Tuesday, August 12, 2014

৬১ জন নিখোঁজ, লঞ্চ উদ্ধার অভিযান বন্ধ:প্রথম অালো

মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা নদীতে ডুবে যাওয়া লঞ্চ উদ্ধারের কার্যক্রম গতকাল সোমবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নদীর তলদেশে থাকা পিনাক-৬ নামের লঞ্চটির অবস্থান শনাক্ত না করে এবং ৬১ জন যাত্রী নিখোঁজ থাকা অবস্থায় আট দিন পর উদ্ধার অভিযান বন্ধ করা হলো। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান অভিযান বন্ধ করে দেওয়ার কথা জানালেও মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক সংবাদ সম্মেলনে উদ্ধার অভিযান স্থগিত করার কথা বলেছেন। এদিকে এত যাত্রী
নিখোঁজ থাকা অবস্থায় উদ্ধার কার্যক্রম স্থগিত করায় ক্ষুব্ধ নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা। ৪ আগস্ট মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাওড়াকান্দি থেকে দুই শতাধিক যাত্রী নিয়ে মাওয়ায় আসার পথে বেলা ১১টার দিকে ডুবে যায় পিনাক-৬। গতকাল বেলা ১১টায় লঞ্চ উদ্ধার কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেন মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাইফুল হাসান। সংবাদ সম্মেলনে নৌমন্ত্রীর থাকার কথা শোনা গেলেও তিনি আসেননি। তবে নৌমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক। পরে নৌমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, তীব্র স্রোত ও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ডুবুরিরা নামতে না পারায় লঞ্চটির উদ্ধারকাজ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আধুনিক সব জাহাজ আর প্রযুক্তি দিয়ে দেশে এযাবৎ সবচেয়ে বড় অভিযান চলেছে পিনাক-৬ উদ্ধারে। কিন্তু আট দিনে উদ্ধার তো দূরের কথা, লঞ্চটির অবস্থানও শনাক্ত হয়নি। এ পর্যন্ত ৪৬টি লাশ উদ্ধার হলেও নিখোঁজ রয়েছে ২১টি শিশু, ২৪ জন নারী ও ১৬ জন পুরুষ। স্বজনদের ক্ষোভ: লঞ্চ উদ্ধার কার্যক্রম স্থগিতের খবর শুনে সাবেক সেনাসদস্য আবুল কালাম ক্ষুব্ধ কণ্ঠে প্রথম আলোকে বললেন, ‘সবার চোখের সামনে লঞ্চ ডুবল। আমরা কিছুই করতে পারলাম না। লাশের জন্য ট্রলার নিয়ে লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল পর্যন্ত ঘুরেছি। হয়তো লঞ্চেই আমার ভাইয়ের লাশ আটকে আছে। এই আধুনিক যুগেও আমরা একটা লঞ্চ উদ্ধার করতে পারলাম না। আমরা কি তাহলে অসহায়?’ ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকায় উদ্ধারকাজে অংশ নিয়ে অনেক লাশ উদ্ধার করেছিলেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন নায়েক আবুল কালাম। এর ২৩ বছর পর বাড়ির পাশের পদ্মা নদীতে পিনাক-৬ নামের লঞ্চডুবিতে নিখোঁজ ছোট ভাই মাহবুবের লাশ আট দিনে অনেক চেষ্টা করেও পাননি তিনি। ভাগনে বিল্লাল (২৩), ভাগনি শিল্পী (২৫), ভাগনিজামাই ফরহাদ হোসেন (২৭) ও ফরহাদের এক বছরের মেয়ে ফাহিমার খোঁজ গতকালও পাননি আলমগীর হোসেন। দুপুরে মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘ছেলেমেয়েকে হারিয়ে আমার বোন পাগলের মতো হয়ে গেছে। ঈদের ছুটিতে সবাই বাড়িতে আসছিল। আমরা আশায় ছিলাম লঞ্চ উদ্ধার হলে লাশগুলো অন্তত পাব। কিন্তু সেই আশাও শেষ হয়ে গেল।’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তাঁর প্রশ্ন, ‘লঞ্চ উদ্ধার না করেই সরকার অভিযান শেষ করল কেন?’ শিবচরের সন্ন্যাসীর চর এলাকার সুরাতুন্নেসা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘তাইলে কি আমার পোলা-মাইয়্যা, জামাই, নাতি—কাউর লাশটাও পামু না। আমি কী লইয়া বাঁচুম।’ নিখোঁজ আরও কয়েকজনের স্বজনেরাও ক্ষোভ জানালেন। ‘ব্যর্থ’ উদ্ধার কার্যক্রম: মাওয়া ঘাটের কাছে পিনাক-৬ ডুবে যাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে ঘাট থেকে ২৫-৩০টি স্পিডবোট গিয়ে অর্ধশত যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করে। লঞ্চটি উদ্ধারের জন্য ওই দিন রাত আটটার দিকে চাঁদপুর থেকে ঘটনাস্থলে আসে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম। আসেন ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা। কিন্তু নদী উত্তাল থাকায় তাঁরা নামতে পারেননি। ওই রাতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পক্ষ থেকে বলা হয়, উদ্ধারকারী জাহাজ ‘নির্ভীক’ এলে উদ্ধার অভিযান পুরোদমে শুরু হবে। ৫ আগস্ট রাত ১১টায় নারায়ণগঞ্জ থেকে মাওয়া ঘাটে আসে নির্ভীক। কিন্তু লঞ্চের অবস্থান শনাক্ত করতে না পারায় রুস্তম ও নির্ভীক অলস বসে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের শনাক্তকারী জাহাজ কান্ডারি-২ আসে ৬ আগস্ট। জাহাজটি সাউন্ড স্ক্যানার দিয়ে তল্লাশি শুরু করে। শুক্রবার (৮ আগস্ট) সকালে মাওয়ায় আসে শনাক্তকারী আরেক জাহাজ জরিপ-১০। কিন্তু সেটিও লঞ্চটিকে শনাক্ত করতে পারেনি। ৮ আগস্ট মাওয়া ঘাটের ডাকবাংলো পদ্মায় নৌমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘মালয়েশিয়ার নিখোঁজ বিমান শনাক্তে যেসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, আমরাও সেগুলো ব্যবহার করছি।’ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দুটি শনাক্তকারী জাহাজ ছাড়াও নৌবাহিনী, বিআইডব্লিউটিএ, ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ডেরসহ সব মিলিয়ে অন্তত ১০টি নৌযান কাজ শুরু করে। কিন্তু লঞ্চটির সন্ধান মেলেনি। তবে ৯ আগস্ট কান্ডারি-২-এর কমান্ডার মনজুরুল করিম চৌধুরী জানান, পদ্মার তলদেশে তাঁরা একটি ধাতব বস্তু পেয়েছেন। এটির আকার পিনাক-৬-এর মতো। এ কথায় সবাই আশাবাদী হয়ে ওঠেন। কিন্তু গত দুই দিনেও সেখানে ডুবুরিরা নামতে পারেননি। এর মধ্যে স্থানীয় লোকজনও তাঁদের ‘কপ্পা’ বা ‘টাটকা’ পদ্ধতিতে লঞ্চ অনুসন্ধান শুরু করেন। উদ্ধার কার্যক্রম স্থগিত: গতকাল বেলা ১১টায় সংবাদ সম্মেলন করে অভিযান স্থগিতের ব্যাখ্যা দেন জেলা প্রশাসক সাইফুল হাসান। তিনি বলেন, ‘আট দিন ধরে আমরা আধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করে লঞ্চটি উদ্ধারের চেষ্টা করেছি। কিন্তু লঞ্চটিকে শনাক্ত করতে পারিনি। তীব্র স্রোতের কারণে ডুবুরিরা নদীতে নামতে পারছেন না। তাই উদ্ধার কার্যক্রম স্থগিত করা হলো।’ তবে তিনি জানান, ভাটি অঞ্চলের জেলাগুলোতে লাশ ভেসে উঠলে উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। জেলা প্রশাসক জানান, স্থানীয় লোকজন যে উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছেন, তা চালাতে পারবেন। যদি তাঁরা লঞ্চটিকে শনাক্ত করতে পারেন, তাহলে তাঁদের পুরস্কৃত করা হবে। এ ছাড়া উদ্ধারকারী একটি জাহাজ এখানে থাকবে। গত শনিবার সংবাদ সম্মেলনে জেলা প্রশাসক বলেছিলেন, এখন শুধু নদীর তলদেশে পাওয়া ধাতব বস্তুটিকে ঘিরে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো হবে। তবে গতকাল তিনি বলেন, ওই ধাতব বস্তুটি ডুবে যাওয়া লঞ্চ নয় বলে তাঁরা জেনেছেন। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত নৌবাহিনীর কমান্ডার মনজুরুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘জেলা প্রশাসক যা বলেছেন, সেটাই আমার বক্তব্য। তবে আমরা যে ইমেজটি পেয়েছি, সেটা তো আয়ত্তে আনতে (গ্রিপ) পারিনি। তাই চূড়ান্ত কিছু বলতে পারছি না।’ এই লঞ্চ দুর্ঘটনার মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে মাদারীপুর অঞ্চলের ট্রাফিক পরিদর্শককে বরখাস্ত করা হয়েছে। দুর্ঘটনা রোধে ঝুঁকিমুক্ত করতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই পথে চলাচলকারী সবাইকে সতর্ক হতে হবে, যাতে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ যানে না ওঠেন।’

No comments:

Post a Comment