Thursday, September 11, 2014

ভাঙনের মুখে জাতীয় পার্টি!:কালের কন্ঠ

জাতীয় পার্টিতে সংকট আরো বেড়েছে। দলটিতে আবারও ভাঙনের আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং তাঁর স্ত্রী ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের দ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দলের ভাঙন রোধ করাটাই এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিরোধের জেরে গতকাল বুধবার রওশনের আস্থাভাজন জাপার দুই নেতা তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও মশিউর রহমান রাঙ্গাকে দলের প্রেসিডিয়াম পদ থেক
ে অপসারণ করেছেন এরশাদ। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, যা পরিস্থিতি তাতে এরশাদ-রওশন  দ্বন্দ্ব সহজে মেটার নয়। বিরোধী দলের নেত্রীর সঙ্গে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সংসদ সদস্য। ফলে পার্টির চেয়ারম্যান হলেও এরশাদের চেয়ে রওশন গ্রুপ বেশি শক্তিশালী। তা ছাড়া সরকারের আশীর্বাদও রয়েছে তাঁদের ওপর। ফলে দলে একরকম কোণঠাসা অবস্থায়ই আছেন চেয়ারম্যান। তার পরও এরশাদ আসন্ন এই ভাঙন ঠেকাতে মরিয়া। ক্ষমতাসীনরাও এই ভাঙন চায় না। কারণ তাঁদের বিবেচনায় এতে আখেরে লাভবান হবে বিএনপি। তাই এরশাদ-রওশন দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলার পক্ষে আওয়ামী লীগ। এরশাদের প্রতি আস্থার সংকট থাকলেও এখনো প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত তিনি। সূত্র জানায়, জাপার সংসদ উপনেতা নিয়ে দলের ভেতরে সৃষ্ট জটিলতা নিয়ে গত মঙ্গলবার সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এরশাদ। তিনি সংসদ নেত্রীর কাছে এ বিষয়ে সহায়তা চান। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেখ হাসিনা তাঁকে এ বিষয়ে কোনো আশ্বাস দেননি, বরং স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রওশন যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাকেই গুরুত্ব দেবেন তিনি। এতে এরশাদ বেশ ক্ষুব্ধ হন। এই ক্ষোভের অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার রওশনের আস্থাভাজন জাপার দুই নেতা তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও মশিউর রহমান রাঙ্গাকে দলের প্রেসিডিয়াম পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে শোধ নেন তিনি। তা ছাড়া এ দুই নেতার জেলা রংপুর ও কুড়িগ্রামের জেলা কমিটিও বিলুপ্ত করে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন তিনি। এর পরই তাজুল ও রাঙ্গা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এরশাদের বিরুদ্ধে নালিশ করেন। একজন সংসদ সদস্য এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর আগে দলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি পদ থেকে কাজী ফিরোজ রশিদকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তারও আগে তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে দলের দপ্তর সম্পাদক পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। সূত্র জানায়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এরশাদের নাটকীয় কর্মকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ বিরক্ত হন। এরপর তিনি কাছে টেনে নেন রওশনকে। তখন থেকে জাপা ও সরকারের মধ্যে এরশাদের অবস্থান দুর্বল হতে থাকে। জাপার প্রায় সব সংসদ সদস্য রওশন এরশাদের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে একজোট হন। গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যানকে অনেক ক্ষমতা দেওয়া থাকলেও তাঁর নেতৃত্ব মানছে না এই অংশ। ফলে বিচলিত এরশাদ দলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে একের পর এক নেতাদের অপসারণ করে চলেছেন। জাতীয় পার্টির নির্বাচনী প্রতীক লাঙ্গল রওশনের নামে লিপিবদ্ধ আছে বলে জানা গেছে। তাই এরশাদ যদি বাড়াবাড়ি করেন, তাহলে রওশনের নেতৃত্বে একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন জাপা নামে আত্মপ্রকাশ করলে এরশাদ শেষ পর্যন্ত প্রতীকও হারাতে পারেন। এ ছাড়া একাধিক মামলা থাকায় এ মুহূর্তে বেশ চাপে আছেন এরশাদ। তবে জাপা সূত্রগুলো জানিয়েছে, দলের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন ছাড়া পার্টিতে এরশাদের ক্ষমতা খর্ব করার কোনো সুযোগ নেই। সংসদীয় দলের প্রধান হিসেবে ক্ষমতার অংশে রয়েছেন স্ত্রী রওশন আর দলীয় প্রধান হিসেবে ক্ষমতা এরশাদের হাতে। ফলে মামলা ও সরকারের চাপে এরশাদের জাতীয় পার্টির নিয়ন্ত্রণ যে এখন কার হাতে সেটাই দলটির নেতা-কর্মীদের কৌতূহলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ত্রিমুখী জাপায় নেতৃত্ব সংকট : সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জাপায় এখন এরশাদ, রওশন ও জি এম কাদেরের নেতৃত্বে তিনটি গ্রুপ সক্রিয়। এই তিন নেতার প্রত্যেকেই দলে তাঁদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মরিয়া। জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, এরশাদ একেক সময় একেক কথা বলে নিজের অবস্থান নষ্ট করে ফেলেছেন। তাই এখন দলে তাঁর নিয়ন্ত্রণ অনেকটা আলগা হয়ে গেছে। অন্য একটি সূত্র জানায়, শুধু তাজুল বা রাঙ্গা নন, দলের ৩৪ জন সংসদ সদস্যের অধিকাংশই এখন রওশনপন্থী। তাঁরা রওশনের কথার বাইরে কোনো কিছু করতে রাজি নন। এ জন্য দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুকে সংসদের উপনেতা করতে প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ পর্যন্ত হতে হয়েছে সাবেক এ প্রেসিডেন্টকে। আর জি এম কাদেরের সঙ্গে আছেন দলটির একজন সাবেক মহাসচিবসহ বেশ কয়েকজন নেতা। জানা গেছে, এরশাদের বিরোধিতার কারণেই দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও এমপি কাজী ফিরোজ রশীদকে বিরোধী দলের উপনেতা ঘোষণা করতে পারছেন না স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। রওশনের লিখিত আবেদনে ফিরোজের পক্ষে ৩০ জন এমপি স্বাক্ষর করলেও এরশাদ বলছেন, তিনি পার্টির প্রধান হয়েও এ বিষয়ে কিছু জানেন না। পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ থেকে বহিষ্কৃত প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো কোনো চিঠি পাইনি। পেলে তখন ভেবে দেখব কী করা যায়।’ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘এরশাদ মহাসচিবকে উপনেতা করতে আমাদের সমর্থন না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ : বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নালিশ জানিয়েছেন। তাঁরা বিষয়টি নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। এ সময় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যপদ থেকে অব্যাহতির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ব্যাপারটি নিয়ে পার্টির অন্যান্য সংসদ সদস্যের মধ্যেও ক্ষোভ ছড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যপদ থেকে দুই নেতাকে অব্যাহতি দেওয়ার খবরটি গতকাল বুধবার সারা দিনই জাতীয় সংসদে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। বিকেলে সংসদ অধিবেশন কক্ষে জাতীয় পার্টির নেতারা একে অন্যের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। মাগরিবের নামাজের বিরতি ঘোষণার পর সংসদ নেতা শেখ হাসিনা যখন অধিবেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন ছুটে যান বিরোধী দলের ওই দুই সিনিয়র সদস্য। তাঁদের দেখে প্রধানমন্ত্রীও দাঁড়িয়ে পড়েন। এরপর তাঁরা জাপা চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। এ সময় পাশে গিয়ে দাঁড়ান পার্টির সাবেক মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের কথা শুনলেও এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। এদিকে মাগরিবের নামাজের বিরতিতে বিরোধীদলীয় নেতা রওশনের সঙ্গে বৈঠক করেন মশিউর রহমান রাঙ্গা, তাজুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন সদস্য। তাঁরা এরশাদের সিদ্ধান্তকে পাগলের কাণ্ড বলে অভিহিত করেন। চেয়ারম্যানের এই আচরণ সহ্য করা হবে না বলেও তাঁরা মন্তব্য করেন। জবাবে রওশন এরশাদ সবাইকে মাথা ঠাণ্ডা রাখার পরামর্শ দেন। এ সময় রওশন বলেন, ‘এগুলো তোমাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য নয়, এগুলো মূলত আমার সঙ্গে করা হচ্ছে। সকলে আলোচনা করে সময় নিয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ বৈঠক শেষে প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুজনকে প্রেসিডিয়াম পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া প্রসঙ্গে ম্যাডাম তাঁদের ধৈর্য ধরতে বলেছেন।’ তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, ‘দু-এক দিন পার হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘এরশাদ বিরোধী দলের নেতা হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে গেছেন। তিনি আমাকে কয়েকবার বলেছেন, বিরোধী দলের দুই নম্বর চেয়ারে বসতে আমার ভালো লাগে না। তোমরা কিছু একটা করো। কিন্তু আমি এরশাদের এই অন্যায় আবদারকে প্রশ্রয় দিইনি। কেননা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তো আমরা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে অংশ নিয়েছি। তখন তো এরশাদ নির্বাচনের বিরোধী ছিলেন।’ তাহলে জাপায় ভাঙনের সৃষ্টি হবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এরশাদ নিজেই জাপাকে ছোট করে আনছেন। সময়ই বলে দেবে কী হবে। তবে কিছু হলে এর জন্য দায়ী থাকবেন এরশাদ।

No comments:

Post a Comment