অনুসন্ধান প্রতিবেদনে মামলার সুপারিশ করবেন না। বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে প্রাণ যাবে- দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাকে এই হুমকি দেওয়া হয়েছে। হুমকিদাতা রাজশাহীর সরকারদলীয় সংসদ সদস্য প্রকৌশলী এনামুল হক। গতকাল বুধবার সকালে এমপির আইনজীবীর মাধ্যমে এই হুমকি পেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন দুদক কর্মকর্তা যতন কুমার রায়। দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা ও উপপরিচালক যতন কুমার রায় গতকাল কালে
র কণ্ঠের কাছে এমপি এনামুলের পক্ষ থেকে প্রাণনাশের হুমকি পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘রাজশাহী-৪ আসনের সংসদ সদস্য এনামুল হক ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দিতে মোবাইল ফোনে আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন তাঁদের আয়কর আইনজীবী কাঞ্চন দাশ। কাঞ্চন দাশ এয়ারটেলের একটি নম্বর (০১৬৭৭০৭২১১১) থেকে গতকাল সকাল ১০টা ৮ মিনিটে হুমকি দিয়ে বলেন, এনামুল হক স্যার বলেছেন, ওপর মহল তাঁর পক্ষে আছে। বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে আপনি শুধু তাঁর বিরুদ্ধে মামলা না করার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেবেন। এর বাইরে কিছু করার চেষ্টা করবেন না।’ তিনি বলেন, ‘আমি ওনাকে বললাম যে অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। ওই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কাঞ্চন দাশ আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। বিষয়টি আমি সঙ্গে সঙ্গে কমিশনকে জানিয়েছি। তাঁদের পরামর্শে রমনা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছি (নম্বর-৭৭৭)।’ দুদক কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘মামলার সুপারিশ না করতে এমন হুমকির ঘটনা আমাকে বিচলিত করেনি; তবে অবাক হয়েছি। একজন এমপির পক্ষে কিভাবে এমনটা সম্ভব!’ দুদকের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারদলীয় এমপি হয়ে এনামুল হক এভাবে দুদক কর্মকর্তাকে হুমকি দিতে পারেন না। কর্মকর্তাকে প্রাণনাশের হুমকির বিষয়টি কমিশন গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে পৃথকভাবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ এ ব্যাপারে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে সংসদ সদস্য এনামুল হক বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানি না। ওই সময় আমি সংসদে ছিলাম। আর কাঞ্চন দাশ আমার অফিসের সামান্য একজন কর্মচারী। তার এমন আচরণ করার কথা নয়। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলব।’ এনামুল হক আরো বলেন, ‘দুদকের কর্মকর্তা যতন কুমার রায়ের সঙ্গে কাঞ্চন দাশের খুবই ভালো সম্পর্ক। একাধিকবার তাদের মধ্যে কথা হয়েছে। দুদক কার্যালয়ে একাধিকবার গিয়েছেও। আর তাই আমি মনে করি, দুদক কর্মকর্তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়।’ মামলার সুপারিশ করে দু-এক দিনের মধ্যে প্রতিবেদন : দুদক সূত্র জানায়, এমপি এনামুল হকের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্ত করছেন যতন কুমার রায়। এ ব্যাপারে গত সোমবার দুদক কার্যালয়ে এমপি এনামুল হককে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ও এনামুল অনুসন্ধান কর্মকর্তার সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে কথা বলেন এবং বেশির ভাগ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো কর্মকর্তাকে অসহযোগিতা করেন। দীর্ঘ অনুসন্ধানে এমপি এনামুলের বিরুদ্ধে কেবল এনা প্রোপার্টিজেরই ২৫০ কোটি টাকার সম্পদ গোপন করার তথ্য-উপাত্ত পায় দুদক। অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শেষে প্রতিবেদন তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দু-এক দিনের মধ্যে এনামুল হকের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশসহ অনুসন্ধান প্রতিবেদন কমিশনে জমা হওয়ার কথা। দুদকের একাধিক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এনামুল হক একজন আইনপ্রণেতা হয়েও শুরু থেকেই আইনের প্রতি সম্মান দেখাননি। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য-উপাত্ত পেয়ে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হলে সঠিক সময়ে তিনি তা দাখিল করেননি। পরবর্তী সময়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হলেও তিনি নির্দিষ্ট সময়ে দুদক কার্যালয়ে আসেননি। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ও তিনি অনুসন্ধান কর্মকর্তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এমপি এনামুলের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করে অনুসন্ধান প্রতিবেদনও প্রস্তুত করা হয়েছে। কমিশন থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর যেকোনো দিন মামলা হতে পারে বলে সূত্র জানায়। হাজার কোটি টাকার সম্পদ গোপনের প্রমাণ মিলেছে : গত সোমবার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুদক কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এনামুল হক বলেন, ‘অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক আমাকে ডেকেছে। আমি আমার সম্পদের সঠিক হিসাব দিয়েছি। এর বাইরে আমার কোনো সম্পদ নেই। আমার সব সম্পদই বৈধ, অবৈধ কোনো সম্পদ আমার নেই।’ তবে হলফনামার বাইরে কোনো সম্পদ নেই বলে এনামুল হক দাবি করলেও দুদকের অনুসন্ধান বলছে ভিন্ন কথা। অনুসন্ধানে তথ্য বেরিয়ে এসেছে, এনামুল হক প্রায় হাজার কোটি টাকার সম্পদ গোপন করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে এনা প্রোপার্টিজের প্রায় ২৫০ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিগত মহাজোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির হলফনামা নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। দুদকের অনুসন্ধানে দুর্নীতির তথ্য পাওয়ায় অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহাবুবুর রহমান তালুকদার, সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান ও কক্সবাজারের এমপি আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে দুদক মামলা করেছে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষে মামলার সুপারিশ করে প্রতিবেদন কমিশনে জমা পড়েছে। প্রতিবেদনটি যাচাই-বাছাই চলছে। আ ফ ম রুহুল হক, মাহাবুবুর রহমান তালুকদার ও আবদুর রহমান বদি বর্তমান সংসদেরও সদস্য।
No comments:
Post a Comment