাজ কাণ্ডারি-২ ও জরিপ-১০ মাল্টিপল আলট্রাসনোগ্রাফি সোনার, মাল্টিপল সাইড স্ক্যানার, সাব-বটম প্রোফাইল ও ইকো সাউন্ডারের মতো আধুনিক সরঞ্জাম তারা ব্যবহার করেছেন। পাশাপাশি সনাতন পদ্ধতি বা কনভেনশনাল মেথডে লঞ্চটি শনাক্তে তল্লাশি করেছেন। কিন্তু কিছুতেই সফলতা পাওয়া যায়নি। এসব যন্ত্র দিয়ে তারা কাদা ও পলিমাটির ৭০ ফুট গভীরে এবং বালু মাটির ১৮ ফুট পর্যন্ত গভীরে লঞ্চটি তলিয়ে থাকলে সেটি খুঁজে পাওয়ার কথা। কিন্তু দিন শেষে শুধু হতাশাই শোনা গেছে। নৌবাহিনীর একজন বিশেষজ্ঞ জানান, পদ্মার লৌহজং চ্যানেলের উজান থেকে ভাটির দিকে লম্বালম্বি বেশ কিছু খালের মতো চ্যানেল রয়েছে। সেগুলো ১০০ থেকে ১৪০ ফিট বা তারও বেশি গভীর। ধারণা করা হচ্ছে, ডুবে যাওয়া লঞ্চটি তেমন কোনো খাদে পড়ে তার ওপর কালো মাটির আস্তরণ জমে গেছে। ফলে আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে সেটি ধরা পড়ছে না। ইকো সাউন্ডারও সঠিকভাবে কাজ করছে না। নদীর তলদেশ অসমতল হওয়ায় কনভেনশনাল মেথডও সঠিকভাবে কাজ করছে না। নৌবাহিনীর উদ্ধার দলের সমন্বয়ক ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নৌবাহিনীর ৫টি ইউনিট আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে লঞ্চ খোঁজার কাজ করছেন। পাশাপাশি সনাতন পদ্ধতি বা কনভেনশনাল মেথড প্রয়োগ করে তাদের আরও ৫টি ইউনিট কাজ করছে। মোট ১৭টি জাহাজ উদ্ধার ও অনুসন্ধান কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে। এর মধ্যে সোমবার থেকে কাজ করছে বিআইডব্লিউটিএর ৯টি জাহাজ। সেগুলো হল- রুস্তম, নির্ভিক, সন্ধানী, তিস্তা, টাগবোট ৮-৩৯৭, আইটি-৩৯৪, ব-দ্বীপ, তুরাগ। এছাড়া নৌবাহিনীর ২টি জাহাজ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের জরিপ-১০ ও কাণ্ডারি-২ নামে ২টি জাহাজ। কোস্টগার্ডের ১, ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিশাসক, অগ্নিবিনাশ ও বিশেষ স্পিড বোট রেসকিউ-২। মাওয়াঘাটের প্রায় দেড় কিলোমিটার ভাটিতে গত তিনদিন থেকে অলস বসে আছে ৬টি জাহাজ। তিস্তার কমান্ডার লে. বাশার জানান, তারা মূলত উদ্ধার কাজে সহায়তাকারী জাহাজ। তারপরও তারা অনুসন্ধা করেছেন। শনাক্ত করতে পারলেই তারা উদ্ধার করতে পারবেন। রুস্তমসহ ৬টি জাহাজ অলস বসে থাকা প্রসঙ্গে কর্মকর্তারা বলেন, তারা মূলত উদ্ধারে কাজ করেন। জরিপ জাহাজ থেকে সার্চের মাধ্যমে লঞ্চটি শনাক্ত করা গেলে তারা সেটি দ্রুততার সঙ্গে উদ্ধার করবেন। এদিকে স্থানীয় জেলেরা বলছেন তারা জাল টেনে লঞ্চটি খুঁজে বের করতে পারবেন। এজন্য তাদেরকে জালের দাম দিলেই হবে। কিন্তু এই বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জাল ও দড়ি টেনে চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু এতে তারা সফল হননি। পদ্মার তলদেশ অসমতল হওয়ায় সেটি সম্ভব হয়নি। তাই জেলেরা যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি সঠিক নয়। পানি নামা ডুবুরি নূরুল ইসলাম জানান, পদ্মার পানি খুবই ঘোলা এবং তীব্র স্রোত। ফলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভেসে যাচ্ছেন। আর ঘোলা পানির কারণে তারা ২৫ থেকে ৩০ ফুটের নিচে নেমে আর কিছুই দেখতে পান না। ফলে সেখানে ডুবুরি নামিয়েও সফলতা মিলছে না। নিখোঁজের আত্মীয়রা ক্ষতিপূরণও পাবেন না : যাদের লাশ শনাক্ত হচ্ছে তারা বিআইডব্লি­উর কাছ থেকে ১ লাখ ৫ হাজার ও জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ২০ হাজার মোট এক লাখ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। কিন্তু যাদের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি বা শনাক্ত হয়নি তাদের ক্ষেত্রে কি হবে। স্বজনহারা শোকাতুর এসব মানুষ সামান্য ক্ষতিপূরণ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে যুগান্তরের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয় মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসককে। তিনি বলেন, নিখোঁজদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত নেই। কারণ এতে অনেক ভুয়া ব্যক্তি তাদের লোক মারা গেছে বলে ক্ষতিপূরণ নেয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু যারা পরিচয়পত্র দিয়েছেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের পরিবারের সদস্য নিখোঁজ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি তিনি নৌপরিবহনমন্ত্রীকে জানাবেন। তিনি যে সিদ্ধান্ত দিবেন সেটিই করা হবে। জেলা প্রশাসক আরও বলেন, যাদের স্বজন নিখোঁজ হয়েছে তারা মূলত লাশ ফেরত পাওয়ার বিষয়ে বেশি আগ্রহী। ক্ষতিপূরণ নেয়ার জন্য সাধারণ অনেকেই আসেন না। কন্ট্রোল রুম সূত্রের হিসাব মতে ১৩৯ জনের আত্মীয়-স্বজন নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। শনাক্তকরণ বাদ দিয়ে শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত ১২৬ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে কন্ট্রোল রুম। তাদের মধ্যে ৩৩ শিশু, ৪৪ পুরুষ ও ৪৯ মহিলার লাশ নিখোঁজ। দুই পাড়ে স্বজনদের মাতম : পদ্মা-মেঘনার দুই তীরে এখনও মাতম করে ফিরছেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা। এখনও ১২৬ জন নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের পরিবারের প্রায় প্রত্যেকে পদ্মা-মেঘনার তীরে লাশের অপেক্ষায় রাত-দিন চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। পদ্মার ভাটির জেলাগুলোতে লাশ ভেসে ওঠছে। মাওয়া থেকে ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ভাটিতে ভেসে উঠা লাশ উদ্ধারের জন্য সার্চ কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। শিবচরের রঘুনাথপুরের গ্রামের জেয়াসমিন আক্তার বলেন, তার ভাতিজি লাবণী নিখোঁজ। বাসার সবাই এখন নদীর পাড়ে। কেউ মাওয়া, কেউ শিবচর, কেউ কাওড়াকান্দি। চাঁদপুর ও ভোলাতেও আÍীয়-স্বজনদের পাঠিয়েছেন। যদি লাশ পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো হদিস মিলেনি। ফাইজা ও রুবেলের খোঁজে কুমিল্লা থেকে আসা কামরুল ইসলাম বলেন, ৫ দিন ধরে শুধু ঘুরছি। কখনও শিবচর, কখানও মাওয়া, বরিশাল, চাঁদপুর ও ভোলাতেও আত্মীয়-স্বজন পাঠিয়েছি। কিন্তু কারও খোঁজ পাইনি। লঞ্চটি খুঁজে না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লঞ্চটি কি মালেয়েশিয়ার বিমানের মতো নিখোঁজই থেকে যাবে। বাবার লাশের খোঁজে আসা গোপালগঞ্জের মোকসেদপুরের মানিক জানান, জানি বাবার লাশ পেলেও পরিচয়ও শনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। লাশ বাড়িতেও নেয়া সম্ভব হবে না। তার পরও মন মানে না। যদি লাশটা পাই। তাহলে অন্তত বাবার কবর দিতে পারব। কবরটুকু জিয়ারত করে কুলখানি ও মিলাদ মাহফিল করে কষ্ট কিছুটা হলেও কমাতে পারব। কিন্তু আমাদের এমনই পোড়া কপাল। সরকার আমাদের সেই সুযোগটুকুও করে দিল না। এক পর্যায়ে তিনি নৌমন্ত্রী, বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানসহ উদ্ধারকারীদের অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়ে ক্ষোভ জানাতে থাকেন।  

No comments:

Post a Comment