Monday, August 25, 2014

ছয় সহস্রাধিক চিকিৎসকের পদায়ন ঘিরে অসন্তোষ:যুগান্তর

নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ছয় সহস্রাধিক চিকিৎসকের পদায়নের আদেশ জারির পর স্বাস্থ্য খাতে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। সুবিধাজনক স্থানে পদায়ন বঞ্চিতদের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ এবং বেদম দৌড়ঝাঁপে প্রকম্পিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর। পদায়নের আদেশ জারির পর থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) শীর্ষ নেতারাও। অভিযোগ উঠেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবার এন্ট্রি পদে চিকিৎসকদের পদায়নের কাজ ক
রতে গিয়ে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলেছে। ইতিপূর্বে এ কাজগুলো করে আসছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদফতরের পদস্থ কর্মকর্তারাও মন্ত্রণালয় থেকে পদায়নের আদেশ জারির সমালোচনা করেছেন। ৩৩তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত নতুন চিকিৎসকদের ২৭ আগস্টের মধ্যে কর্মস্থলে যোগ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। কিন্তু পছন্দের জায়গায় পদায়ন না পাওয়া চিকিৎসকরা যোগদান না করতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন। একে ওকে ধরে মন্ত্রণালয়ে তদবির চালাচ্ছেন তারা। বুধবার গভীর রাতে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ছয় সহস্রাধিক চিকিৎসকের কর্মস্থল বণ্টন করে পদায়নের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। রোববার মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়, অপেক্ষাকৃত অসুবিধাজনক স্থানে পদায়নপ্রাপ্তরা (তাদের ভাষায়) ছোটাছুটি করেই চলেছেন। দুপুরনাগাদ কয়েকশ’ চিকিৎসককে মন্ত্রণালয়ের করিডোরে জটলা পাকাতে দেখা যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত এক চিকিৎসক যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে চট্টগ্রামের একটি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে পদায়ন দেয়া হয়েছে। অথচ চট্টগ্রাম তার বা আমার কারোরই নিজ জেলা নয়। স্ত্রী সেখানে থাকলে সংসার টিকিয়ে রাখাই কঠিন হবে। তাই পুনর্বিবেচনার আবেদন নিয়ে ঘুরছি।’ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, যারা আপত্তি জানাচ্ছেন, তাদেরকে লিখিত আকারে দরখাস্ত পেশ করতে বলা হচ্ছে। যুক্তিসঙ্গত আবেদনগুলো বিবেচনা করা হবে। পদায়নের আদেশ জারির পর থেকে যুগান্তর অফিসে ফোন করেও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অনেক সাধারণ চিকিৎসক ও শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসক নেতারা। তাদের অভিযোগ, মন্ত্রণালয় আসলে পদায়নের ক্ষেত্রে অরাজকতা তৈরি করে ফেলেছে। অ্যাডহক ভিত্তিতে আগে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের মধ্যে যারা কয়েক বছর ধরে গ্রামে কাজ করছেন তাদেরকে নতুন প্রজ্ঞাপনে পুনরায় গ্রামেই পদায়ন দেয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীকে একই জেলা অথবা পার্শ্ববর্তী স্থানে পদায়ন দেয়া হয়নি। নিজেদের পছন্দমতো কিছু চিকিৎসককে ওএসডি করে অপেক্ষাকৃত উচ্চতর সেবাকেন্দ্রে সংযুক্তি দেয়ার অভিযোগও উঠেছে। সাধারণভাবে এদের উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পদায়ন পাওয়ার কথা। মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ৩৩তম বিসিএসে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের মধ্যে প্রায় ৮০০ অ্যাডহক চিকিৎসক এবং ৪৪০ চিকিৎসক দম্পতি রয়েছেন। সব দম্পতিকে একই স্থানে পদায়ন দেয়া যায়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (পার) মোঃ হাবিবুর রহমান অবশ্য এসব অভিযোগ মেনে নেননি। যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘ছয় সহস্রাধিক চিকিৎসকের মধ্যে সবাইকে খুশি রাখা কঠিন। এত বড় কর্মযজ্ঞে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে অসন্তোষ থাকতে পারে। সব এলাকা থেকে সুষমভাবে চিকিৎসকরা চাকরি পাননি। ফলে অনেককে পার্শ্ববর্তী অন্য জেলা-উপজেলায় দিতে হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে কিছুসংখ্যক চিকিৎসক দম্পতি একই স্থানে পদায়ন চাননি। তাদেরকে পৃথক স্থানে দেয়া হয়েছে।’ স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ইতিপূর্বে জানিয়েছেন, ৩৩তম বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া এসব চিকিৎসককে কমপক্ষে দুই বছর বাধ্যতামূলকভাবে পদায়িত কর্মস্থলে কাজ করতে হবে। এক নাগাড়ে দুই বছর কাজ করার পর এই চিকিৎসকরা উচ্চতর কোর্সে ভর্তি ও শিক্ষার সুযোগ পাবেন। চাহিদামতো পছন্দের কর্মস্থলের জন্যও তখন বিবেচনা করা হবে। তবে সংশ্লিষ্ট অনেকের অভিযোগ, এ পদায়নের ক্ষেত্রে যথাযথ ও সাধারণভাবে অনুসৃত নিয়মকানুনগুলো মানা হয়নি। পদায়ন আদেশে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রতিফলন নেই। চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) নেতারা এ বছর নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে পদায়নের কাজ স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে মন্ত্রণালয়ে নিয়ে নেয়ার কড়া সমালোচনা করেছেন। তাদের বক্তব্য, এত বছর ধরে কাজগুলো করেছে অধিদফতর। মন্ত্রণালয় নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলো নেবে। বাস্তবায়ন করবে অধিদফতর। এখন মন্ত্রণালয় হঠাৎ করে পদায়ন করতে গিয়ে নানারকম সমস্যা বাধিয়েছে। জানতে চাইলে বিএমএ মহাসচিব ও আওয়ামীপন্থী স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রণালয় চিকিৎসকদের পদায়নের ক্ষেত্রে বিশাল অরাজকতা তৈরি করেছে। এখন শৃংখলা ফেরাতে অধিদফতরকে বেগ পেতে হবে। ঢাকার আশপাশের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রায় সব পদ পূর্ণ রয়েছে। অথচ প্রতিটি কেন্দ্রে ২৮ থেকে ৩০ জন করে সংযুক্তি দেয়া হয়েছে। তার বক্তব্য, যারা পদায়ন পেয়েছেন তাদের জন্য তো রাজনৈতিক তদবির ছিল না। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, বুধবার রাতে ৬ হাজার ২২১ জন চিকিৎসকের পদায়নের আদেশ জারি করা হয়েছে। এরমধ্যে ১১৭ জন সহকারী ডেন্টাল সার্জন। অন্যদেরকে মেডিকেল অফিসার অথবা সহকারী সার্জন পদে পদায়ন করা হয়েছে। তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি প্রজ্ঞাপনেই অনেককে ওএসডি করে সংযুক্তি দেয়ার তথ্য আছে। যুগ্ম-সচিব হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেছেন, ‘অনেকে যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পদায়ন প্রার্থনা করেছেন। সেগুলো যথাসম্ভব বিবেচনার চেষ্টা চলবে।’ শীর্ষস্থানীয় এক বিএমএ নেতা বৃহস্পতিবার বিকালে টেলিফোনে যুগান্তরের কাছে পদায়ন ঘিরে নিয়ম লংঘনের একটি উদাহরণ তুলে ধরেছেন। তিনি জানান, চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে পাসকৃত ডা. আবু বকর মোঃ নিজামুল হক শিকদার (সিরিয়াল নং-৭৬৫, মেধাক্রম-৮০৬) কক্সবাজারের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে পদায়ন পেয়েছেন। নিজামুল হক চমেক শাখা ছাত্র-শিবিরের উপরস্থ পদে ছিলেন। তাকে তৃণমূলে পদায়ন না করে জেলাপর্যায়ে পদায়ন দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে বলে ওই বিএমএ নেতার অভিযোগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, কয়েক বছর আগে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের মধ্যে যারা ৩৩তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি পেয়েছেন তাদেরকে ইনসিট্যু দিয়ে বর্তমান কর্মস্থলে রেখে দেয়ার সুপারিশ করেছিল বিএমএ। বৃহস্পতিবার কয়েকজন বিএমএ নেতা বলেন, উল্টো অ্যাডহক চিকিৎসকদের বর্তমান কর্মস্থল থেকে সরিয়ে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে পুরনো এসব কর্মী হয়রানিতে পড়েছেন। অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান বলেন, আমার জানামতে সব চিকিৎসক দম্পতি একই জেলায় পদায়ন চেয়েছেন। অথচ স্বামী ঢাকায় চাকরি করেন, স্ত্রীর বাড়ি মুন্সীগঞ্জে এমন এক নারী চিকিৎসককে সিলেট বিভাগে পদায়ন দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এমন উদাহরণ আরও আছে। তিনি জানান, পদায়ন আদেশ জারির পর থেকে অসংখ্য চিকিৎসক তার কাছে ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, তিনি অনেকের কাছ থেকে অভিনন্দন পেয়েছেন। অভাব অভিযোগ কম। দুয়েকটি ক্ষেত্রে ভুল হয়ে থাকলে সেগুলো সংশোধন করা হবে। মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, ৭ আগস্ট কাজে যোগদানকৃত এই চিকিৎসকরা ওইদিন থেকেই কর্মকাল গণ্য করা হবে। পদায়ন আদেশের ভিত্তিতে ২৭ আগস্টের মধ্যে তারা কর্মস্থলে চলে যাবেন। প্রজ্ঞাপনে দুই বছরের আগে এই চিকিৎসকরা বদলি হতে পারবেন না বলে উল্লেখ আছে।  

No comments:

Post a Comment